November 3, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

আমাদের যুগে এত ডিপ্রেশন টিপ্রেশন ছিল না বাপু!

সুমাইয়া আলম।। আমাদের প্রতিনিয়ত সুষম খাবার খেতে হয় নতুবা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি দেখা যায় নানা অসুখ বিসুখ। সে অসুখ যদি শরীরে বেশি প্রভাব ফেলে আমরা ছুটে যাই চিকিৎসকের কাছে। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। ওষুধ খাই, নিয়মিত পরীক্ষা করাই এবং সেই চিকিৎসকের ওষুধে যদি তেমন ভালো কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে আমরা আরো ভালো কোনো ডক্টরের কাছে যাই। মানে আমাদের মনোভাব এমনটা থাকে যে উপায়েই হোক সুস্থ হয়ে উঠতে হবে।

আমরা যদি পুরো মানব শরীরকে ভাগ করতে চাই তাহলে বলা চলে দুইটা অংশ। একটা হচ্ছে কাঠামো যেটা আমরা শরীর বলি আরেকটা অংশ কাঠামোর মধ্যে থাকা ব্রেইন, যেটা আমাদের শরীরকেই শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণ করে না বরং বলা চলে সবকিছুই মাথার ভেতরে থাকা ব্রেইনের যে কোষসমূহ মানে ব্রেইনে থাকা স্তুপ আকারে সাজানো কোষের আস্তরন বা নিউরন মূলত নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সেই মস্তিষ্কের অংশটুকু যে আমাদের আবেগ, অনুভূতি, বিবেক, ভালো থাকা মন্দ থাকা সব কিছু নির্ধারণ করে সেখানে যদি কোনো রোগ হয় তাকে আমরা বলি মন ভালো নেই। সেই রোগ যদি আরও প্রকট আকার ধারণ করে যেটাকে সহজ ভাষায় ডিপ্রেশন বলা চলে, তাকে ভালো করার জন্য, সুস্হ রাখার জন্য কি আমরা আদৌও মরিয়া হয়ে উঠি? ডক্টরের এর কাছে ছুটে যাই? না, উল্টো আমরা এই মনের রোগ বা অনুভূতির রোগকে ট্যাবু করে দেখি। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে মানুষটা আরেকজন কাছের মানুষ বা বন্ধুর জ্বর হলেও ডক্টরের কাছে যেতে বলছে বা খোঁজখবর নিচ্ছে, সেই একই মানুষটা যখন জানতে পারে তার কাছের বন্ধুটি ডিপ্রেসড, সাথে সাথে নেগেটিভ-টক্সিক-চিপ একটা কমেন্ট করে বসবে “আরে ধুর, ওরে ভাবে ধরছে। এসব আবার কিছু হয় নাক “! অথবা বলে “এসব হয়েই থাকে, এগুলো কোনো ব্যাপার না”।

আমরা আসলে ছোটবেলা থেকেই মুখস্ত বিদ্যায় খুব পারদর্শী। পাতার পর পাতা বই মুখস্ত করে পরীক্ষার হলে খাতার পর খাতা বমি উগরে দিয়ে এসেছি। তার ফলাফল ছোটবেলায় না বুঝলেও একটু বড় হলেই টের পাওয়া যায়। মুখস্থ বিদ্যা যেমন আরেকজনের উগরানো কিছু কথা মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে রাখা, নিজের কোনো অ্যানালাইটিক চিন্তা ভাবনা থাকে না, তেমনি বড় হয়েও আমরা কিছু ধরাবাঁধা চিন্তা-ভাবনা ভেতরে ঢুকিয়ে রাখি। তার বাইরে যখন একটা কিছু ঘটে তখন আমরা মেলানোর চেষ্টা করি পূর্বের অভিজ্ঞাতার সাথে। এবং যখন দেখি এসব কিছু আসলে আমার সাথে ঘটেনি তখন গর্দভের মতো নাক মুখ সিটকিয়ে বলি -“ধুরো! যতসব ন্যাকামি”। আমাদের মস্তিষ্ক যে অসীম চিন্তা শক্তির অধিকারী বা আমি যেটা ভাবছি সেটা বাদেও অন্য কিছু ঘটতে পারে এটা আমরা মেনে নিতে পারিনা বা মানতে চাইনা। ওই যে,আমাদের বিশ্লেষণাত্মক মনোভাবটা নেই। ছোটবেলা থেকেই নেই। স্কুল থেকে নেই, খেলার মাঠে সেখানোর মতো কেই নেই, এমনকি পরিবারেও নেই। মা-বাবা কখনো বলেনা “তুমি এই জিনিসটা অন্যভাবে করে দেখতে পারো” বরং বলে ‘‘তোমার ১৪ গুষ্টিতে এমন কেউ করে নাই’’। মানে আমরা একটা ধরাবাঁধা নিয়ম, সংস্কৃতি, চিন্তা-ভাবনার মধ্যে বেড়ে উঠেছি।

আমরা জানি একটা মানুষ নামাজ না পড়লে খারাপ। একটা মানুষ নাস্তিক হলে খারাপ। একটা মানুষ রাত করে বাসায় ফিরলে খারাপ। একটা মানুষ নেশা করলে খারাপ। এমনকি একটা বাচ্চা পড়াশোনা না করতে চাইলে আমরা জোর গলায় বলি “তুই খারাপ”।

