November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

মূর্খ মেয়েমানুষ হিসেব বোঝে না

মনিরা সুলতানা মুন্নী।। ‘‘আপু আপনি বিয়ে করেন না কেন? একটা মনের মানুষ খুঁজে নিলে তো পারেন?’’

‘‘কী কারণে?’’

‘‘এতো কষ্ট করছেন, একটা বিয়ে করে স্বামীর ঘরে গিয়ে শান্তিতে থাকবেন। এতো দৌঁড় ঝাপ, পরিশ্রম, দুশ্চিন্তার কী দরকার, আমাকে দেখেন না, একটা কাঁচা ঝাল কিনতেও আমাকে ভাবতে হয় না।’’

আপনি একা আছেন বিয়ে করছেন না, এর জন্য আপনার বয়সের দশ বছরের ছোট থেকে শুরু করে এই সমাজের যে কেউ আপনাকে এসব কথা শোনানোর অধিকার রাখে। আবার ‘আহা, ইশ’ বিশেষণ সহকারে শ্লেষাত্মক মন্তব্যও  আপনাকে দাঁত চেপে গিলতে হবে।

তোমার বর তোমাকে ননীর পুতুল করে রেখেছে সংসারের তেলটা, নুনটা, কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে অর্থসম্পদের হিসেবও তোমার মাথা ঘামানোর বিষয় না। আবার ধরো সারাদিনের কোনো সময় কী রান্না হবে সেটাও ঠিক করে দেবে তোমার স্বামী। কিন্তু সংসারে তোমার প্রয়োজন আসলে কী? তোমার নিজেকে মনে হয় না অকেজো অপ্রয়োজনীয় একটা শো পিস? তুমি এতেই নিজেকে সুখি ভাবো, তাই বলে সবাই তোমার মতো ভাববে?

একটা মেয়ের জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই শুনতে হবে-
আল্লাহর দান তিনি যা ভালো বুঝেছে তাই দিয়েছে।
এখনকার যুগে আর ছেলে আর মেয়েতে পার্থক্য কই? সবই সমান!
আরে ভাই ছেলে আর মেয়ে আলাদা নয়, মানুষের মতো করে মানুষ করলে সবই সমান।
ভাই ভালোই তো হয়েছে মেয়েদের ছেলেদের থেকে বাবা মায়ের প্রতি দরদ বেশি।
সবই ভালো কিন্তু বংশ রক্ষা করতে ছেলে দরকার।

সাদা কালোর কথা বাদ থাক।

এবার যখন সময় হবে স্কুলে ভর্তির, স্কুলের প্রথম প্রশ্ন হবে বাবার নাম কী এবং বাবা কী করে? এ দিয়েই নির্ধারণ হবে তার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে।

এরপর অমুকের মেয়ে, অমুকের বোন, অমুকের মা, স্বামী মারা গেলে পরিচয় হবে বিধবা, ডিভোর্স হলে নাম হবে স্বামী পরিত্যক্তা। মানুষ আর হবে কেন? মেয়েরা কি মানুষের পর্যায়ে পড়ে? ধুর, যে কিনা এক ফালি কাঁচা ঝালের বনন্দোবস্ত করতে পারে না সে আবার মানুষ!

একজনকে চিনতাম মাত্র ষোল বছর বয়সে বিয়ে করে স্বামীর মন রাখতে সন্তান নেয়ার কথা মুখে আনতো না, এভাবে চলতে চলতে একটা সময় সে সন্তান ধারণ ক্ষমতা হারালো, তখন স্বামীশ্বরের সন্তানের খেয়াল জাগলো, সন্তান না থাকলে লোকে কী বলে? কি আর করা, সন্তান ধারণের অক্ষমতার দায়, সন্তানহীনতার কষ্ট, অন্যের কটাক্ষ, এসব সহ্য করার সঙ্গী হিসেবে সে শুধু সাথে পেল শুন্য ঘরের চারটি দেয়াল। স্বামীশ্বর তখন পৃথিবীতে নতুন এক প্রাণ সৃষ্টির মহাযজ্ঞে ব্যস্ত।

একটা বন্ধু ছিল ভালোবাসার মানুষের সাথে ঘর বাঁধতে সাত সাগর তের নদী পার করে এসেছিল, সন্তানসম্ভাবা বন্ধুটি স্বামীকে একটু কাছে পেতে ছিল মরিয়া, কিন্তু তার আর্তনাদ তার স্বামীর কর্ণগুহার প্রবেশদারে আঘাত পেয়ে সটান আছড়ে পড়তো তারই বুকে।

