ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম: নির্যাতিত নারী যে রোগে নিজেকে ধ্বংস করে
মেহেরুন নূর রহমান।। ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম (BWS), যা ব্যাটারড পার্সন সিন্ড্রোম নামেও পরিচিত সেটা দীর্ঘমেয়াদী ঘরোয়া নির্যাতনের কারণে তৈরি হওয়া একটি মনস্তাত্ত্বিক উপসর্গ। ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম, পোস্ট-ট্রাম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এর একটি উপশ্রেণি হিসাবে বিবেচিত হয়।
একজন নারী যখন দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিতভাবে তার স্বামী বা ঘনিষ্ট অন্তরঙ্গ সঙ্গী দ্বারা মানসিক, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হতে থাকে তখন ধীরে ধীরে এই সিন্ড্রোম ডেভলপ করতে থাকে। এই সিন্ড্রোম সাধারণত নারীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়, তবে পুরুষরাও এর শিকার হতে পারে।
কিশোরী বেলার একটা স্মৃতি মনে পড়ছে। আমাদের বাসা থেকে কিছু দূরেই একটা পরিবার বাস করতো। স্বামীটি খুব সম্ভবত কোন অফিসে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতো। লোকটি প্রায়ই তার স্ত্রীকে মারধর করতো। আর যে সে মার নয়, মারতে মারতে লোকটি স্ত্রীর নাক মুখ ফাটিয়ে ফেলতো, মাঝে মাঝে স্ত্রীটি মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে যেত। ভয়াবহ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে অনেকবার আমার মাকে দৌড়ে সেখানে যেতে হয়েছে। আম্মাকে দেখলে আবার লোকটা চোরের মত ঘর থেকে বের হয়ে যেত। মনে আছে আমার সদ্য তরুণ ভাই একবার মারের বীভৎসতা দেখে লোকটিকে লাঠি দিয়ে মারতে উদ্যত হয়েছিল, সবাই ধরে তাকে থামানো হয়েছিল। আর লোকটিকে দেখলে আমার যে কি পরিমাণ ক্রোধ হতো কি বলবো! সবচেয়ে অবাক লাগতো যখন দেখতাম এসব ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টা পর বা পরদিন তারা দুজন স্বাভাবিকভাবে ঘর থেকে বের হচ্ছে বা বাচ্চাদের নিয়ে হাসি হাসি মুখে বেড়াতে যাচ্ছে। আম্মা অনেকবার স্ত্রীটিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে এভাবে চলতে থাকলে তোমার স্বামী তো তোমাকে যেকোনো সময় মেরে ফেলবে, তুমি বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছ না কেন? বা তুমি চাইলে কোনো নারী কল্যাণ সংস্থার সাথে আমরা যোগাযোগ করতে পারি, কিন্তু স্ত্রীটি কখনোই রাজি হয়নি। তখন ভীষণ অবাক লাগতো। এখন বুঝতে পারি সেই নারীটি আসলে ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম এ আক্রান্ত ছিল।
এই যে আমরা অনেক স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের ঘটনাগুলো শুনি সেগুলো কিন্তু হঠাৎ একদিন ঘটা কোনো ঘটনা নয়। খোঁজ নিলে দেখবেন দীর্ঘদিন ধরেই স্ত্রীটি স্বামীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল কিন্তু স্ত্রীটি তেমনভাবে প্রতিকারের চেষ্টা করেন নাই বা কিছু চেষ্টা করলেও আবার কিছুদিন পর স্বামীর ঘরে ফিরে এসেছে এবং নিয়মিত মার খেয়ে গেছে। সব ক্ষেত্রে স্ত্রীটির যে কোন যাবার জায়গা ছিলো না তা কিন্তু নয়, সে শুধু সাহস করে বের হয়ে আসতে পারে নাই বা আইনের সাহায্য নিতে পারে নাই। এরা সবাই আসলে ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম এর শিকার।
আসুন এবার তাহলে এই সিন্ড্রোমের ব্যাপারে আর একটু ভালো করে জানার চেষ্টা করি। ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম এবং একটি নিদৃষ্ট ধরণের ঘরোয়া নির্যাতন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিছু ভিন্নতা থাকলেও এ ধরণের নির্যাতন সাধারণত একটি নির্দিষ্ট চক্র অনুসরণ করে।
সম্পর্কের প্রাথমিক কিছুদিন ঠিকঠাক চললেও ধীরে ধীরে অ্যাবিউসার তার রূপ প্রকাশ করতে শুরু করে। শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার শুরু হয়। এটি প্রায়শই শুরু হয় ছোট আকারে। ছোটখাট চড়-থাপ্পড় বা স্ত্রীর পাশের দেয়ালে জোরে ঘুষি, লাত্থি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলা ইত্যাদি।
