November 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

বর্ণ বৈষম্য ও নারী-পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অমানবিক চর্চা

তৌকির ইসলাম ।। বর্ণ বৈষম্যের কথা আসলেই আমাদের মনে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ভেসে আসে। আমাদের মনে উঁকি দেয় আফ্রিকা। কিন্তু যদি উপমহাদেশীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা লক্ষ্য করি তবে দেখবো যে বর্ণ বৈষম্য এখানে চরম আকার ধারণ করেছে এবং এর প্রধান ভিক্টিম হচ্ছে নারী।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারী তার জন্মের পর থেকেই বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়। একে তো নারীর জন্মকেই এখানে স্বাগত জানানো হয় না, তার উপর বর্ণ বৈষম্য। গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়া টাইপ অবস্থা। মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, নারীর প্রতি ভোগবাদী মনোভাব, নারীকে মানুষ জ্ঞান না করে পুরুষের সম্পত্তি ভাবা এই বর্ণ বৈষম্যের প্রধান কারণ।

একটি মেয়ে শিশু জন্মের পর শুরু হয় তার গায়ের রঙের বিচার, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে নোংরা বিশ্লেষণ। কেননা মেয়ের বাবার চিন্তায় তখন থেকেই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বড় অংশ দখল করে আছে। বিয়ের বাজারে মেয়ের মূল্য নির্ধারণের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত মেয়ে শিশুর পরিবার তাকে স্বাগতম জানাবে কীভাবে! আর এটাই এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি বর্ণ বৈষম্যের চরম নিদর্শন। এখন একটু একটু করে সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে কিন্তু তা আশানুরূপ নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি বর্ণ বৈষম্য কী পরিমাণ তার আরো একটি উদাহরণ হচ্ছে মা যদি ফর্সা না হন তবে গর্ভকালীন সময়ে তাকে বেশি করে ফলমূল খাওয়ানো হয় যেন বাচ্চাটা অন্তত যেন ফর্সা হয়। তা বাবার গায়ের বর্ণ যাই হোক না কেন! আবার পুরুষের গায়ের বর্ণ যদি কালো হয় তাহলে তিনি খুঁজতে থাকেন ফর্সা মেয়ে কারণ তাহলে বাচ্চা হবে ফর্সা। এই একই ব্যাপার লক্ষ্য করা যাবে উচ্চতা, সৌন্দর্য সব কিছু নিয়েই। নারীর প্রতি এই বর্ণ বৈষম্য কি কোনো অংশে যুক্তরাষ্ট্রীয় রেসিজমের তুলনায় কম!

সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই বৈষম্য চোখে পড়ার মত। স্কুল কলেজের অনুষ্ঠানেও ফর্সা ছাত্রীর গুরুত্ব একটু বেশি। কারণ আমরা এখনো নারীকে মানুষ ভাবতে শিখি নি, শিখেছি পুতুল ভাবতে। আমাদের নারীদের একটি বড় অংশ ব্যস্ত কীভাবে নিজেকে সুন্দর দেখায়, কীভাবে নিজের মেয়েকে সুন্দর দেখায় এই চিন্তা নিয়ে। নারী যখন নিজেকে এই বৈষম্যে দেখতে পায় তখন সে নিজেও মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। সে নিজেও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে। কারণ সে বুঝে যায় সমাজ তাকে তার যোগ্যতা নয়, বর্ণ দিয়ে মাপছে। বর্ণ বৈষম্য এতটাই নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে যে কোনো সম্পর্ক নষ্ট হলেও সে দায়ী করে তার নিজের তথাকথিক কমতিকে। প্রকৃত অর্থে নারীর প্রতি বর্ণ বৈষম্য লালিত হয় নিজ পরিবারেই। ফর্সা মেয়েটিকে বাইরে বের হতে দিতে চাইবে না গায়ের রঙ নষ্ট হবে আর ফর্সা নয় এমন মেয়েকে বাইরে বের হতে দিতে চাইবে না সে আরও শ্যাম বর্ণের হয়ে যাবে বলে। পরিবার কিন্তু সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি নিয়ে চিন্তিত নয়।

আসলে বর্ণ বৈষম্য আফ্রিকার জনগোষ্ঠীকে শারীরিক দাসত্ব দিয়েছিল আর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছিল। কিন্তু নারীর প্রতি এই বর্ণ বৈষম্য নারীকে শারীরিক-মানসিক, যোগ্যতা দক্ষতা সব ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত করেছে। আর তাই তো আমরা অনলাইনে বিভিন্ন আপু অথবা দিদিকে ফর্সা হওয়ার সামগ্রী নিয়ে দেখতে পাই। বড় বড় কোম্পানির ক্রিমের বিজ্ঞাপনে টেলিভিশনও ক্লান্ত।

নারীর প্রতি এই বর্ণ বৈষম্য নারীর প্রতি অনেক অত্যাচারের কারণও বটে। একে তো বর্ণ বৈষম্য নিজেই একটা সামাজিক অত্যাচার। অন্যদিকে একজন নারী শুধুমাত্র শারীরিক বর্ণ কিংবা গঠন প্রকৃতির কারণে পারিবারিক বঞ্চনার শিকার হোন, মানসিক নির্যাতনের শিকার হোন জন্মের পর থেকেই। শুধু নারী নিজে নয়, নারীর পরিবারও কম মানসিক নির্যাতনের শিকার হন না। এমনকি একজন নারী কর্তৃক অন্য নারী বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন।

পুরুষ যে বর্ণ বৈষম্যের শিকার একেবারেই হন না তা নয়। কিন্তু পুরুষের সব কিছু ঢাকা পড়ে যায় তার ভালো আয়-উপার্জনের আড়ালে। আর নারী যতই যোগ্য হোন না কেন তার সৌন্দর্য, গাত্র বর্ণ সবার আগে বিবেচনা করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার এ এক চরম নিদর্শন। নারী বললেই আমরা কোমল, নরম, পরিপাটি একটু দুর্বল কিছু ভাবি, যাকে নিয়ে একটু পুতুলের মত খেলা যায় কিন্তু পুতুলের গায়ে ময়লা লাগবে না এমন ভাবতে ভালোবাসি। নারী যে শক্ত-সমর্থ হতে পারে আর পুরুষ যে কোমল স্বভাবের হতে পারে তা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কল্পনাই করতে দেয় নি।

আসলে নারীকে যতদিন আমরা মানুষ হিসেবে সম্মান না করব, সমাজ যতদিন মনুষ্যতান্ত্রিক না হবে, নারীর প্রতি বর্ণ বৈষম্য কোনোদিন দূর হবে না। নারী কোনো ভোগ্য বস্তু নয়। নারী সন্তান জন্মদানের যন্ত্র নয়। নারী একজন মানুষ। আর মেয়েকে বিয়ে দেওয়া পরিবারের একমাত্র দায়িত্ব নয়, বরং মেয়েকে মানুষ হিসেবে বড় করা পরিবারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই উপমহাদেশীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি বর্ণ বৈষম্য অনেক পুরনো এবং একটি অমানবিক চর্চা। অসম সমাজ ব্যবস্থার সাথে অমানবিক চর্চা মানব মুক্তির পথে বিরাট অন্তরায়।

**লেখার প্রয়োজনে ফর্সা, কালো, ফর্সা নয় – এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছি। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে বলার উদ্দেশ্যে লেখা নয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]