ধর্ষণ কি তবে উদযাপনে পরিণত হয়েছে ?
কাজী নুসরাত শরমীন।। রেইন ট্রি হোটেলে জন্মদিনের আয়োজনে ডেকে এক প্রথিতযশা জুয়েলারী মালিক পুত্রের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা খুব আলোচিত হয়েছিলো। মামলা হয়েছে, তাদের ধরাও হয়েছে। তাদের পক্ষে মামলা লড়েছেন এক স্বনামধন্য আইনজীবী। কিছুদিন আগের ঘটনা, যেখানে সেই ধর্ষকদের শুধু জামিন নয়, বিদেশ যেতেও বাধা না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। এটি একটি উদাহরণ মাত্র।
গত ১৫ জানুয়ারি রাতে শ্রীপুরের নয়নপুর এলাকায় জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এসে এক কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হন। এরপর ধর্ষক ও তার বন্ধুরা মিলে ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল করে । ধর্ষক লাইভে এসে উল্লাসে বলে, ‘হাই ফ্রেন্ডস কাল হয়তো আমরা জেলে থাকতে পারি।’
ধর্ষণ কি তাহলে উদযাপনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে ?
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২জন৷ অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি৷ ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী৷
২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে৷ আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০জন নারী৷ (সূত্র : ডয়েচে ভেলে)
গত জাতীয় নির্বাচনে নোয়াখালির সুবর্ণচরে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়েছেন বলে একজন নারী গণধর্ষণের শিকার হন।মাত্র কয়েকদিনের মাথায়, রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিদের ‘অসাবধানতায়” ধর্ষক জামিন পায়। এখানে মাত্র দুটো উদাহরণ । যারা মামলা পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। ধর্ষণের অপরাধে মামলা করার পার্সেন্টেজ খুবই নগন্য। সেখানেও রয়েছে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা। থানার চরম অসহযোগিতার চিত্র আমারা দেখেছি ফুলগায়ের সোনাগাজীতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের যৌননিগ্রহ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার নুসরাতের মামলায়।এহেন কুকর্মে জড়িত ছিলো থানার ওসি স্বয়ং।
সবচেয়ে অবাক বিষয় এই যে, ধর্ষণের অপরাধ জামিনযোগ্য নয়। তবু প্রভাবশালী থেকে শুরু করে যে কেউ জামিন পেয়ে যাচ্ছে আইনের ফাঁক গলে। ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণে একজন নারীকে চরম অবমাননাকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সামাজিকভাবে, আদালতের ভরা মজলিশে ধর্ষণের ভয়াবহ অভিজ্ঞার শিকার একজন নারীকে মৌখিকভাবে আরও বহুবার ধর্ষণের শিকার হতে হয়। খুঁটে খুঁটে বর্নণা করতে হয় তিনি ‘কেমন করে’ ‘কতবার’ ‘কতজন’ দিনক্ষণ ও তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বিবেচনায় আসে না তার মানসিক, সামাজিক বিপন্নতা। আদালতে এই ধরণের মামলায় নারীর প্রতি সহনশীল পরিবেশ থাকে না।
ভাবনার বিষয় এইখানে যে, কোনো একটি বিশেষ অপরাধের গতি প্রকৃতি যখন ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে, তখন সে অপরাধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইণপ্রণেতারা বিশেষভাবে নজরদারী করবেন, আইনের দুর্বলতা ঘোচানোর চেষ্টা করবেন সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। সবই চায় শাস্তির বিধান কঠোরতর হবে, মামলার দীর্ঘসূত্রতার ক্ষেত্রে সময় কমিয়ে এনে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করবেন, ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রনয়ণ করবেন, এমনটাই তো আইনণপ্রণেতার কাজ, বা জনগণেরও প্রত্যাশা।
কিন্তু কার্যত আমরা কি দেখছি? আমাদের বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ সংসদ সদস্যগণ আইন প্রনয়ণের আঁতুড় ঘর ওই সংসদে বসে ক্রসফায়ারেই সমাধান খুঁজছেন ! মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, সেই নারীদের নিরাপত্তায় ধর্ষণের মতো অপরাধ ঠেকাতে ক্রসফায়ারের কাছে আমাদের অসহায় আত্মসমর্পণ।
ধর্ষণের আপরাধ যেহেতু ক্রমবর্ধমান ও ভায়াবহভাবে নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তাই আজ দাবি উঠেছে, ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণে শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আইন ও বিচার ব্যবস্থা তো আর আবেগে চলে না। মৃত্যুদণ্ড চাইতে হলে, আগে তো আইনের সংস্কার করতে হবে। যেখানে আইনেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের দাবি তো খুবই দুর্বল চাওয়া এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলায় ৪ হাজার ৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচ জনের!
