বাঁধনরা বাধা ভাঙবেই
আঞ্জুমান রোজী ।। মানুষ যখন দৃঢ়চিত্তে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায় তখন সে এগিয়েই যায়। শত বাধাবিপত্তি এবং প্রতিকূল অবস্থা উতরিয়ে এগিয়ে যায়। বিষয়টা নারীপুরুষ সবার জন্যই কঠিন, তবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান ভিন্ন হওয়াতে লড়াইটা করতে হয় অন্য আঙ্গিকে; বলতে গেলে একই সাথে নিজের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। যুদ্ধের ছক অর্থাৎ ‘আমি কী চাই’ তা যদি স্পষ্ট জানা থাকে তাহলে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদিও জন্মের পর থেকে কোনো মেয়ে-শিশুকে তার ‘চাওয়ার’ বিষয়টি বুঝতেই দেয়া হয়না। মেয়েদের সব চাওয়া অন্যের হাতে বন্দী অর্থাৎ বিয়ের আগে বাবা বা ভাই এবং বিয়ের পর স্বামী বা পুত্রের হাতে। এমতাবস্থায় মেয়েরা কীভাবে নিজেকে আবিষ্কার করবে? সেরকম সুযোগ এবং মননশীল শিক্ষা তাদের দেয়া হয়না। তারপরও মেয়েদের এমন শিকলবাধা জীবনে কেউ কেউ নিজেকে আবিষ্কার করে ফেলে; এই আবিষ্কারের পথ তৈরি করে দেয় তাদের পোড়খাওয়া জীবন।
অধিকাংশ মেয়েরা বড় হতে হতে সামাজিক-পারিবারিক চাহিদা অনুযায়ী স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। একজন স্বপ্নের পুরুষ, ছবির মতো সাজানো বাড়ি, ফুটফুটে বাচ্চা যার সবটুকুই নিজের হাতের যত্ন-ছোঁয়ায় থাকবে। এমনটাই ভাবতে শেখায় বয়োজ্যেষ্ঠরা বা নানু-দাদু। লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকার সব মন্ত্র জপে একরকম ব্রত নিয়ে জীবন সাজাতে চায়। বেশিরভাগ মেয়ের এমন স্বপ্নের মোহভঙ্গ ঘটে বিয়ের পর। স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর পার্থক্য দেখে হয়ে যায় দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক বাবা-মা সেই মেয়ের পাশে থাকেন না। মেয়েকে বাধ্য করেন সংসার করতে। এভাবে ধুকেধুকে কত মেয়ে যে জীবন বলি দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বাস্তববর্জিত জ্ঞান এবং অধিকার সচেতনতার অভাবেই মেয়েদের জীবনে একসময় অমানিশা নেমে আসে। এই তো বাংলাদেশের মেয়েদের জীবন যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বেধে দিয়েছে, যেখানে নারীর কোনো স্বাধীনতা নেই! এরইমধ্য থেকে কোনো কোনো মেয়েকে জেগে উঠতে দেখি, দেখি প্রতিবাদী হতে। তাদের সংগ্রামী জীবন কখনো কখনো সাফল্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আলো ছড়াতে থাকে।
এমনই এক সংগ্রামী নারী আজমেরী হক বাঁধন, যিনি একজন অভিনয়শিল্পী এবং দন্ত চিকিৎসক। যার কথা সবার আগে উঠে এসেছে সম্প্রতি ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে। তার অভিনীত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রই মূলত তাকে এতো আলোড়িত করেছে। চলচ্চিত্রটির পরিচালক হলেন আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, যাকে এককথায় বলা যায় বাঁধনের আলোকবর্তিকা। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে আজমেরী হক বাঁধনের অক্লান্ত পরিশ্রম। এরই প্রেক্ষিতে বাঁধনের সংগ্রামী জীবনের কথা জানতে পারি। জানতে পারি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। সংসার করতে চাইলেও সংসার করতে পারেননি। নিজ সন্তানের অধিকার দাবি আদায়কারী হিসেবে তার লড়াকু ভূমিকা অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ বটে। যেখানে আইন, থানা সব জায়গা থেকে বলা হয়েছে সন্তানের ব্যাপারে বাবার সিদ্ধান্ত অগ্রগণ্য, সেখানে একাকী যুদ্ধ করে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে সন্তানকে বুকের মাঝে ধরে রাখা সহজ কথা নয়। যদিও সন্তানের প্রতি বাবা কোনো দায়দায়িত্ব পালন করেন নাই, তারপরও বলা হচ্ছে বাবাই সর্বেসর্বা। এটাই হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অবিচার। যার জন্য আজমেরী হক বাঁধন বলেন, “আমি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আদর্শ নারী নই।” যেখানে স্বাধীনতা নেই, অধিকার খাটানোর জায়গা নেই সেখানে তথাকথিত আদর্শ নারী হয়ে থাকার কোনো যুক্তিও নেই। তাই বলছি, আজকের এই অবস্থানে এসে বাঁধনের ভাবমূর্তি অনেক মেয়ের কাছে উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে।
কষ্টের জায়গাটা হলো, বাঁধনের এমন সাফল্যে স্যোশাল মিডিয়ায় অনেককেই দেখছি বিরূপভাব পোষণ করছে, করছে সমালোচনা। তারা বাঁধনের কৃতিত্বে অভিভূতও নয়, কোনো অভিবাদনও জানায়নি। একেই বলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। এর মধ্যে অনেক নারীপুরুষ তো আছেই, সেইসাথে আছে বিজ্ঞ পণ্ডিতব্যক্তিও। পুরুষতন্ত্রের জাল ভেদ করে কোনো নারী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, এটা যেন তাদের সহ্যের বাইরে। এভাবেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। বাঁধনকে যারা এককভাবে তুলে ধরেছে, সেটা ছিল শুধুই তার ব্যক্তিসত্তা এবং তার সংগ্রামী জীবন; যেটাকে আমি এবং আমার মতো আরো অনেকে তাকে অভিনন্দিত করেছি। নারী এগিয়ে যাচ্ছে, সেটাকে স্বাগতম জানাই সর্বান্তকরণে। নারী কীভাবে এগিয়ে যাবে এবং ভাঙবে সব প্রথা, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো বাঁধন।
সচেতন মানুষমাত্রই নারীবাদ তত্ত্বে বিশ্বাসী। নারীবাদ এমন এক তত্ত্ব যা নারী-পুরুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। গড়ে তোলে মানবিক হিসেবে। পুরুষ যদি তার পুরুষালি মনোভাব ঝেড়ে এবং নারী যদি তার নারীসুলভ আচরণ ছুঁড়ে ফেলে দেয় তাহলেই সম্ভব সমতার পৃথিবী গড়ে তোলা। নারী এবং পুরুষের মধ্যে কোনো বিভেদ থাকার কথাই ছিল না। অথচ পুরুষ দ্বারা গঠিত এবং নিয়ন্ত্রিত নিয়মকানুন যুগযুগ ধরে গড়িয়ে আসছে, যা থেকে নারীকে মুক্তির পথ খুঁজতে হচ্ছে। এই বিষয়ে যতটা না লেখা হচ্ছে তারচেয়ে বেশি হচ্ছে আন্দোলন। এতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একচুলও পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ পুরুষ তার ক্ষমতার জায়গায় অটল এবং সেই ক্ষমতার আগুনে পুড়ছে প্রতিটি নারী। এতো বাধার মধ্যে পৃথিবী কি থেমে আছে? যে জাগার সে জাগবেই, বাধার প্রাচীর ভাঙবেই। পুরুষের ক্ষমতার ঘেরাটোপ থেকে মেয়েরা একদিন বের হয়ে আসবেই।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর যোগ্যতার মূল্য দিতে জানে না বা চায় না। অথচ একটু সুস্থ মূল্যায়ন পেলে কত নারী প্রাণ ফিরে পেতো। পৃথিবীটাও আরো সুন্দর হতো, হতো স্বস্তির। মানুষ তো মানুষের জন্য, তাহলে নারীর জন্য মানুষ নেই কেন? এতো কুৎসা, এতো রটনা, এতো হীনমন্যতা; সবই কি নারীর জন্য! এসব নেতিবাচক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোকে উৎরিয়ে নারীকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এভাবেই এগিয়ে যেতে যেতে আজমেরী হক বাঁধনের সংগ্রামী জীবন হয়েছে তার সাফল্যের হাতিয়ার। তার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]