November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীবাদ’কে অস্বীকার করে কোনো লাভ নেই

আপন সৌরভ।। আমাদের সমাজে কোনো পুরুষ এক বা একাধিক ইস্যুতে কোনোভাবে নারীর পক্ষ গ্রহণ করলে তাকে ‘নারীবাদী পুরুষ’ বলে শ্লেষাত্মক বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়, তার অবস্থান যতই যৌক্তিক হোক না কেন।বাংলাদেশের প্রথাগত আধিপত্যকামী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীবাদকে আলাদাভাবে একটি গালি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চিরন্তন চেষ্টা চালালেও আদতে তারা কি মানবতাবাদকে সরাসরি বিরোধিতা করার যোগ্যতা রাখে?

খুব বেশি পড়াশুনা না করলেও একটা জিনিস নিশ্চয় যে কোন ব্যক্তিই বোঝেন যে, মানবতাবাদ “মানব” তথা মানুষকে নিয়েই কথা বলে। একজন মানবতাবাদী নিশ্চয়ই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের যথাযথ অধিকার নিশ্চিতের পক্ষেই কথা বলবেন। ভাবুন তো, এদেশের সমাজ নারীকে আসলে কতখানি “মানুষ” হিসেবে মূল্যায়ন করে?

প্রত্যেক মানুষের কিছু মৌলিক চাহিদা থাকে, যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি। সেই প্রায় দুই দশক আগে মীনা কার্টুনে মীনার পাতে অর্ধেক ডিম দিয়ে রাজুকে পুরো ডিম খেতে দেওয়ার চিত্র যেন সমগ্র সমাজের নারী-পুরুষ বৈষম্যের প্রতীকী চিত্রই তুলে ধরে। যে মা-বাবার ছেলে সন্তান স্কুল-কলেজে ভাল ফলাফল করে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, সেই পরিবারই মেয়েটিকে কোনোরকমে এইচএসসি পাস করতে করতেই বিদায় করতে পারলে বেচে যায়। “অনেক তো পড়ছে। মেয়ে মানুষ এত পড়ালেখা করে কী হবে!”- এ তো মোটামুটি স্বচ্ছল ঘরেরই নিত্যদিনের চিত্র। আর গরীবের ঘরে ছেলে সংসারের বাতি হলে মেয়ে হল বোঝা, যার মাসিক শুরুর পর যত দ্রুত বিদায় করা যায় ততই মঙ্গল। এই সমাজ যদি মানবতাবাদের পক্ষেই হতো, সে আদৌ মৌলিক অধিকারের জায়গায় এমন চাক্ষুষ তীব্র বৈষম্যকে লালন করতো?

একজন পরিণত মানুষের নিশ্চয়ই তার জীবন নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আছে। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু  বাংলাদেশের সমাজ বিশ্বাস করে, নারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার হাতে থাকা যাবে না। ছোটবেলা থেকে “তুমি কিন্তু মেয়ে” শুনে আসা বেশিরভাগ মেয়েই উচ্চ ডিগ্রিধারী হয়েও নিজের কেরিয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তেও বাবা-মায়ের উপর তো নয়-ই, বরং স্বামী-শ্বশুর-শ্বাশুড়ির মতের উপর নির্ভর করে; যেখানে অবাক করা বিষয়, এত বিদ্যে মাথায় ধরার পরও সে তার মানসিক দাসত্ব কাটাতে পারে না। তার মনের অগোচরে এক অদৃশ্য বক্তা যেন সবসময় বলছে, “তুমি মেয়ে”।

শুধু পুরুষেরাই নয়, মানসিকতার জায়গায় পুরুষতান্ত্রিকতার শেকলে বন্দী অধিকাংশ পুরুষ এবং নারীই মেয়েকে কেবল ‘কন্যা’, ‘স্ত্রী’ বা ‘মা’ হিসেবে ভাবতেই স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন, মানুষ হিসেবে তার যে নিজস্ব পরিচয় আছে, এ কথা চিন্তা করলেই যেন সর্বনাশ। তাইতো নারী কী কাপড় পরবে, কোন সাবজেক্টে পড়বে, কী চাকরি করবে বা আদৌ চাকরি করবে কিনা, কাকে বিয়ে করবে – সব সিদ্ধান্তেই অঘোষিতভাবে তার পরিবারের বচনই মুখ্য বলে বিবেচিত হয়। যে জায়গাগুলোয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের অবাধ স্বাধীনতাই বরং থাকে। বদভ্যাস হিসেবে নয়, কেবল লিঙ্গ নারী বলেই তার সিগারেট খাওয়া এ সমাজের মাথাব্যথার কারণ, তেমনি সেনাবাহিনী, পাইলট কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মত চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ ২০২১ সালে এসেও সমাজের কাছে বিশাল কিছু বলে মনে হয়। অবশ্য মনে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, সে তো আর মানুষ নয়, “মেয়ে-মানুষ”, “মেয়েছেলে”; অত বাড় বাড়তে আছে নাকি তাদের!

আর ধর্ষণের ক্ষেত্রে তো একজন মানুষ অপরাধ করেছে, তার থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায়, একজন পুরুষ ধর্ষণ করেছে, আর ব্যক্তির এই অপরাধকে কেন জানি পুংসমাজ নিজেদের গায়ে নিয়ে নেন, ভিক্টিম ব্লেইমিং করে, নারীর পোশাক আর জীবনাচরণকেই দায়ী করে ধর্ষকের অপরাধকে লঘু করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন; এর মাধ্যমে যে অপরাধকে উৎসাহিত করে নিজেরাও তাতে পরোক্ষভাবে সামিল হচ্ছেন, সেই সুবুদ্ধি তাদের আসলে নেই নাকি “থেকেও নেই” – সেটা বোঝা দায়।

ভাল হোক বা মন্দ, চাকরি হোক বা পড়াশোনা, কিংবা চায়ের কাপের আড্ডা – দৃষ্টিভঙ্গির জায়গায় নারী মানুষ নয়, আলাদা একটা প্রজাতি যে নিজে নিজে চলতে পারবে না, কেবল নিজের যোগ্যতাবলে শীর্ষস্থানে আরোহন করতে পারবে না এবং যে কোনো কঠিন কাজেই সে পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে – এরকম অদ্ভুত চিন্তা ও ধ্যানধারণা বদলাতে হবে আমাদের।

সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সেই আলোচনায় যে বাংলাদেশের মত দেশে নারীর প্রতি সমাজের অযৌক্তিক অসমতা ও বৈষম্যের জায়গাটি কঠোরভাবে উঠে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। মানবতাবাদ নিশ্চিত করার একটি বড় অংশ জুড়েই যে নারীবাদ থাকবে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই তো মানবতাবাদের চর্চা করা যে কোন মানুষ, হোক নারী কিংবা পুরুষ, এদেশে তাকে নারীবাদের ছায়াতলে আসতেই হয়। কারণ সমস্যাটা তো পুরুষ-নারীর লিঙ্গে নয়, সমাজের মগজে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]