September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

বিয়েটা যখন নিজের প্রয়োজন নয়, সমাজের চাহিদা হয়ে দাঁড়ায়

মেহনাজ মেঘনা।। জীবনের ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে বয়স এখন পঁচিশ। পঁচিশের কী উদ্যমী তারুণ্যের কথা শুনেছি বহু কবি লেখকের মুখে। সবসময়ই স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমার সেই স্বাধীনতার পঁচিশ হবে। শৈশব, কৈশোরের সমস্ত নির্ভরশীলতা কাটিয়ে আমি পাবো আমার স্বাধীনতার পঁচিশ। বয়স পঁচিশ হলে নিজের কেরিয়ার হবে! নিজে জীবনে কী চাই তা নিজেই ঠিক করতে পারবো, কীভাবে বাঁচতে চাই, কাকে নিয়ে বাঁচতে চাই!

পারিবারিক চাপে কখনো স্বাধীনভাবে ট্যুরে যেতে পারিনি, ঘুরে দেখতে পারিনি দেশটা। জব পেয়েই প্রথমে দেশটা ঘুরবো। তারপর নিজের একটা বিজনেস দাঁড় করাবো। তারপর না হয় জীবনের ভার বুঝে বিয়ে করবো। একজন মেয়ে চাইলেও সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে সেই উদাহরণ হব।

বর্তমানে আমি পঁচিশ, সময়গুলো পার হয়েই গেল, কিন্তু পেলাম না আমি আমার স্বাধীনতার পঁচিশ। এক করোনা মহামারী অনেকটুকু জীবন পিছিয়ে দিলো। এরচেয়ে বড় সামাজিক যে মহামারী জীবনকে দিন দিন বিষিয়ে দিচ্ছে তা হলো তথাকথিত সামাজিক অনুষ্ঠান “বিয়ে”। ভুল বুঝবেন না, বিয়ে নিয়ে আমার বিরোধ নেই, তবে আমাদের সমাজের সংজ্ঞায়িত বিয়ে নিয়েই আমার বিরোধ এবং এই সামাজিক রীতির শেষ চাই।

আমার জন্ম ছোট একটা মহল্লায় এবং মোটামুটি রক্ষণশীল পরিবারে হলেও আমি জীবনে অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। প্রতি মুহূর্তেই মনে হয় মেয়ে হয়ে বড় স্বপ্ন দেখাটাই আজন্ম পাপ! মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে নেই এই সমাজে। যে বয়সে স্বপ্ন দেখতাম স্বাধীন হবো, সেই বয়সেই পরিবার শেকল পড়ানোর বন্দোবস্ত করছে তোড়জোড় করেই। এই বয়সে না আসলে বুঝতাম না একটা মেয়ে বাবার জন্য এতো চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তরুণী মেয়ে দেখলো সমাজের মানুষের মাথায় যত চিন্তা আর আক্ষেপ শুধুই বিয়ে নিয়ে। বিয়ে দিলেই সব সমাধান। আমাদের সমাজের একটা বদ্ধমূল ধারণা হলো মেয়েদের জীবনের প্রতিষ্ঠা মানেই বিয়ে আর কেরিয়ার মানেই প্রতিষ্ঠিত জামাই। এই দুইটা বিষয় দিয়েই বেশিরভাগ মেয়ের জীবন নির্ধারণ করে আমাদের পরিবারগুলো। তারা কখনো মানতেই চায় না আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা আছে, স্বপ্ন আছে এবং আমাদেরও কেরিয়ার আছে। জীবন নিয়ে ভাবার জন্য একজন ছেলে মানুষ যতটুকু স্পেস পায় একজন মেয়ে সেই স্পেস কখনো পায়না। একজন ছেলে ২৮/২৯ এ প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই এই সমাজের জন্য বাহাদুরী এবং বিয়ের জন্য উপযুক্ত সময়। অন্যদিকে একজন নারীর সুইট ওয়াইফ হওয়াটাই এইখানে গর্বের বিষয়। একজন মেয়ের প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়াটাই অপরাধ! রাজ্যের চিন্তা সমাজের মানুষ মাথায় ঢুকিয়ে দেয়।

মেয়েদের কখনোই জিজ্ঞেস করা হবে না সে কখন বিয়ে করতে চায়, কাকে জীবনসঙ্গী হিসবে পেতে চায়, জীবনে কী করতে চায়, কোথায় যেতে চায়! মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স, মাস্টার্স শেষ করুক, চাকুরী করুক অথবা এইচএসসি ফেল করুক। যাই  করুক, মেয়েদের নিয়ে কেবল একটাই চিন্তা, বিয়ে করে জামাইয়ের ঘর করুক। মেয়েটা সময়ই পায় না এটা ভাবার আসলেই সে কাকে বিয়ে করতে চায়!

প্রচলিত সামাজিক বিয়ে এতো কঠিন ব্যাপার যে এই বিয়েটাই এখন মহামারী রূপ ধারণ করছে। সমাজ আর পরিবারের চোখে মেয়েদের জীবন মানেই বিয়ে, একবার বিয়ে হয়ে গেলে পিছনে তাকানোই যেন অপরাধ! আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, দূর্ভাগ্যবশত ভুল রিলেশনশিপে একবার ফেঁসে গেলেন তো জীবন শেষ। ডিভোর্স যেন এক কলঙ্কিত অধ্যায়। পরিবারগুলোও কেমন পর হয়ে যায়। বিয়ের পর মেয়েদের জন্য নিজের ঘরের দরজাটাও যেনে তালাহীনভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েরা বিয়ের পর জামাই নিয়ে বেড়াতে আসলে আহ্লাদের শেষ থাকে না, কিন্তু জামাই ছেড়ে আসতে চাইলে আসতে চাইলে মা বাবার চিন্তা আর লজ্জার সীমা থাকে না। যেন বড় কোনো অপরাধ।

স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলে, আমি নিশ্চিত আমার মতো হাজার মেয়ের ইচ্ছে একই। আমার ব্যর্থতা আমি কখনো একটা বিয়েকে জীবনের অবলম্বন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখি নি। মেয়েরা যে বয়সে কনে সাজার স্বপ্ন দেখে আমি তখন একজন কর্মব্যস্ত নারী হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।

লড়াই করি নি, তা নয়! সেই ১৮ বছর বয়স থেকেই লড়াই শুরু করেছি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জন করার লক্ষ্যে। এখন অব্দি সেই স্বাধীনতা পেলাম না মেয়ে হওয়ার অপরাধে। কতদিন আসলে এই সমাজের সাথে লড়াই করা যায়? একা একা লড়াই করা কঠিন আর সবচেয়ে বড় কঠিন কাজ হলো আপন মানুষগুলোর সাথে লড়াই করে যাওয়া। লড়াই ও স্যাক্রিফাইস করতে করতে এখন বড্ড ক্লান্ত লাগে, জীবনটা ভারি লাগে!

আমি বিয়ে করতে চাই, নিজের পছন্দের মানুষটাকে, নিজের সময়ে, নিজের জীবনের ভার বুঝে। সমাজের জন্য বিয়েটা আমার প্রতিষ্ঠা হতে পারে কিন্তু আমার কাছে বিয়েটা আমার জীবনের প্রয়োজনবোধে হবে। আমার জীবনসঙ্গীর সাথে আমি হাতে হাত রেখে পাড়ি দিতে চাই অসীম পথ, যেখানে কেউ কারো চেয়ে বড় হওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা না করে দু’জন দু’জনের জীবনের ভার ভাগ করে নেব।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]