November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

মুখ লুকিয়ে মাথা নিচু করে নয়, চোখে চোখ রেখে গলা তুলুন

নায়না শাহ্‌রীন চৌধুরী ।। এদেশের অধিকাংশ মেয়ে বড় হয় নিজের দেহ নিয়ে লজ্জিত হয়ে। যেন এক মূর্তিমান টাইমবম্ব নিয়ে ঘোরে। এই বুঝি সম্মান গেল, এই বুঝি লোকে খারাপ বলল! পড়াশোনা, সৃষ্টিশীল কাজ, অ্যানালিটিকাল আবিলিটির চর্চা মুহূর্তেই নষ্ট করে দেওয়া সম্ভব যদি চাপা গলায় কেউ বলে, ‘এই তোমার ওড়না ঠিক কর!’ ‘এই ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে!’ ‘তোমার ব্রা’র স্ট্র্যাপ বেরিয়ে আছে!’ ‘আস্তে কথা বল!’ ‘এত জোরে হাসতেছ কেন?’ মুহূর্তেই যে মুখ উজ্জ্বল ছিল তা চুপসে দেওয়া যায়। আত্মবিশ্বাস গুড়িয়ে দেওয়া যায়। মেধার পাখা ছেঁটে ফেলা যায়। একটা মেয়ের শরীরও ছুঁতে হবে না। চোখ দিয়ে দেহের স্পর্শকাতর  অংশ লেহন করলেই এই বোকা মেয়েগুলো নিজেদের অস্তিত্ব নিজেরাই গলিয়ে ফেলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। অথচ, এইসব সময়গুলোতেই গলা চড়ানো জরুরি।

অনেক সময় আমরা অনেকেই ভাবি, কী লাভ কথা বাড়িয়ে। কিন্তু, হয়তো এই সময়টা তারা হজম করে বেরিয়ে গেল, কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্র কি আগের মতই থাকলো না! নোংরা, অপরিচ্ছন্ন? আমাদের মেয়ে বা ছোটবোন কি এই একই পরিস্থিতি ভোগ করবে না, যদি আমরা অগ্রজরা এই অন্ধকার চর্চা ঝেঁটিয়ে বিদায় না করি!

আমি নিজে স্বল্পভাষী, এবং আমার সব মানুষের প্রতি সাধারণ বিনয় এবং সম্মান বোধ রয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি আমার আত্মসম্মান, নারীত্বের প্রতি অবমাননা এবং অস্বস্তিকর বোধ হয় তার প্রতিবাদ আমাকে করতেই হয়। এবং আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষের এই অধিকার রয়েছে এবং প্রতিবাদ না করাই অন্যায়। হ্যাঁ, এটা ঠিক, জীবনের একটা বড় অংশ এই দ্বিধা দ্বন্দ্বেই কাটে যে, যে অন্যায় করে, সে কি আদৌ অন্যায় করেছে নাকি আমারই ভুল। কিন্তু মন থেকে যে নেগেটিভ ভাইব আসে তা সাধারণত ভুল হয় না, মূলত যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে। তাই হয়রানি তা যত ক্ষুদ্রই হোক তার প্রতিবাদ জরুরি।

কয়েকটা ঘটনা বলতে ইচ্ছা করছে, বলি, কেমন? কৈশোরে আরবি এবং ধর্মশিক্ষা যার কাছে পড়তাম তার নানা রকম হয়রানির মধ্যে একটি ছিল হাত ধরা। যখন  কোনো সমাধান পাচ্ছিলাম না, তখন একদিন জ্যামিতি বক্সের কাটা কম্পাস হাতে হেনে রক্তাক্ত করে দিলাম। তারপর আবার এমন করলে এই কাজ করার হুমকি দিতাম। তিনি আর পেরে ওঠেননি। মরিয়া হয়েই এই কাজ করতে হয়েছিল। এরকম অ্যাটাক প্রমোট করছি ভেবে নেবেন না আবার।