তাই মৃত্যুদণ্ডের জন্য এই অরণ্যে রোদন নিজের চাওয়ার প্রতি প্রহসন। মান্ধাতার আমলের এই আইনগুলো শুধু দুর্বলই নয়, নারীর প্রতি অবমাননাকর শব্দেও ভরপুর। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ দিয়ে ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়া এই ধর্ষণের মতো অপরাধ দমন সম্ভব নয়। ক্রসফায়ারই যদি সমাধান হয়, তাহলে আইন প্রণেতারা সংসদে বসে কী করবেন? ক্রসফায়ার আসলে কী? সাধারণত আমরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্রিফিংয়ে ক্রসফায়ারের যে বর্ণনা শুনি, তা তো আসলে অনিচ্ছাকৃত কিন্তু অপারগ হয়ে গুলি করতে বাধ্য হওয়া। তাই নয় কি? কিন্তু বাস্তবতা হাঁটছে উল্টো পথে। ক্রসফায়ার আসলে যে ক্রসফায়ার নয়, এটা যে আমাদের দেশে বিচার বহির্ভূত পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, সে কথা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। নইলে আমজনতা নাকডোবা দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণের মতো দুরাচার এর হাত থেকে রেহাই পেতে ক্রসফায়ার এর দাবি জানায় কেনো ??
সবাই কিন্তু আবার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থনও করেন না। এক্ষেত্রেও আমার একটা পর্যবেক্ষণ আছে, আমাদের দেশেও কেউ কেউ মৃত্যুদণ্ডকে শাস্তি হিসেবে অমানবিক মনে করেন। উন্নত দেশগুলোতেও আজকাল মৃত্যুদণ্ডকে উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমার দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে অপরাধপ্রবণতা উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনার বিচারে ভয়াবহ। এক বছরের ব্যবধানে ধর্ষণের দ্বিগুণ সংখ্যাটা তাই অ্যালার্মিং। শিশু ধর্ষণের বিভৎসতা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এতোটা আছে বলে আমার জানা নেই। তাই আইন সংস্কার করে ধর্ষণকারীকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই আমাদের।
গত ১৮’র তুলনায় ১৯’এ যে ধর্ষণের ঘটনা দ্বিগুন হলো, তাতে কি এমন এলোগেলো ? যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার আমার ঘর আক্রান্ত না হচ্ছে ততক্ষণ পৃথিবী গোল্লায় যাক, আমার কি ? এমন উন্নাসিকতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এই যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ ধর্ষণের বিচার চলছে, এই আইনে বিচারের প্রেক্ষাপট কি দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের সাথে যায় এখনো? এর সেকশন ৯ যদি দেখি, দুনিয়ার অথবা যোগ করে আইনটিকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণের পর শাস্তির বিধানে আইনটিতে এতো ‘অথবা’ কেন ? কেন ধর্ষণের শাস্তি ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নয় ? সেই সাথে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকতে হবে। এই যে হবে হবে করে আমরা আর কতো চিৎকার করবো ? ধর্ষণ জামিনযোগ্য নয়, তবু বিশেষ বিবেচনায় রয়েছে জামিনের সুযোগও। এই ‘বিশেষ’ ও ‘অথবা’ই এই দেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে অন্তরায় । ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি একটাই, সেটা মৃত্যুদণ্ড । এই বাস্তবতা মনে মগজে ঢোকাতে আর কত সময় চাই ?
সম্প্রতি ঢাবির শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে ঢাবি প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে, কিন্তু কবে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে নেমেছে ? রোজকার ধর্ষণের ঘটনা আমজনতার বলে সবসময় ধর্ষণের ঘটনায় আমাদের প্রতিবাদী চরিত্র জ্বলে ওঠে না । সর্বত্র কেবল দাসবৃত্তি আর চাটুকারিতা। ছাত্র নেতাদেরও এই বিষয়ে কোনো ভূমিকা নেই। এই অর্বাচীনের দল বোঝে না, ধর্ষণের প্রতিরোধ করা গেলে, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও একটি দেশের সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। আর সেটি প্রত্যক্ষভাবেই ক্ষমতায় থাকা দলটির সাফল্য। এটা টেন্ডারবাজি ও শাড়ি ভাগাভাগির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সবসময় জনগুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে জনগণের পাশে থাকা যে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অবশ্য কর্তব্য, সেই রাজনৈতিক শিক্ষাই এদেশের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেই।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধের আর কোনো উপায় নেই, সেই সাথে চাই আইনের সংস্কার । ধর্ষণের শাস্তি একটাই, সেটা মৃত্যুদণ্ড । এর কোনো বিকল্প আসলে নাই।
কাজী নুসরাত শরমীন: লেখক ও সাংবাদিক
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]