সময়ের আগে ঋতুবন্ধ – কোনো পরাজয়ের গল্প নয়
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী।। চল্লিশের কোঠায় পৌঁছে যখন নিজের স্বাধীনচেতা ও আত্মবিশ্বাসী সত্তাকে উপভোগ করতে শুরু করি তখন থেকেই খেয়াল করলাম অনিয়মিত পিরিয়ডের বিষয়টা।
৩৮ থেকে ৪৩ – এই পাঁচ বছরে ব্যক্তিগত জীবনে পরপর হারালাম বড় বোন, মা এবং বাবাকে। স্নেহময় আশ্রয়ের কিছুই অবশিষ্ট রইলো না বলা যায়। জীবনসঙ্গী বেঁচে ফিরলো মৃত্যুর দুয়ার থেকে, এখনো চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চলছে তার দৈনন্দিন।
প্রবল কোন ঝড় বারবার আমার দরজায় আঘাত হানছিল। মনোবল হারাইনি, দায়িত্বে অবহেলা করিনি, জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে নিজেকে শান্ত রেখে। পারিপার্শ্বিকতার সাথে অবিরাম লড়াই করে চলেছি তবু মন ও শরীর যে গভীর শোক ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে তা অপূরণীয়। ঠিক এরকম একটি পরিস্থিতিতে এসে বছর দুয়েক হলো নিজের শরীর ও মনে পরিবর্তনের লক্ষণগুলো প্রকট হতে শুরু করলো।
প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য করলাম, কখনো কখনো পিরিয়ডের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশিমাত্রায় রক্তস্রাব হওয়া, অনিয়মিত পিরিয়ড, এরপর একটানা ঋতুচক্র বন্ধ থাকা। স্বাভাবিক কাজকর্মের সময় বা ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে ঘামতে থাকা, পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসা। ক্লান্তিবোধ, মুড সুইং তো আছেই। সম্প্রতি এগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে চোখে কিছুটা ঝাপসা দেখা এবং ঘন ঘন হট ফ্ল্যাশ। মেনোপজ সম্পর্কে জানা থাকলেও আরলি মেনোপজের প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পাইনি, কঠিন এক বাস্তবতা পাড়ি দেবার মাঝে সন্তর্পণে তা ঢুকে পড়েছে আমার ভেতর। আমার জন্য খুব সহজ ছিল না সকল দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে কেবল নিজের প্রতি যত্নবান হওয়া, আমি নিশ্চিত বহু নারীর ক্ষেত্রেই তাই। নতুন যে উপসর্গ ও অভিজ্ঞতায় পা রাখলাম তার মধ্যে ভয়ংকরতম হলো “হট ফ্ল্যাশ” – আচমকা যেন আগুনের হল্কা বিদ্যুৎগতিতে ছড়াতে থাকে শরীর থেকে মাথা অব্দি – মাথা দুলতে থাকে অথবা সামনে যা থাকে তাই ঘূর্ণি খেতে থাকে। এমন হলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া এড়াতে আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি অথবা দ্রুত বসে পড়ি। স্থায়িত্বকাল কয়েক মুহূর্ত হলেও হট ফ্ল্যাশের আকস্মিকতা এবং তীব্রতায় দিগ্বিদিক শূন্য লাগে।
কিছুদিন আগে এক বন্ধুর বাড়িতে গেলে সে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? আরলি মেনোপজের সময় অতিক্রম করছি জানাতেই চমৎকার হাসি দিয়ে সমবয়সী বন্ধুটি অভিনন্দন জানালো। দ্বিধাহীনভাবে এও জানালো যে, সে নিজেও একই অভিজ্ঞতা পার করছে। নিজেদের কথাগুলো ভাগাভাগির সময় আমরা আমাদের মায়েদের কথা বা তাঁদের মায়েদের কথা ভাবছিলাম। সংসারের বিবিধ দায়দায়িত্বের ভারে আমাদের মায়েরা কে কখন হট ফ্ল্যাশ ও অন্যান্য উপসর্গে জর্জরিত মেনোপজ কিংবা আরলি মেনোপজের ধকল সামলেছে, কেউ কি তার খবর রেখেছে? এখনকার সময়ও সবাই যে এসব বিষয়কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তাও নয়। বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে নারীর মাতৃত্বকালীন যত্ন, প্রসূতি মায়েদের বিষণ্ণতায় ভোগা সময় “ব্লুজ” এর মতো বিষয় যেখানে আজো গুরুত্ব পায় না ঠিকঠাক সেখানে অশিক্ষায় ভরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে “মেনোপজ” মানে নারীর বুড়িয়ে যাওয়া তো বটেই এক কথায় সব শেষ হয়ে যাওয়া অর্থাৎ “বাতিল” হয়ে যাওয়া। সেই হিসেবে “আরলি মেনোপজ” এর মতো ব্যাপারটা হজম করার মতো শিক্ষা আশা করা বোধ করি এখনো বহুদূরের পথ। বিশেষত সন্তানহীন / সন্তান নেবার ইচ্ছে থাকা কোনো নারীর পারিবারিক ও সামাজিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পড়ে সময়ের আগেই ঋতুবন্ধে।
অনলাইনে সদা সক্রিয় সাইবার অপরাধী গ্যাং-এর সদস্যকূল ঋতুবন্ধ হওয়াকে নিকৃষ্ট ঘটনা হিসেবে মনে করে। তাদের ধারণা, মেনোপজ মানে নারীর যৌন অক্ষমতা আর মেনোপজের চেয়ে লজ্জাজনক, অবমাননাকর ঘটনা দ্বিতীয়টি নেই। নারীর ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতা, সফলতা আর অর্জনকে ঘায়েল করতে এই সকল বীরপুঙ্গবের মোক্ষম হাতিয়ার হলো তার মেনোপজের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরা। জ্যামিতির উপপাদ্যের মতো প্রমাণ করে ছাড়বে – যেহেতু ওই নারীর ঋতুবন্ধ হয়ে গেছে সেহেতু সে বাতিল এবং পরিত্যক্ত। অতএব তার কথা, লেখা, কর্ম, উপার্জন, যোগ্যতা যাই থাকুক – কোনো কিছুরই মূল্য নেই।
যে সমাজ নারীর দেহাবয়ব, পোশাক, অন্তর্বাসের ফিতা, থেকে শুরু করে ঋতুচক্র, স্যানিটারি প্যাড, শিশু সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো পর্যন্ত সব কিছুতেই পর্ণোগ্রাফির বিকৃত সুখ খুঁজে পায়, মেনোপজের ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে স্বাভাবিক আচরণ আশা করা যায় কি?
ঋতুবন্ধ / অকাল ঋতুবন্ধ কোনো রোগ নয়, অপরাধও নয়। ঋতুবন্ধ হলে নারীর জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়ে না, শেষ হয়ে যায় না, বাতিল হয় না – যেমন শেষ হয় না বিয়ে/ ডিভোর্স হলে/ না হলে, বাচ্চা হলে/না হলে, কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক হলে, ধর্ষণের শিকার হলে। এই বিশ্বাস নারীকেই আত্মস্থ করতে হবে।
নারীর জীবনে বয়ঃসন্ধিতে ঋতুচক্র শুরুর মতো পঁয়তাল্লিশোর্ধ বয়সে মেনোপজ বা ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়াটা সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বয়সের সাথে সাথে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যায়। স্বাভাবিক নিয়মেই ডিম্বাশয়ে ডিম নিঃসরণ বন্ধ হয়ে সন্তান ধারণের ক্ষমতা ফুরিয়ে যায়। হঠাৎ পরিবর্তনে শরীর ও মনে কিছু সাময়িক উপসর্গ দেখা দেয় যা সময়ের সাথে প্রাকৃতিকভাবে মানিয়েও নেয় আমাদের শরীর ও মন।
মেনোপজ নিয়ে প্রথম ধারণা পেয়েছিলাম বহু বছর আগে অপর্ণা সেন সম্পাদিত সানন্দা পত্রিকায়। এরপর এ সংক্রান্ত বেশ কিছু লেখা পড়লেও নতুনভাবে পড়লাম যে, যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা অনুযায়ী মেনোপজের গড় বয়স ৫১ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে চল্লিশের আগেই দেখা দিতে পারে মেনোপজের লক্ষণ। কারণ হিসেবে রয়েছে, ডিম্বাশয়ের অপারেশন, কেমোথেরাপির প্রভাব, জিনগত কারণ, অতিরিক্ত মেদ, হাইপো থাইরয়েডের প্রভাব, ধূমপানের অভ্যাস ইত্যাদি। এমনকি অতিরিক্ত স্ট্রেস বা মানসিক চাপেও হতে পারে আরলি মেনোপজ। মোটামুটিভাবে আরলি মেনোপজ ও স্বাভাবিক মেনোপজের লক্ষণগুলো একইরকম – অনিয়মিত ঋতুচক্র, হট ফ্ল্যাশ, অস্বাভাবিক ঘাম।
ক্ষেত্র বিশেষে এগুলোর পাশাপাশি দেখা দিতে পারে নিদ্রাহীনতা, যোনির শুষ্কতা (Vaginal dryness), মূত্রাশয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়া (loss of bladder control), চোখ ও ত্বকের শুষ্কতা, যৌন ইচ্ছায় পরিবর্তন, অস্বস্তি ইত্যাদি। মানসিকভাবে বলা যায়, বিষণ্ণতা ও অবসাদ পেয়ে বসতে পারে। ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে। বাড়তে পারে মেজাজ হারানোর প্রবণতাও। এসময় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা একটা চ্যালেঞ্জ বলা চলে।
মেনোপজ প্রাকৃতিক হলেও আরলি মেনোপজকে ঝুঁকিমুক্ত ভাবার অবকাশ নেই। অস্টিওপোরোসিস এবং
হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে সময়ের আগেই ঋতুবন্ধ।
আমি বিশেষজ্ঞ নই। আরলি মেনোপজের কারণ, উপসর্গ, লক্ষণ ছাড়াও শরীর ও মনের এ পরিবর্তনের সময় কেমন হওয়া উচিৎ খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম ও জীবনপদ্ধতি, কীভাবে স্বাভাবিক রাখা সম্ভব দাম্পত্য বা শারীরিক সম্পর্ক, কেমন করে ভালো রাখা যায় নিজেকে – ল্যাপটপ বা ফোনের বোতাম চেপে মেনোপজ/ আরলি মেনোপজ লিখলেই বিশেষজ্ঞ মতামত সমেত জানা যাবে আদ্যোপান্ত।
চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলার পাশাপাশি এই নিয়ে একটু আধটু জেনে নেবার চেষ্টা করছি। আমার ক্ষেত্রে একাধিক ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়ায় নিয়ম মেনে ভিটামিন ক্যাপস্যুল খেতে হচ্ছে। নিজেকে ভালো রাখার জন্য নিয়ম মেনে খাওয়াদাওয়া, ঘুম, হাঁটা এবং প্রচুর পানি পানের অভ্যাস করার চেষ্টা করছি।
আর অতি অবশ্যই শুরু থেকেই আমার জীবনসঙ্গী এবং সন্তানদেরকে অবহিত করেছি আমার শরীর এবং মনের ওপর দিয়ে ঘটে চলা এই নতুন অভিজ্ঞতার কথা যাতে তারা এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে পারে, আমাদের পথ চলাটা সহজ হয়। যতোটা সম্ভব নিজেকে সময় দিচ্ছি, ভালো বই, সিনেমা, গান, ছবি আঁকা ও দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত রাখছি নিজেকে।
ঋতুবন্ধ প্রত্যেক নারীর জীবনে অবধারিত এক শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সময়ের আগে ঋতুবন্ধ হওয়া কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়, পরাজয় নয়। কোনো লজ্জা, ভয়, সংকোচ নয়। ট্যাবু ভেঙে আসুন, আমাদের গল্পগুলো আমরাই লিখি। Yes, We Girls Bleed and We do have Menopause / Early Menopause.