এক কর্মক্ষেত্রে এক শ্রমিক নেতা অযথা আমার কক্ষে ঢুকে আজাইরা প্যাঁচাল পারা শুরু করলেন একদিন। তখন বিয়ের বছর দুই পেরিয়েছে, মা হইনি। তিনি আমাকে বোঝাতে লাগলেন কেন দ্রুত মা হওয়া উচিৎ এবং দেরি হলে কী কী সমস্যা হবে। আমি যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কাজ করছিলাম আর পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে উত্তর দিচ্ছিলাম। কিন্তু উনি থামছেন না। ওনার সমস্ত আগ্রহ মনে হতে লাগলো কেন আমি আমার জামাইয়ের সাথে কিছু করে বাচ্চা পয়দা করছি না এটায় ওনার গা জ্বলছে! আমি ওনাকে আর সম্মান জানাতে পারলাম না। আমি গলা চড়িয়ে জবাব দিলাম। উনি তাও তর্ক করতে থাকলেন। তারপর আরেকজন এসে ওনাকে সেখান থেকে নিয়ে গেল কায়দা করে। বিষয়টি সেই প্রতিষ্ঠানের এইচআর’কে অবহিত করেছিলাম। কিন্তু সেই শ্রমিক নেতা প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। আমিও সেই কর্মস্থল ত্যাগ করি কিছুদিন পর।

সেদিন এক দোকানে গেছি বাচ্চাদের জন্য চকলেট কিনতে। দোকানের আরেক লোক দেখি আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন একদল পড়তে পড়তে ভাবছে আমি না জানি কি কাপড় পরেছিলাম। তাদের বলার আমার ঠেকা নাই, তাও বলছি, আমি খুব ঢিলেঢালা কালো সালওয়ার কামিজ পরেছিলাম। সেই লোক দেখে আর আমি তাকাতেই নজর লুকায়। এই লোক আরেকদিনও এভাবে তাকিয়ে ছিল। সেদিন বলার সুযোগ পাই নাই। আজ কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘ভাই, কী দেখেন? বাসায় কি মেয়েমানুষ দেখেন না?’

ওই লোক থতমত খেয়ে নিজেকে বাঁচাতে অন্য কথা বলে। বলে, আমার নাকি দেখতে ভুল হইছে। আমি আরও গলা চড়িয়ে বললাম, ‘আপনি আরেকদিনও এভাবে দেখছেন! আমার বয়স হইছে, এইসব আমি বুঝি!’ লোকটা আর কথা বাড়ায় নাই।

গত বছর রাস্তায় একটা ৯/১০ বছরের মেয়েকে দুইটা লোক উত্যক্ত করছিল। আমি গর্জন করে উঠেছিলাম দেখে আমার উপর উল্টা চড়াও হয়েছিল। লোক জমে গিয়েছিল। কিন্তু শাক দিয়ে যতই তারা মাছ ঢাকুক, সত্য তো সত্যই! আর যেটা পরিষ্কার অন্যায় তার প্রতিবাদ সবখানেই জরুরি।

এইসব কাহিনী বলার অর্থ এই না যে আমি বুঝাতে চাইছি আমি কি পরিমাণ দজ্জাল বা বিপজ্জনক মানুষ। আমি শুধু এটুকু অনুধাবন করাতে চাইছি যে এই যে এত বছর ধরে এই ছোট ছোট প্রতিবাদ যে আমরা যার যার জায়গায় থেকে করে আসছি, তার কিছুটা ফল কিন্তু পাচ্ছি। সমাজে বিরাজমান অসুস্থ পারভার্ট মানুষেরা কোনো অন্যায় করতে গেলে অনেক কিছু চিন্তা করেই আগায় অথবা পিছায়। এই পিছানোতেই কারো না কারো প্রতিবাদের গল্প লুকিয়ে থাকে। তার প্রতিবাদের ধারে অন্য কেউ অন্যায় আচরণ থেকে রক্ষা পায়। কাজেই পুরুষতন্ত্রের আদিম ও অভব্য আচরণ নিয়ন্ত্রণে এই প্রতিবাদগুলো শুধু আমাদের জন্য না, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরেকটু সভ্য পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই মুখ লুকিয়ে নয়, মাথা নিচু করে নয়, চোখে চোখ রেখে গলা তুলুন। বিশ্বাস করুন, আপনি যদি নিপীড়িত হয়ে থাকেন তাহলে নিপীড়কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় কেউ আপনার পাশে থাকুক বা না থাকুক আপনি নিজের কাছে অন্তত পরিষ্কার থাকবেন। অন্তত আপনার সাধ্যে যা কুলায় তাই করুন। চোরের গলা বড় হতে পারে কিন্তু সাময়িক, আর ন্যায়ের চিরন্তন।  তাই সব ধরণের হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা খুব জরুরি।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *