গালির লিঙ্গ না খুঁজে পুরুষের মুখেই ছুড়ে মারুন
নন্দিতা সিনহা ।। আমাদের বাস্তব জীবনে এমনকি নাটক সিনেমাগুলোতেও প্রায় দেখা যায় কোনো নারীর উপর যখন চরিত্রহীন ‘অপবাদ’ দেওয়া হয়, তখন সেই নারী যেই হোন না কেন এই ‘অপবাদ’ এর প্রতিক্রিয়াতে চরমভাবে অপমানিত বোধ করেন, কান্নাকাটি করেন, নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যান। যেন জীবনের সকল অর্জন উপার্জন অন্যের নির্ধারিত এই চরিত্রের কোণায় বাধা ছিল, আর চরিত্রহীন বলার সাথে সাথে সেগুলো হাতছাড়া হয়ে গেল!
চরিত্র নামক যে ধারণাটা আমরা চিরকাল মনে ধারণ করে আসছি, আমরা এই চরিত্র ধারণাটির লিঙ্গভিত্তিক নিরপেক্ষতা নিয়ে কখনও কি চিন্তা করেছি? একটু গভীরভাবে ভাবলে একথা সহজেই বুঝতে পারা যায় যে আমাদের মনে লালন করা এই চরিত্র ধারণার ধারক যতটা না পুরুষ তার চেয়েও বেশি নারী। বলতে গেলে প্রধান ধারকই বলা যায়। ভেবে নেওয়া হয় চরিত্র নামক এই ধারণার সব দায় কেবল নারীরই, এই ‘মহামূল্য’ চরিত্রের ধারক ও বাহক নারীই। আর বলাবাহুল্য এই মন মানসিকতার পেছনের মূল কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীবিদ্বেষ, নারীকে অসম্পূর্ণ সত্তার দ্বিতীয় লিঙ্গের মানুষ ভাবা ও চিরকাল অবদমিত করে রাখার বাসনা।
নারীকে ভাষা দিয়ে অবদমন করার আরেক মোক্ষম অস্ত্র পুরুষতন্ত্র সযত্নে লালন করে রেখেছে, সেটা হল গালি। যখনই দেখা যাবে নারী পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্বরেখার বাইরে চলে যাচ্ছে বা গেছে, অমনি তার উপর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে পুরুষের বানানো এই গালি নামক কিছু শব্দ। এই সব গালিগুলো সাধারণত নারীর যৌনাঙ্গ ও যৌনতামূলক ক্রিয়াকলাপকে নির্দেশ করে। আর আমাদের সমাজে যেহেতু আজও যৌনতাকে ট্যাবু বা নিষিদ্ধ করে রাখা আছে, সেই কারণে যৌনতাবিষয়ক টপিকগুলো নিয়ে কথা বলাটাকেই চরম অভদ্রতা ও নীচতা বলে ভাবা হয়। আর সেই কারণেই যখন নারীর উপর এই ধরণের নিষিদ্ধ ক্রিয়াকলাপ নির্দেশক শব্দগুলো প্রয়োগ করা হয় তখন নারী সহজাতভাবেই দমে যায়, অপমানিত বোধ করে। বা বলা যায় তাকে দমে যেতে ও অপমানিত বোধ করতে শেখানো হয়েছে চিরকাল। এখানে নারীকে তার সমাজলব্ধ জ্ঞানের উর্ধ্বে গিয়ে নারীর উপর পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের এই বিশেষ কৌশলটাকে নিরীক্ষণ করতে হবে। বুঝতে হবে নারীর চারপাশে পেতে রাখা এই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রটাকে। তাহলেই নারী এই কৌশলে প্রশ্নহীনভাবে ধরা না দিয়ে নিজের অবস্থান বিবেচনায় রেখে আত্মবিশ্বাসটা বজায় রাখতে পারবে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এই গালিগুলোর প্রায় ৯৮ শতাংশ গালিই স্ত্রীবাচক। পুরুষের উপর প্রয়োগ করার মত পুরুষবাচক কোনো গালিই নেই! এর কারণ স্পষ্ট, শুধুমাত্র নারীর উপর প্রয়োগ করার জন্যই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের দ্বারাই এই গালিগুলোর উদ্ভাবন ঘটেছে। আর সে অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো নারীর উপর প্রয়োগ হচ্ছেও। আসলে সমাজে সকল প্রকার বাস্তবিক ও কাল্পনিক দোষে নারীকে একচেটিয়াভাবে দায়ী করা আর পুরুষের সাত খুন চোখ বুঁজে মাফ করার যে নির্লজ্জ প্রবণতা রয়েছে সেটারই প্রতিফলন গালির এই লৈঙ্গিক আপেক্ষিকতা।