সাধারণত এসবের পর অত্যাচারী বা অ্যাবিউসার মাফ চায়, এবং সঙ্গীকে ভালোবাসার কথা বলে, উপহার দিয়ে শান্ত করে বা তার মন জয় করার চেষ্টা করে। এ সময় কখনো কখনো একটি মিনি হানিমুন পিরিয়ড থাকে। যথারীতি এতসব নাটকীয়তার পর স্ত্রী বা নারী সঙ্গীটি বিভ্রান্ত হয়, বিশ্বাস করতে শুরু করে সে নিরাপদ, তার সঙ্গী অনুশোচনায় ভুগছে এবং সে তার নির্যাতক সঙ্গীকে মাফ করে দেয়।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই চক্রটি আবার শুরু হয় এবং যত সম্পর্কের সময় বাড়তে থাকে অত্যাচারের পরিমাণও বাড়তে শুরু করে। নির্যাতক যথারীতি নানা রকম নাটক করে আবার মাফ পেয়ে যায়। এভাবে চক্রের ভেতর চলতে চলতে ধীরে ধীরে নারী সঙ্গীটি ব্যাটার্ড সিন্ড্রোম-এ ভুগতে শুরু করে। এ সময় যৌন নির্যাতনও শুরু হয়। জোর করে শারীরিক সম্পর্ক, শারীরিক নির্যাতনের পর যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা, সঙ্গীকে যন্ত্রণাময় যৌন সম্পর্কের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। সঙ্গীর প্রস্টিটিউট বা অন্য নারী গমনও থাকতে পারে এবং স্ত্রীটির এসব মেনে নিতে হয়।
কী করে আপনি বুঝতে পারবেন একজন ব্যক্তি বা আপনি ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোমে ভুগছেন?
– স্বামীর/পার্টনারের উগ্র মেজাজকে আড়াল করার বা জাস্টিফাই করার চেষ্টা। তার উপর হওয়া অত্যাচারের জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করা।
– প্রিয়জনদের কাছ থেকে তার উপর হওয়া অত্যাচারকে লুকানো। নানা অজুহাতে বন্ধুবান্ধব বা পারিবারিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলা।
– নিজের বা সন্তানদের জীবন/ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পাওয়া।
– অত্যাচারী স্বামী বা পার্টনারকে খুব বুদ্ধিমান মনে করা এবং তার কাছে নিজেকে প্রমান করার একটা অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
– স্বামী/পার্টনার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগা। দিনশেষে স্বামী/পার্টনারের ঘরে ফেরার সময় ভীত থাকা যে আজ সে তার কোন রূপ দেখবে – নির্যাতকের না প্রেমিকের।
– স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলেও তাদের হাতে টাকা পয়সা কম থাকা।
– স্বামী ছাড়া বাইরে কোথাও গেলে স্বামীর ঘন ঘন কল বা মেসেজ পাওয়া এবং অস্থির হওয়া। স্বামী/সঙ্গী আশেপাশে থাকলে উদ্বিগ্ন থাকা এবং সঙ্গীকে খুশি করার চেষ্টা করা।
– গায়ের আঘাতের চিহ্নের মিথ্যা ব্যাখ্যা দেয়া। হঠাৎ করে গা ঢাকা কাপড় পরার প্রবণতা বাড়া ।
সাধারণত বলা হয় ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম এর কয়েকটি স্তর থাকে-
ডিনায়্যাল বা অস্বীকার: অত্যাচার শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে ভুক্তভোগী তার সাথে হওয়া সহিংসতাকে অস্বীকার করতে চায়। ভাবতে চায় যে এরকম ঘটনা হয়তো আর হবে না বা এটা হয়তো অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এভাবে সে বিষয়টিকে জাস্টিফাই করতে চায়। আর এই সময় নির্যাতকের নানা ভনিতা করে মাফ চাওয়া ভুক্তভোগীর এই মনোভাবের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
অপরাধবোধ: সময় বাড়তে থাকে, অত্যাচারও বাড়তে থাকে। এই পর্যায়ে ভুক্তভোগী বিষয়টি মেনে নেয় কিন্তু ভাবতে শুরু করে যে তার উপর হওয়া সহিংসতার জন্য সেই দায়ী। এবং সে এক ধরণের অপরাধবোধ এবং লজ্জাবোধে ভুগতে শুরু করে।
নির্ভরশীলতা: অত্যাচার- মাফ চাওয়া- আবার অত্যাচার এই চক্র যখন নিয়মিত এবং ধারাবাহিকভাবে চলে শুরু করে তখন ভোক্তভুগী আত্মপ্রত্যয় হারাতে শুরু করে। অসহায়ত্ববোধ তাকে পেয়ে বসে এবং যত রাগ দুঃখ, অভিমানই হোক না কেন, নারীটি তার নির্যাতকেই তার সেভিয়ার বা ত্রাণকর্তা ভাবতে থাকে।
আত্মবিশ্বাসহীনতা: অত্যাচারের পরিমান বাড়তে থাকে, উপরে বর্ণিত চক্র ঘন ঘন হতে থাকে। একসময় নির্যাতক মাফ চাওয়াও বন্ধ করে দেয়। এই পর্যায়ে দীর্ঘ বিষন্নতায় আক্রান্ত নারীরা মানসিকভাবে এতটাই অসহায় বা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে যে তারা কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নেবার মত শক্তি হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘদিন শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতন করতে করতে নির্যাতকরা ভুক্তভোগীর মধ্যে একটা আতংক ঢুকিয়ে দেয় যে সে মনে করতে শুরু তার স্বামী বা সঙ্গী ছাড়া তার কোনো উপায় নেই এবং বাইরের পৃথিবীকে ফেইস করতে ভয় পায়। দুঃখজনকভাবে ভুক্তভোগীরা নির্যাতকের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
