September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোনো মানুষকেই ভালো রাখে না

তৌকির ইসলাম।। একটা সমাজের প্রকৃত চেহারা বোঝা যায় ঐ সমাজের তরুণদের কর্মকাণ্ড, আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাগুলো লক্ষ্য করলে। আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যবহারও একটি অন্যতম মাপকাঠি হতে পারে। মাত্র কিছুদিন আগে একজন নারীকে নির্যাতনের ভিডিও এবং এর বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সামনে এসেছে। গত বছরেও নারী নির্যাতনের একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছিল, অনেকেরই হয়তো তা মনে আছে। তাছাড়া নতুন মাদক এলএসডি নিয়েও এখন চলছে বেশ আলোচনা। একটু যদি লক্ষ্য করি বিগত কয়েক বছরে এই ব্যাপারগুলো সকলের সামনে বারবার এসেছে। কিন্তু কেন? সবাই হয়তো বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থার কথা বলবেন। কিন্তু আইন প্রয়োগ করেই সমাজের সকল অসঙ্গতি দূর করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না পরিবর্তনটা পরিবার এবং সমাজ থেকে হচ্ছে। সমাজের এই অসঙ্গতির দিকে যদি লক্ষ্য করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে পুরুষদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ সবচেয়ে বেশি এবং ভিক্টিম নারী। নারীর দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তবে তা তুলনায় কম। আসলে এই অসংগতি সমাজের চরম পুরুষতান্ত্রিকতার বহিঃপ্রকাশ।

আগে একটা সময় ছিল ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ইভ টিজিং হলেও হতো গোপনে এবং পরে তা আইন প্রয়োগকারীরা বের করতেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের ঘটনাগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় কিশোর কিংবা সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা পুরুষ ঘটনার ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন কি সে তার নিজের পরিচয়ও ভিডিও’তে গোপন করছে না। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে এরা খুব ভালোভাবে শিখে গেছে যে ভিডিও ছড়িয়ে দেবার পর তার কিছুই হবে না। সমাজ মেয়েটাকেই দোষ দেবে। মেয়েটাকেই খারাপ বলবে। আর মেয়েটার মাথায়ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঢুকিয়ে দিয়েছে যে এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে কিংবা এই ঘটনা জানাজানি হলে সমাজ তোমাকেই দুষবে। তুমি তোমার নিজের পরিবারকেও কাছে পাবে না। বিচারহীনতাকে এখানে দায়ী করা যেতেই পারে, তাতে সমাজের মস্তিষ্কের কোন পরিবর্তন ঘটবে না। বাংলাদেশে তো ধর্ষণ, ইভ টিজিং ঠেকাতে পর্ণ সাইটগুলো বন্ধ করা হয়েছে, তাতে কি খুব পরিবর্তন এসেছে! মোটেও না। কারণ, এদেশের পরিবার এবং সমাজ পুরুষকে শেখায়, নারী অবলা, নারী নিরুপায় এবং পুরুষই নারীর একমাত্র আশ্রয়। আর মেয়েদের শেখায়, পুরুষ যা খুশি করতে পারে তুমি শুধু দেখবে কিছু করতে পারবে না। এমন অসম মানসিকতার চর্চায় পুরুষ হায়েনায় আর নারী নিরীহ হরিণে পরিণত হবে তাই তো স্বাভাবিক। ফলে সমাজের অসঙ্গতিও অবাক করার মত কিছু নয়।