একথা সর্বজনবিদিত যে নারী ‘চরিত্রহীন’ হোক বা যাই হোক সেটা সে কখনো একা হয় না, সেখানে পুরুষও ইনভলভড থাকে। কিন্তু চরিত্রহীন ট্যাগটা লাগানো হয় শুধুমাত্র নারীর গায়েই। তখন পুরুষ হয়ে যায় ধোয়া তুলসীপাতা। আর পুরুষেরা তো প্রকাশ্যেই চিরঅক্ষত অসীম স্থিতিস্থাপক চরিত্র নিয়ে গর্ব করে, যা নিতান্তই হাস্যকর। সাম্যবাদের ধারায় তাদের সে যুক্তি কোনোকালেই কোনোভাবেই টেকার নয়। সেটা টিকে আছে শুধুমাত্র নিজেদের তৈরি এই পুরুষতান্ত্রিক অসম সমাজব্যবস্থাতেই। চরিত্র যদি থেকেই থাকে তাহলে যে কারণে নারী চরিত্রহীন হবে পুরুষও সেই একই কারণে চরিত্রহীন হবে, নয়তো ধরে নিতে হবে যে পুরুষের চরিত্র বলে আদৌ কিছু নেই, তারা জন্মগতভাবেই চরিত্রহীন।
এখানে এমন কয়েকটি স্ত্রীবাচক শব্দ নিয়ে বলতে চাই যেগুলো সমানভাবেই পুরুষের উপরও প্রয়োগ করা যায়। ‘পতিতা’ ও এর আরও সমার্থক কিছু শব্দ আছে যেগুলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অপমান করতে চরম পর্যায়ের গালি হিসেবে নারীর উপর প্রয়োগ করে। ‘পতিতা’ কোনোক্রমেই গালি নয়। এটি আইনসম্মত এক ব্যবসায়, যার মূল ক্রেতা পুরুষেরাই। এখন নারী এমনকি পুরুষও অর্থের বিনিময়ে শরীর বিক্রি করে। সমাজে অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে কেউ শ্রম বিক্রি করে, কেউ মেধা বিক্রি করে, পতিতারাও তেমনি যৌনতা বিক্রি করে। অথচ পুরুষতন্ত্রের চেতনা ধারণকারী পুরুষ এমনকি নারীরাও এই শব্দ ও পেশাগুলোকে নীচ প্রতিপন্ন করে নারীর উপর প্রয়োগ করে। অথচ তারা একথা ভুলে যায় যে আজ পুঁজিবাদের কল্যাণে শুধু নারী নয় পুরুষও সমানতালে অর্থের বিনিময়ে নিজেদের শরীর বিক্রি করছে। শুধু নারী নয়, পুরুষও সম্পর্কবহির্ভূত সম্পর্কে চিরকাল লিপ্ত থেকেছে, সার্বক্ষণিক সকল চাহিদা মেটাতে ও বংশের ধারা বজায় রাখতে বিয়ে করে বউ এনেছে ঠিকই কিন্তু সেই বউকে চিরকাল পদে পদে অক্ষরে অক্ষরে ঠকিয়েছে, প্রতারণা করেছে আর পতিতালয়েও গিয়েছে। পতিতালয়গুলো আজও বেঁচে আছে এই ‘মহাচরিত্রবান’ পুরুষেরা আছে বলেই। সেই প্রতারক ব্যভিচারী পুরুষই আবার দিনশেষে শুদ্ধ পুরুষ সেজে তার সকল অপকর্মের দায় নারীর উপর চাপিয়েছে। আর সেটা নারী পুরুষ সকলেই মেনে নিয়েছেও, মেনে নিতে বলা হয়েছে, শেখানো হয়েছে। বিয়ের জন্য যে চরিত্রহীন পুরুষটি ভার্জিন মেয়ে চাইছে, সেই পুরুষ নিজেই আদৌ ভার্জিন কিনা সেটা কেউ খতিয়ে দেখতে যান না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের এই অপকর্ম ও প্রতারণাকে যেভাবে ওভারলুক করা হয় সেটা দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। সেগুলোকে পুরুষেরা এমনকি নারীরাও কেউই অপকর্ম বলে মানতে চায় না, বরং সেটাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। আর তার বিপরীতে সেই পুরুষের সাথে জড়িত নারীকে নিয়েই নারী-পুরুষ সবার মুখে মুখে মুখরোচক রসালো গল্প চলে। একটা সিস্টেম একটা সমাজ কতটা হীন হলে কতটা কপট হলে এমন একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি মননে মস্তিষ্কে পুষে রাখে ভাবা যায়!