পাশের বাড়ির এক বউ ছিল একটু সরল কম বুদ্ধির, সারাদিনের শেষে স্বামী কড়া হিসেব কষে নিত্য চাল-ডাল আনাজপাতির একটা সম্ভব্য হিসেবের টাকা তার হাতে দিতো, প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে সে সেটা সানন্দে নিয়ে বেলা শেষে চাল তরকারি কিনে রান্না করতো। পরদিন আবার দিনশেষে সেই হিসেব সেই রান্না সেই নিয়ম, মাথায় তেল দেয়ার দরকার হলে এসে বলতো, মুন্নী আপা একটু তেল দাওনা মাথাটা খুব ব্যাথা করছে, আবার কখনো এসে বলতো একটা রসুন দাওনা নিরামিষ তরকারি রসুন দিয়ে কড়া করে বাগার দিলে ছেলেমেয়েগুলো আগ্রহে নিয়ে খাবে। কাপড় কাঁচার পরে ডিটারজেন্ট মেশানো পানির চাহিদা ছিল তার কাছে অমূল্য। রান্নার জন্য কেটে নেয়া তরকারির অবশিষ্ট কখনো দরাজ হাতে ফেলতো না মা, কারণ সেখানেও কেউ পেতে পারে দরকারি কিছু, কখনো কখনো রান্নাঘর থেকে লবন, পেঁয়াজ, রান্নার কাঠ চুরি হতেও দেখেছি আড়াল থেকে। খাবার খেতে বসেছি, হঠাৎ খাবারের প্লেট ছিনতাই হয়েছে অনেকবার, খিদে সংবরণ আয়ত্ব করতে থাকা নিষ্পাপ শিশুর মুখে তাকিয়ে দু ফোঁটা নিস্ক্রিয় জলও হয়তো গড়িয়েছে, কখনো বিরক্তিও হয়তো ফুটেছে একই চোখে, কোথাও যাওয়ার জন্য ধার করা ওরনাই ছিলো বউটির সম্বল। কিন্তু বাপের বাড়ির সম্পত্তির সবটাই চলে যেতো স্বামীর হিসেবের খাতায়, কারণ সে মূর্খ মেয়েমানুষ, হিসেব বোঝে না।

যাই হোক এই বৃত্তে আপনি আবদ্ধ হতে যদি না চান তাহলে আপনার কপালে সমূহ দূর্যোগ। যেমন ধরেন, আপনি লেখাপড়া শিখে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে চান, তাহলে আপনাকে মনে রাখতে হবে, এই সমাজ নারীর হাতে ক্ষমতা মেনে নিতে পারে না।
আপনি কাজে ভুল করবেন আপনাকে তর্জনির খোঁচায় বুঝিয়ে দেবে স্বামীর সংসারে ছাই যোগে হাঁড়ি মাজার ফজিলত।
আড্ডার এক ফাঁকে আপনি শুনতে পাবেন অল্প বয়সে বিয়ে করে স্বামীর ঘরে যাওয়া কতোটা উচিৎ তার সূক্ষ হিসেব। এবং বয়স বেশি হয়ে বিয়ে না হলে যে কপাল চাপড়াতে হবে তার নমুনা। বেশ কিছু উদাহরণও এড়াতে পারবেন না।
চায়ের আড্ডায় আপনি খবরের হেডলাইন নিয়ে আলোচনার অধিকার রাখেন না, কারন আপনার এ সময় হাড়ির চালের হিসেব করতে হবে।
বলতে শুনবেন, নারীরা কর্মক্ষেত্রে এসে পুরুষের কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার মতো নিদারুণ কষ্টের বর্ণনা। কর্মক্ষেত্রে নারী হিসেবে বেশি সুবিধা পেলে শুনতে হবে ব্যাঙ্গাত্মক বাক্য। একা স্বাধীন চলতে থাকা নারী সমাজের চোখে নিকৃষ্ট। নারীকে হেয় করার জন্য সমাজ তার চরিত্রের ময়না তদন্তে সর্বদা প্রফুল্ল। অভিনব কায়দায় মানুষ জেনে যাবে আপনি কার সাথে কোথায় একা ঘুরতে গিয়েছেন, সেখানে কী কী করেছেন, এসবের কিছুই অনেক সময় আপনি নিজেই জানবেন না। ডিভোর্সি হয়ে বিয়ে করবেন তাহলে মনে রাখবেন আপনি সর্বদা গসিপের বিষয় হিসেবে সুপারস্টার। এবং আশেপাশে বেশ কিছু মানুষ থাকবে, তাদের কাজ হবে আপনার ভুলগুলোর বিবরণ আপনার পরিচিত মহলে বিশদ আকারে দেয়া। আপনার কী করা উচিৎ, কী করা অনুচিত তা আপনার থেকে ভালো বুঝবে আপনার আশেপাশের মানুষ। উচ্চস্বরে কথা বললে ধর্মের বাণী শোনাবে না এমন দুএকজন পাবেন না, তা অসম্ভব।
স্বামী আপনাকে সমীহ করে বলে ভাবছেন বেঁচে গিয়েছেন, একদমই না, বরং আপনি জানতে পারবেন কী মহিমায় স্বামী বস করেছেন তার ফর্দ।

এতো কিছুর পরও নারী তার ক্ষমতা দেখাচ্ছে, সফলতার প্রমাণও সমাজেই আছে তার জন্য নারীকে হারাতে হচ্ছে অনেক কিছু, একজন পুরুষ হাঁটছে ঝা চকচকে মসৃণ রাস্তায় আর নারী পায়ে পায়ে সরাচ্ছে দুর্ভেদ্য জঞ্জাল, তবুও নারী সফল হও, এগিয়ে যাও নিজের পরিচয় অর্জনে, প্রতিষ্ঠা করো নারী পুরুষের আসল সমতা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]