এদেশের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মেয়েদের জন্য তৈরি করা সামাজিক ট্যাবুগুলোও সামাজিক অসঙ্গতির জন্য দায়ী। একজন মেয়ে তার পিরিয়ডের ব্যথার কথা তার ভাই কিংবা ছেলে বন্ধুটিকে বলতে পারে না। একজন স্ত্রী বা নারী সঙ্গী তার যৌন জীবনের আকাঙ্ক্ষা কিংবা কষ্টের কথা তার স্বামী কিংবা পুরুষ সঙ্গীকে বলতে পারে না। কেননা সমাজ তাকে নির্লজ্জ আখ্যা দেবে। অন্যদিকে পুরুষের কাছে ব্যাপারগুলো কামনায় সুড়সুড়ি দেওয়ার মত। পুরুষ এসব শুনে পাশবিক আনন্দ পায়। আর পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই আনন্দ পাওয়াটাকে বৈধতা দেয়। আর এই বৈধতা দেওয়ার ফসল হচ্ছে মেয়েদের প্রতি এক রকম পাশবিকতা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে নারী কেন নারীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার! আসলে অপরাধ প্রবণতা নারী পুরুষ সবার মাঝেই রয়েছে। এবং সমাজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এর পিছনেও রয়েছে পুরুষতন্ত্রের এক পরোক্ষ প্রভাব। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজ ভাবতেই পারে না যে নারী নিজেই নারী পাচারকারী, ড্রাগ ডিলার হতে পারে। নারী নিজেই নারীকে বেচাকেনা করতে পারে। যার ফলে পুরুষ অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে ব্যবহার করে তার নিজস্ব কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য। সুতরাং নারী লাইমলাইটে আসলেও পেছনে থাকে পুরুষ। অন্যদিকে নারী অপরাধী হয়ে ওঠে তার পুরুষ সঙ্গীর চাপে, পুরুষ সঙ্গীর নির্যাতনে। কারণ নারীকে তো শেখানোই হয় যে তোমার কথা বলার এবং তা শোনার জন্য সমাজে কেউ নেই। এর একটা বাস্তব উদাহরণ হতে পারে সমাজের অনেক নারী জানেন যে তার স্বামী বাসার কাজের মেয়েকে অথবা অফিসের নারী কলিগকে হ্যারাস করছে। এবং সব জেনেও নারী চুপ কেননা সে যখনই মুখ খুলবে তার সম্পর্ক টিকবে না। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্য তাকেই দায়ী করবে। এমন কি সব শুনে হয়তো তাকেই দোষ দেবে যে তোমার মধ্যেই কিছুর অভাব ছিল। এই যে সে নীরবে সব জেনেও চুপ, এটাও কিন্তু অপরাধ। কিন্তু এর জন্য আসলে দায়ী কে?

সমাজ যদি নারীদের মতামতকে সম্মান করত, মেয়েদের সমস্যাগুলো মূল্যায়ন করত তাহলে এতটা অসঙ্গতি সৃষ্টি হতো না। নারীর ক্ষেত্রে সব কিছুই সমাপ্ত হয় তার চরিত্রের দোষ দিয়ে, তার ব্যক্তিত্বকে আঘাত করে। আর এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নারী শোষণের প্রধান হাতিয়ার। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন পুরুষই তো নিজের সম্মান নষ্ট করতে  চান না, সেখানে সমাজের তৈরি ছকে বন্দি একজন নারী কীভাবে তা মেনে নেবেন! সব কিছুর উপরে উঠেও যদি একজন নারী প্রতিবাদ করেন তার সাথে কেউ থাকে না, এমন কি তার পরিবারও নয়।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারী এবং পুরুষ দুই পক্ষের অনেক ক্ষতি করেছে এবং করে যাচ্ছে। সমাজের অসঙ্গতি দূর করতে সবার আগে পরিবার ও সমাজ থেকে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর করতে হবে। পরিবার থেকেই ছেলে এবং মেয়ে সন্তানকে শেখানো দরকার যে তোমার মা অনেক ভালো ড্রাইভ করতে পারে আর তোমার বাবার রান্না অনেক মজার। মেয়েদেরকে শেখানো দরকার যে ১৫০ স্কয়ার ফিটের রুমে ১.৫ টন এসি লাগে, আর ছেলেকেও শেখানো দরকার যে এক কাপ চায়ের জন্য হাঁড়িতে ১.৫ কাপ পানি দিও। এতে পারস্পরিক সম্মানবোধ এবং কাজের মূল্যবোধ তৈরি হবে। নারীর মতামতকে সম্মান করলে পুরুষের সম্মান কমে না এটা ছেলেদেরকে বোঝানো দরকার। নারী কোন বস্তু নয়, মানুষ- এটা ছেলেদের জন্মের সাথে সাথে মন্ত্রের মত মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া দরকার। আর সমাজের উচিত নারী-পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সকলকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কোন মানুষই সুখে থাকতে পারে না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]