নারী, এই পৃথিবী এখন শুধুমাত্র মেটারিয়াল জিনিসের উপর নির্ভর করেই চলছে। এখানে এই অসম সমাজব্যবস্থার নির্লজ্জ একচোখা প্রতিনিধিদের গালি নামক কয়েকটি ফাঁকা বুলিতে পৃথিবীতে কিছুই যায় আসে না, কিছু আসবার যাবার কথাও নয়। এখানে ‘চরিত্র’ নামক বস্তুটির সকল দায়ভার তোমার উপর চাপানো এবং গালি প্রদানের মূল কারণ তোমার সকল পথ রুদ্ধ করা, দমিয়ে রাখা।
চিরকাল নারীশোষণের ধারাটা বজায় রাখার অন্যতম হাতিয়ার হল নারীর একপাক্ষিক চরিত্র বিশ্লেষণ ও গালি নামক বিশেষ্য বিশেষণগুলো। সুতরাং, পুরুষতন্ত্রের এই চিরন্তন কৌশলটার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। যে কারও গালি নামক কিছু ফাঁকা বুলিতে কাৎ হয়ে পড়ে যাবার কিছুই নেই। অপমানিত হওয়ারও কিছু নেই। উল্টো তাদেরকেও সেই ভাষায়ই জবাব দিন। কারণ পুরুষবাচক গালি সমাজে উদ্ভাবিত হয়নি বলে নিজেদের বড় সুরক্ষিত ভাবেন পুরুষেরা! কিছুদিন আগেও এক নারীর ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখলাম পুরুষের উপর প্রয়োগ করার জন্য তিনি প্রচলিত কিছু স্ত্রীবাচক গালিকে পুরুষবাচকে রূপান্তরিত গালি খুঁজছেন। এখানে আমি তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এই সব গালিগুলো লৈঙ্গিক আপেক্ষিকতা নিয়ে শুধুমাত্র স্ত্রীবাচক হিসেবে আজও টিকে আছে কারণ নারী নিজেই সেই গালিকে স্ত্রীবাচক হিসেবে মেনে নিয়েছে। গালিগুলোতে চরম অপমানিত হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দমে গিয়ে নারী নিজেই এই গালিগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নারী মেনে না নিলে স্বীকৃতি না দিলে পুরুষ কখনোই একচেটিয়াভাবে নারীর উপর এইসব অবাঞ্ছিত বিষয়গুলো চাপাতে পারে না। তাই পুরুষতন্ত্রের নারীর প্রতি এই গালিগালাজ শুনে, হাস্যকর চরিত্রবিশ্লেষণ দেখে অপদস্ত হওয়া বন্ধ করুন। পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের তৈরি এই গালি ও চরিত্রবিশ্লেষণ প্রক্রিয়াগুলোয় উল্টো তাদের উপর ন্যায্যতামূলক যথার্থ প্রয়োগ ঘটান। গালি স্ত্রীবাচক কি পুরুষবাচক সেই লৈঙ্গিক যথার্থতা নিয়ে ভাববেন না, এখানে ভাববাচকতাই বিবেচ্য। যে ভাব নিয়ে যে অর্থে নারীর উপর এই গালিগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে পুরুষের উপরও ঠিক এই ভাব ও অর্থেই গালিগুলোর প্রয়োগ হোক। পুরুষের উদ্ভাবিত গালি নামক বিশেষ শব্দগুলোকে পুরুষের উপরই ছুড়ে মারুন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]