অর্থাৎ সবকিছুই আমরা আগে থেকেই জেনে বসে আছি কীসে খারাপ আর কীসে ভালো। কি সুন্দর আমাদের সব চিন্তা ভাবনা! একটু আগ বাড়িয়ে ভেবে দেখতে চাইনা এর বাইরেও কিছু থাকতে পারে। ঠিক তেমনই যখন একটা মানুষ তীব্র হতাশায় ভুগছে বা ডিপ্রেশন এ ভুগছে, দেখি আমরা আঙুল তুলে বলি “তুই পাগল, তুই খারাপ, তোরে ঢং এ ধরছে”। আমরা কি আসলেই একটু সুন্দর করে ভাবতে পারি না? কিংবা একটা মানুষ যখন তীব্র ডিপ্রেশনে ভোগে, তাকে সাহায্য না করতে পারি, অন্ততপক্ষে নেতিবাচক কোনো কথা শোনানোর থেকে তো দূরে থাকতে পারি। আমরা আস্তিক-নাস্তিক-সুফি-সাধক হিসাবে মানুষকে জাজ না করে বরং মানুষ হিসাবেই না হয় ভাবতে শিখি!

এই আমরা শিখি “হিন্দু মানুষের চেহারা আলাদা, দেখলেই বোঝা যায়। ক্রিশ্চিয়ানরা একটু অন্যরকম। মুসলমানদের মধ্যে একটা নূরানী ব্যাপার আছে। অমুকের গায়ের গন্ধ নিলেই বোঝা যায় সে কোন জাতের”। এসব হাবিজাবি কথা দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক জন্মের পর থেকেই পূর্ণ হতে থাকে।

এখন অনেক সময় শুনতে হয় “আগের যুগে তো অমন, ডিপ্রেশন না কি মনের রোগ, তোমাদের ওসব তো আমাদের সময় ছিল না বাপু”। আসলেই কি তাই? আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশের সব মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা ভালো ছিল না। সারাদিন কাজ শেষ করে আসলে মানুষ ডিপ্রেসড হওয়ার সুযোগ পেত না। যুগের বিবর্তনে সবাই একমুখি হয়ে ছুটছে। এখন একটা মানুষ মাঠে কাজ করার পরিবর্তে গার্মেন্টসে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আগে মানুষ এত আহামরি বুঝতো না। বেঁচে থাকা আর খাওয়া-পরার দরকারে যেটুকু কাজ করার দরকার, করতো। ভাবনা চিন্তা ছিল অত্যন্ত সহজ সরল। এত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ব্যাপারগুলো সেভাবে হয়তো বুঝতোই না। ফলাফল কম ডিপ্রেশন। তারপরেও যে মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগতো না, এমনটা না। একটু খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে সেই ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও বহু মানুষ বিষন্নতায় ভুগে আত্মহত্যা করেছে। হয়তো বা এখন থেকে তখন কম মানুষ ডিপ্রেসড ছিল। আমরা দিন-দিন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি, সভ্য সমাজের অংশ হয়ে উঠছি, আগে যে কাজ করতে ১৫ ঘণ্টা লাগতো সেই কাজ এখন হয়তো ২ ঘণ্টায় করছি। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। আমাদের হাতে আগের তুলনায় অফুরন্ত সময়। আমরা একাকিত্বকে বেছে নিচ্ছি। এবং সেই যে বাড়তি সময়টুকু, সেটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে না পারলেই ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছি, এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

ব্যাপারটা অনেকটা এমন, আমাদের চারপাশে সব ধরনের স্বাস্থ্যকর খাবার দাবার আছে কিন্তু সেগুলো আমরা না খেয়ে অল্প কিছু খাচ্ছি। তাতে আমাদের শরীরের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে অনিয়মিত জীবন যাপনের জন্য যে রোগ বাধাচ্ছি, ওই মূহূর্তে যদি এটা বলি আর চিকিৎসকের কাছে না যােই কিংবা উত্তরনের কোনো উপায় খুঁজে বের না করি, তাহলে যেমন শরীরের রোগ সারার আশা নেই বললেই চলে, তেমনি মনের রোগের ক্ষেত্রেও তাই। কোনো রোগ হলে, আমাদের সে রোগ সারানোর জন্য উপায় খুজে বের করা উচিত। ট্যাবু করে দেখার পরিবর্তে মন যে শরীরের থেকেও সেনসিটিভ একটা অংশ, এটাও বোঝা উচিত। একটু কম জাজমেন্টাল হওয়া উচিত। সব কিছু যোগবিয়োগ করে নিজের মতো করে সমাধান বের করে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে না দেওয়া উচিত। নতুবা ওই শরীরের মতো মনের রোগ তো সারবেই না বরং দিন দিন প্রকট আকার ধারন করবে। এর ফলাফল নিশ্চয় খুব ভালো হবে না করো জন্যই! আমরা যেমন ছোট বেলায় বুঝতে পারিনা মুখস্ত বিদ্যার ভয়াবহতা তেমনি আমরা যদি মনের যত্ন না নেই তবে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব যে কতটা খারাপ সেটাও খুব সহজে বোঝা আমাদের পক্ষে আদৌও সম্ভব কিনা জানা নেই!

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]