কেউ কেউ এতটাই ভীত এবং আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ে যে তারা তাদের সঙ্গীর অন্যায় আবদার মানাতে মানাতে তাদের অন্যায় ইচ্ছার সহায়ক হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম এর সবচেয়ে কুৎসিত একটা ঘটনা শুনেছিলাম যেখানে একজন স্ত্রী তার স্বামীর বিছানায় প্রতিরাতে তাদের কন্যাকে যেতে বাধ্য করতো।
গবেষণায় দেখা গেছে ভুক্তভোগীদের উপর ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম এবং ঘরোয়া নির্যাতনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে যা কয়েক দশক ধরে স্থায়ী হতে পারে।
তীব্র বিষন্নতা এবং মানসিক অস্থিরতাসহ PSTD (Post Traumatic Stress Disorder) এর লক্ষণ যার ভেতর থাকে দুঃস্বপ্ন, ফ্ল্যাশব্যাকস, শারীরিক অস্থিতিশীলতা, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ব্যাথা বা মাথা ব্যাথা, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। এছাড়া দীর্ঘদিন এই সিন্ড্রোম এর ভেতর থাকতে থাকতে, অত্যাচার সইতে সইতে, এবং তীব্র ঘৃণা চেপে রাখতে রাখতে ভুক্তভোগীর আরো একটি বিশাল মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে সেটা হলো- অত্যাচারী স্বামী বা পার্টনারের উপর ভয়াবহ হিংসাত্মক আক্রমণ। দীর্ঘদিন ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোমে ভোগা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের ঘটনা কিন্তু খুব কম নয়।
একটা কথা মনে রাখা দরকার যে আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ ব্যাটারড উইমেন সিনড্রোমের সাথে বাস করছেন, তবে জেনে রাখুন চিকিৎসার মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব এবং একটি সুন্দর জীবনযাপন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথম ভুক্তভোগীর দুটা জিনিস বুঝতে হবে-
নিজের ভেতর উপলন্ধি তৈরি হওয়া যে তার এরকম জঘন্য ব্যবহারের প্রাপ্য নয় এবং বুঝতে পারা যে তার সঙ্গী আসলে একজন অ্যাবিউসার বা অত্যাচারী ব্যক্তি। একবার অত্যাচার করার পর তার সঙ্গী যখন তাকে খুশি করার চেষ্টা করে বা মাফ চায় সেটাকে উপেক্ষা করার শক্তি অর্জন করা।
সঙ্গীকে দায়বদ্ধ করা তার কাজের জন্য। নিজের উপর হওয়া অত্যাচারের জন্য নিজেকে আর দায়ী মনে না করা, এবং সঙ্গীকে তার অ্যাকশনের জন্য দায়ী করা। সম্পর্কটি নিয়ে নতুন করে ভাবা এবং সম্পর্ক থেকে বের হবার জন্য বিকল্প পন্থা খোঁজা।
মনে রাখা দরকার এ ধরণের সম্পর্কে থেকে বের হয়ে আসা সহজ নয়। অত্যাচারী স্বামী বা পার্টনার তার শিকারকে এতো সহজে ছেড়ে দেয় না। এর জন্য পরিবার, বন্ধুবান্ধব, এবং আইনের সাহায্য লাগে। এছাড়া আপনি যদি আপনার চেনা কাউকে দেখেন এই সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তবে নিজে থেকেই তাকে সাহায্য করতে পারেন।
ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম এ আক্রান্ত নারীর চিকিৎসার প্রথম পদক্ষেপটি হলো নারীটিকে তার নির্যাতনকারী থেকে দূরে কোনো নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া। তার জন্য একটি সুরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করা। প্রয়োজনীয় শারীরিক এবং মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। সেইজন্য শারীরিক এবং মানসিক এই দু’ধরণের চিকিৎসকের সাথেই কনসাল্ট করতে হবে। নারীটিকে নানারকম ঔষুধ এবং থেরাপির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
তবে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা লাগে সেটা হলো তাকে ভালোবাসার পূর্ণ একটা পরিবেশ দেয়া। তার প্রতি সহমর্মী হওয়া, তাকে সাহস দেয়া। তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। চিকিৎসা এবং সেই সাথে ভালোবাসা আর সহমর্মিতাই পারে একজন ব্যাটার্ড উইমেন সিন্ড্রোম এ ভোগা ব্যক্তিকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এবং একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিতে।