জলবায়ু পরিবর্তন এবং নারীর টিকে থাকার লড়াই
নাহিদা নিশি।। সুদিন কাছে আসতে শুরু করেছে কি না জানি না, তবে জলবায়ু পরিবর্তন জনজীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। আশঙ্কা করা হচ্ছে, উনিশ শতকের তুলনায় চলতি শতকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রিরও বেশি হতে চলেছে, হুমকির মুখে রয়েছে উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৬০ কোটি মানুষ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৬.২ কোটি মানুষকে হারাতে হতে পারে ভিটেমাটি। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ৫৩ লাখ মানুষ সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হবে, এবং মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এবং এটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ হিসেবে রয়েছে প্রথম স্থানে। ভূ-গর্ভস্তর থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। বাপা’র গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরের পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০ ফুটেরও বেশি নিচে নেমে গেছে। বিগত ৫০ বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে ৫২০টি নদী।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী’কে। বিশেষ করে নারীদের। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের সম্মুখীন হয় নারীরা। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিটি সেক্টরেই পুরুষের তুলনায় নারীর জীবনকে বেশি প্রভাবিত করে। গবেষণা বলছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষদের ৮০ শতাংশই নারী। কারণ জলবায়ু, খাদ্য উৎপাদন এবং নারী তিনটিই একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। পরিবারের নারী সদস্যদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় সবথেকে বেশি ভুগতে হচ্ছে তাদেরকে। পুরুষ সদস্যরা হয় বাড়ির বাইরে থাকে, নয়তো বাড়িতে এসে ফ্যান/এসির নিচে বসে থাকে। রোদে পুড়ে, গরমে সেদ্ধ হয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নারীকেই চুলার সামনে যেতে হচ্ছে পরিবারের জন্য খাবার বানাতে। নিতে হচ্ছে পরিবার, গাছপালা, গবাদিপশুর যত্ন। শীত, গরম, বৃষ্টি, বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড় যাই ঘটুক, নারীর রুটিনের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
উন্নয়নশীল দেশগুলিতে মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৪০-৮০ শতাংশ খাদ্য নারীরা উৎপাদন করে থাকে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা যখন অন্যান্য আকর্ষণীয় কাজের খোঁজে শহরের দিকে ছুঁটে যায়, নারীরা তখন ঘর সামলানোর দায়িত্বে থাকে। কৃষিশুমারি ২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট শ্রমজীবী মানুষের ৪০.৬ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত, যার ৭২.৬ শতাংশ নারী। যদিও ‘কৃষক’ হিসেবে স্বীকৃত কিংবা নিজেকে ‘কৃষক’ পরিচয় দেয়া নারীর সংখ্যা হাতে গোনা।
গত ৪-৫ দিন আগে বাড়ির পাশের একজনের করোনা টিকার রেজিস্ট্রেশন করে দিচ্ছিলাম। পেশা নির্বাচনের সময় বললাম, ‘কৃষক দিচ্ছি’। একদম চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ধুর ধুর। গৃহিণী দাও। তোমার ভাইয়ারটা কৃষক দিও’। অথচ এমন কোনো কৃষিকাজ নাই যা উনি করেন না, উনার স্বামীকেই বরং কম কাজ করতে দেখি। কৃষি কাজ এবং নারীর মধ্যকার সম্পর্কটা অনেকটাই ‘অদৃশ্য’ হয়ে রয়ে গেছে, ঠিক যেরকম একটা প্রচ্ছন্ন সম্পর্ক রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জেন্ডারের। যার ফলে বাস্তবে পুরুষের তুলনায় নারী কৃষকের পরিমাণ বেশি হলেও সরকারি হিসাব মতে পুরুষ কৃষকের সংখ্যা বেশি। কৃষি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের মাত্র ৮-১০ শতাংশ ঋণ নারী কৃষকদের কাছে পৌঁছায়। নারীর ভূমিকাকে কেবলমাত্র সাহায্যকারী, সহায়তাকারী কিংবা কর্মচারী হিসেবে দেখা হয়। ‘কৃষক’ শব্দটি শুনলে আমাদের চোখে পুরুষের মুখই ভেসে ওঠে। প্রয়োজনীয় জমি-জমা, অর্থ সম্পদ এবং প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে নারীদের কাজ করতে হচ্ছে অত্যন্ত ছোট পরিসরে।
আর কৃষিক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। নদ-নদী ধ্বংস, অধিক বৃষ্টিপাত কিংবা খরা, সমস্তকিছুই খাদ্য নিরাপত্তা এবং আয়ের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। নারীর ওপর যেহেতু পরিবারের সকলকে তিনবেলা খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব থাকে, সেহেতু নারীকে অনেক বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নারীরা খাদ্য, বৃক্ষ, কৃষি ফসলাদি, গবাদিপশু, সন্তান-সন্ততি সহ সমস্তকিছুর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
খাদ্য, জ্বালানি কিংবা পানি সংগ্রহের জন্য নারীকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। তাই বন্যা এবং খরার সময় তাদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। বিপুল পরিমাণে বনভূমি উজাড়ের ফলে জ্বালানি সংগ্রহও অনেক বেশি কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে দিন দিন। বিশ্বব্যাপী পানি সংকট এক বিরাট বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। বলা হচ্ছে, সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। ইউনিসেফের একটি জরিপে দেখানো হয়েছে, ৮৯.৬ শতাংশ নারী পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহের কাজ করে থাকে। মাইলের পর মাইল তাদের হাটতে হয় সুপেয় পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। কোনো কোনো দেশে পানি সংগ্রহের পেছনে প্রতিদিন গড়ে তিনঘন্টা সময় ব্যয় হয়।
যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। ১৯৯১ সালে সংঘটিত সাইক্লোনে বাংলাদেশের প্রায় ১,৪০,০০০ জনের মুত্যু ঘটে, যার প্রায় ৯০ শতাংশই ছিলো নারী। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ভিতর নারী ছিলো ৭৩ শতাংশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত শিক্ষার অভাব এবং চলাফেরার সীমাবদ্ধতার কারণে নারীদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয়। বেশিরভাগ নারীরই সাঁতারের মতো বেসিক শিক্ষাটাও থাকে না, যার ফলে বন্যায় ডুবে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া নারী স্বেচ্ছাসেবকের পরিমাণ কম থাকায় নারীদের মধ্যে সচেতনতা কম দেখা যায়। অনেক নারীই ঘর-বাড়ি এবং স্বামী’কে ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে রাজি হন না।
দেশের অভ্যন্তরে নদীভাঙনের কবলে প্রতিবছর প্রায় দশ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। প্রতিবছর গৃহহীন হয় প্রায় এক লাখ মানুষ। নদীর পাড়ের মানুষেরা পাড়ি জমায় শহরের দিকে। অভিবাসী হয়ে নারীরা পাড়ি দেয় দূর দেশে। অনেকেই পড়ে যায় পাচারকারী চক্রের হাতে পড়ে যায়। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের ঝরে পড়া এবং বাল্যবিবাহের পেছনেও জলবায়ু পরিবর্তন’কে দায়ী করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানিতে লবণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবনাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। গবেষণা বলছে, একারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাতের ঝুঁকি অন্যান্য নারীদের তুলনায় ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি থাকে। লোনা পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জরায়ুসংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা। অল্প বয়সে জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে অনেকেই। দুর্যোগের সময় মেন্সট্রুয়েশন কিংবা মাসিক নারীর দুর্ভোগকে আরো বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও আশ্রয়কেন্দ্রে সন্তান প্রসব কিংবা যৌন হয়রানির মতো দুঃসহ অভিজ্ঞতা, কোনোটাই বাদ যায় না।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এবং পরিবেশ সংরক্ষণে পুরুষের তুলনায় নারীরা কয়েকগুণ বেশি কাজ করে। সেই প্রথম বীজ থেকে অঙ্কুরোদগমের প্রক্রিয়া, সেখান থেকে শুরু করে শাক-সবজির চাষ, বৃক্ষরোপণ, শস্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ, নিরাপদ পানির সংস্থান, গবাদি পশু পাখির যত্ন, এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রক্ষায় নারীরা নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের পরিবেশকে, গাছকে, জলকে আত্মীয়ের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অতি সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশ্বনেতারা লক্ষ্য করতে শুরু করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন ভয়ানকভাবে একটি জেন্ডার ইস্যু। ১৯৭০ সালের ‘চিপকো আন্দোলন’ এর পর থেকে বিশ্ববাসী উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, নারীরাই জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে তৃণমূল পর্যায়ে কঠোর প্রচেষ্টা করে থাকে। গ্রেটা থুনবার্গ, বন্দনা শিবা কিংবা ওয়াঙ্গারি মাথাই এর মতো অসংখ্য নারীরা পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর চেষ্টা করলেও, বিশ্বের ৮০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন করলেও পরিবেশ বিষয়ক তহবিলের মাত্র ১ শতাংশ পেয়ে থাকে নারীরা। নারীরা আজও অস্বীকৃত, অনিহিত এবং বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে জেন্ডার পার্সপেক্টিভ থেকে নারীর পক্ষে শক্তিশালী নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে সোচ্চার হতে হবে সকলকে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ডায়ানা লিভারম্যান বলেন, “বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই গুরুত্ব সহকারে খেয়াল রাখতে হবে যাতে সব বড় সিদ্ধান্তে তাদের অংশগ্রহণ থাকে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন ক্ষমতার কোনো লড়াই না, এটা টিকে থাকার লড়াই”। সুতরাং গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ব্যাপারে কুল সাজলে চলবে না। সময় নষ্ট করলে চলবে না। সমুদ্রের স্তর বেড়ে যাওয়ার আগেই আমাদের ডুব দিতে হবে পরিবেশ রক্ষার কাজে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]