আজকের দুর্গারা কোথায়?
অর্চি সাহা ।। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ, বিব্রতকর প্রশ্ন বা শ্লেষ সহ্য করতে হয়নি এমন ছেলেবেলা বোধ হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীর কেউ কাটায় নি, হোক সে কম বা বেশি। আমার অভিজ্ঞতাও ব্যতিক্রম না। খুব বাকপটু ছিলাম না, কিন্তু চেষ্টা করতাম কটাক্ষের সদুত্তর দিতে। যে যুক্তিতে আমার ঈশ্বরকে অপমান করা যেত, অনুরূপ যুক্তিতে (পড়ুন কুযুক্তি) আমিও তাদের ঘায়েলের চেষ্টা করতাম। সত্যি বলতে সেটা করতে আমার রুচিতে বাঁধত। কারো ঈশ্বরের দশটা হাত আর কারো ঈশ্বরকে দেখা যায় না – এটা তর্ক করার জন্য কত খেলো যুক্তি, এই বোধ ছোটবেলাতেই আমার ছিল।
খানিকটা বড় হলাম যখন, তখন আমার মেয়ে বন্ধুদের (!) এটা বলে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করতাম যে আমার ধর্ম নারী রূপের পুজারি। নারীদের সম্মান, অবস্থান অন্য ধর্মের চেয়ে সনাতন ধর্মে অনেক উঁচুতে। নারী শক্তিকে পূজা, ভক্তি আর কোনো ধর্ম দেয়নি। এই যুক্তিতে খানিকটা পরাস্ত করা যেত তা সত্যি। সেই সুখও বেশিদিন জুটল না। খানিকটা পড়ালেখা করে জানতে পারলাম সীতা, অহল্যা, শর্বরীকে আমার ধর্ম সম্মান করে ঠিকই কিন্তু এদের জীবনে লাঞ্ছনার প্রধান কারণ তারা নারী। ইন্দ্র আর অহল্যা একই দোষে দোষী হওয়া সত্ত্বেও দেবরাজ তার দৈববলে বা অনেক আকুতি গুণে শাপমুক্ত হন ঠিকই, কিন্তু অহল্যার ভাগ্যে জোটে সহস্র বছর পাষাণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। অহল্যার শাপমুক্তি দিতে পারেন একজনই, সে রামচন্দ্র, তার পবিত্র পদস্পর্শে!
এ কেমন বিচার! রাম বিষ্ণু অবতার তা আমরা কম বেশি সবাই জানি, সীতাও যে বিষ্ণু তা কতজন জানি? সীতা তার ছোট রাজ্য মিথিলার রানী হন তার বাবা জনকরাজ বেঁচে থাকতেই। শুধু তাই না, তিনি যুদ্ধবিদ্যায়ও অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন, যার ফলস্বরূপ শিবের ধনুক জয় করেন, যাতে পরবর্তীতে রাম গুন পরিয়ে সীতাকে বিয়ে করেন। সেই সীতার পরিণতি কত লাঞ্ছনার তা আমাদের সবার জানা। বড় হবার সাথে সাথে মনে প্রশ্ন জাগে আদৌ কি নারীকে আমার ধর্ম সম্মান করে? যে নারী দুর্গার অসুর বধকে আমরা এত আয়োজন করে উৎসব পালন করি সেই নারী প্রাকৃতিক নিয়মে ঋতুচক্রের সময় কেন ঠাকুর পূজায় নিষিদ্ধ? সবচেয়ে যা আশ্চর্য লাগে আমার কাছে তা হল আমি আজ পর্যন্ত দুর্গা পূজায় কোনো নারী পুরোহিতকে দেখিনি। কোনো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায়ও না। সে চিত্র খুব সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। আমার দেশে তা এখনও সুদূর পরাহত।
ধর্মযুদ্ধে যে নারীর এত জয়জয়কার সেই নারীর সংসার জীবনে মূল্যায়ন কি একি রকম সম্মানজনক? আমার চারপাশে তাকালে তা মনে হয় না। বিশেষত, বিবাহিত আমি জানি জামাই আদর কতটা আড়ম্বরের আর বউ আদর কতটা অলীক। এই লেখা যে সব নারী পুরুষ পড়ছেন তাদের সকলের প্রতি জিজ্ঞাসা, স্রেফ নারী বলে পরিচিত, স্বল্প পরিচিত, অপরিচিত কাউকে কি কখনো বঞ্চিত করেননি? নিতান্ত “ও মেয়ে, ওর কী দরকার” এমনটাও ভাবেননি?
বলবেন, এমনি তো হয়ে আসছে! এই যুক্তি দেবার আগে আপনাদের আধুনিক ঝা চকচকে জীবনের কতগুলো কাজ এমন ধর্ম বা আদর্শ সমাজের ফিল্টারে জাস্টিফায়েড হয়ে আসে তা ভাববেন। নারীর জায়গায় পুরুষ দূরের ব্যাপার, আদৌ নারীরাই জানেন কিনা তা সন্দেহের। আমার উপলব্ধি হল, বেশিরভাগ নারীই তাদের বিবাহিত জীবনে অনাদৃত এবং এর প্রতিকার বা প্রতিরোধ করার সাহস বা অবস্থান অধিকাংশেরই নেই, আবার ইনারাই তাদের সমস্ত প্রতাপ দিয়ে “জামাই আদর” এর প্রয়োজনীয়তা আর “বউ আদরের” বাহুল্যতা প্রমাণে সদা উদ্যোগী। আর রাস্তাঘাটে “নারী”, তার ওপর “মালাউন” ধর্মাবলম্বীদের যে বিশেষ সম্বোধন জোটে তা এই শহরে যাতায়াত করা একজন নারী মাত্রই জানেন।
চারপাশের সব কিছুর যখন এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এত আমূল পরিবর্তন সম্ভব, তখন নিজেদের মা, বোন, পত্নিদের অবস্থান (এসব পরিচয়ের সুত্র ধরেও বা কেন পুরুষজাতির বোধোদয় কুড়োতে হবে?) কেন মন্থরা! আর নারীদের অনেক কাল আগেই একজন বলে গেছেন “জাগো গো ভগিনী”। আমি কিছু বলার যোগ্যতা রাখি না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]