পরীমণি ও আমাদের মানসিক বিকৃতি
আরাফাত লিও তন্ময়।। কিছু দিন আগে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুনিয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায়ও দেখেছি কী জঘন্যভাবে আলোচনা হচ্ছে- কলেজ পড়ুয়া মেয়ে কীভাবে লাখটাকার ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারে থেকে শুরু করে জীবিত অবস্থায় তার কতজন প্রেমিক ছিল সেসব ফিরিস্তি। অথচ এতসবের আগে মুনিয়া একজন ভুক্তভোগী। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তার প্রতি হওয়া নৃশংস ঘটনার ন্যায্য বিচার পাওয়া মুনিয়ার নাগরিক অধিকার। তার বাবা একজন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা। যাদের আন্তরিক সহযোগিতায় আমরা আজকে ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় বহন করছি। অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হওয়া বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীর আর এসব ভিক্টিম ব্লেমারদের কাজে তো বিশেষ কোনো পার্থক্য ধরা পড়ে না।
সম্প্রতি নায়িকা পরীমণি অভিযোগ করেছেন- তাঁকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। থানা তার মামলা নিচ্ছে না বলে পোস্ট দিয়েছেন তাঁর ভ্যারিফায়েড ফেসবুক একাউন্টে। রাতে সংবাদ সম্মেলনে করে অভিযোগ জানিয়েছেন অপরাধীর নাম- ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহবুব। পরীমণি নিজের জীবননাশের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুতি জানিয়েছেন বিচারের প্রত্যাশায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত একটি মামলা হয়েছে। পরীমণি সংবাদ সম্মেলন করে কান্নাকাটি করছেন বিচার চেয়ে।
এখন পর্যন্ত পরীমণির স্ট্যাটাসে এক লক্ষ একুশ হাজার রিয়েক্টের মধ্যে সাতাশ হাজার একাউন্ট থেকে হা হা পড়েছে। নেগেটিভ কমেন্ট হাজার হাজার। বাংলাদেশের মানুষের কী ভীষণ নৈতিক স্থলন হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই একুশ শতকের পৃথিবী যাকে আমরা সভ্য বলার চেষ্টা করি সেখানে সেই পৃথিবীর উন্নত জীব বলে পরিচিত মানুষ তার স্বজাতির দুর্দশায় বুনো উল্লাসে মেতে ওঠে। বিশেষত, ভুক্তভোগী যদি স্বাধীনচেতা নারী হন তাহলে তো কথাই নেই। বুকে ওড়না নেই কেন, রাতে চলাফেরা করে কেন, চাকরি করে কেন, সিগারেট খায় কেন, পুরুষের অধীনস্থ থেকে বিদ্রোহ করে কেন বলে হইহই রব ওঠে। অথচ, এসব কিছুর দোহাই দিয়ে নারীকে শারীরিক-মানসিক হেনস্থা করার অধিকার কোনো পুরুষের নেই। সেটা বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারী কেবল সন্তান উৎপাদনের মেশিন নয়; আপনি যদি সেটা মনে করেন- আপনার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।
গোয়ালন্দ ঘাট, নারায়ণগঞ্জের টানবাজার কিংবা খুলনার বানিয়াশান্তার (দেশের স্বীকৃত যৌনপল্লীর কয়েকটি) মেয়ে যারা যৌনকর্মী, তাঁদের শরীরেও বিনা অনুমতিতে হাত দেয়া অপরাধ। এখানে ‘ইয়ে মানে কিন্তু’র কোনো সুযোগ নেই। নেই মানে নেই। আপনার মনে যদি কোনো ধরণের সংশয় জাগে অথবা ভুক্তভোগী নারীর কোনো কাজ দেখে আপনার মনে হয় অমন চলাফেরা করলে ওরকমটা হতেও পারে, তবে নিজেকে নিয়ে চিন্তিত হতে হবে আপনার. আপনার বিবেক, বোধশক্তিও চিন্তাভাবনার জগৎটি নিয়ে সতর্ক হতে হবে। আর যদি ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেন নারীকে শায়েস্তা করতে, তবে আর কি, সেটিই তো চলছে! চলছে ভিক্টিম ব্লেইমিংয়ের মহোৎসব।
অপরাধের বিচার চাইতে গিয়ে- আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কোনো কাজের না। এরই সঙ্গে আওয়াজ উঠুক, বাংলাদেশে ভিক্টিম ব্লেমিং-এর বিরুদ্ধে কঠিন আইন করা হোক। যেন ভুক্তভোগী অন্তত মানসিকভাবে ঠিক থাকতে পারেন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]