সংখ্যালঘু নির্যাতন: এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অনুসিদ্ধান্ত মাত্র
অনির্বাণ রূপক ।।
এক
১৭ অক্টোবর, ২০২১। রাত আনুমানিক কয়টা হবে মনে নেই। এখান থেকে হাজার মাইল দূরে ওমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তখন হেরে বসে আছে পুচকে স্কটল্যান্ডের সাথে। বাংলাদেশ নামক দেশটার মেজরিটি যখন সেই হারের শোকের মাতম করছে, তখন কিন্তু ইতোমধ্যেই হেরে বসে আছে বাংলাদেশ। নাহ ক্রিকেটে না, ফুটবলে না, কোন পদক-মেডেল কিংবা অলিম্পিয়াডেও না। সত্যিকারের হারা যেটাকে বলে। রংপুরে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, মন্দির ততক্ষণে পুড়ে ছাই।
বাংলাদেশ নামক দেশটার স্বাধীনতার পেছনে অনেক কারণ ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ-প্রবঞ্চণা তো ছিলই, তবে সবচাইতে মূখ্য যে কারণটা ছিল সেটা হল- এই বঙ্গে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের অধিকার সমুন্নত ছিল না। পাকিস্তানের ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গড়ার পরিকল্পনা এই বঙ্গের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের মনে যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল আর সেই ভয়ের বাস্তবিক রূপের যে ভয়াবহতা ছিল- তাতে তারা চাইছিলেন নতুন করে একটা দেশ হোক। যে দেশটা শুধু মুসলিমদের না, যে দেশটা তাদেরও। যে দেশে পূজা অর্চনা করলে কেউ এসে তাদের বলবে না- এটা মুসলিমদের দেশ!
আর সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পাকিস্তানীরা যখন বেছে বেছে হিন্দুদের মারছিল, চেকপোস্টে লুঙ্গি তুলে হিন্দু নাকি মুসলিম সেটা পরীক্ষা করত, বেছে বেছে হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করত- তখন হাওড় অঞ্চলে পালটা আক্রমণ শুরু করেছিলেন জগৎ জ্যোতি দাস নামে এক সিংহহৃদয়ের ব্যক্তিত্ব। সেসময় জগৎ জ্যোতি দাসের তৈরি করা ‘দাস পার্টি’র ভয়ে তটস্থ থাকত পাকিস্তানীরা। এবার আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, জগৎ জ্যোতি দাস কেন এসব করেছিলেন? যাতে এই বাংলা যতটুকু মুসলিমদের, ততটুকুই হিন্দুদের হয়। এই বাংলায় যেন তারা নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারেন, এই বাংলাতে শুধু ধর্মপরিচয়ের কারণে তাদেরনোকো প্রবঞ্চণার স্বীকার না হওয়া লাগে। অথচ কী হচ্ছে?
বাংলাদেশ তো কাল হেরে ভূতই হয়ে গেছে!
দুই
বাংলাদেশে এই যে ভিন্নমতের মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে, এর ভিত্তি কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। বরং বলা যায় – কুমিল্লা, রংপুর, হাজীগঞ্জ সহ সারা দেশে আপনারা যা দেখছেন সেটা একটা লম্বা প্রসেসের একটা অনুসিদ্ধান্ত মাত্র। ভিন্ন মত ও আদর্শের মানুষকে দাবিয়ে রাখার এই প্রসেস আসলে শুরু হয়েছিল অনেক আগে, নাস্তিক হত্যার মধ্য দিয়ে। খুব বিশেষ করে যদি আমি বলি, তাহলে ২০১২/২০১৩ সাল থেকে। সে সময় সিরিয়াল ধরে ধরে নাস্তিক ব্লগার হত্যা শুরু হয়, তাদের বইপত্রকে সরকারের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়। এখন তো সেসব বইপত্র আর বাজারে পাওয়াও যায়না। ব্লগারদের হত্যা করার একটা উদ্দেশ্য ছিল, তাতে নাকি একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। আর সে কারণেই তাদের হত্যা করা। অথচ খুবই হাস্যকরভাবে, বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দাবি করে। দেশটির রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি ভিত্তির একটা নাকি ‘ধর্মনিরেপক্ষতা’।
অথচ সেই ধর্মনিরেপক্ষতার ছিঁটেফোটাও কিন্তু দেখা যায়না। প্রতি বছর বইমেলা এলে আমরা দেখতে পাই, ভুরি ভুরি বিশেষ ধর্মভিত্তিক বই বিক্রি হয়। সেই বইয়ের চটকদার প্রচারণা হয়। অথচ এই বইয়ের বিপরীত আদর্শের বই কিন্তু এই দেশে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। যদি নিষিদ্ধই হবে, যদি বিপরীত আদর্শের মানুষকে লিখতেই না দেওয়া হবে- তাহলে এই দেশটা কিভাবে তাদের হবে? কিভাবে ধর্মনিরেপক্ষ হবে?
এতদিন ব্লগারদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, অবিশ্বাসীদের টুটি চেপে ধরে বলা হয়েছে- এই বাংলায় তাদের কোনো স্থান নেই। এই বাংলা তাদেরও না। আমরা চুপ করে করে দেখেছি। মোটামুটি ব্লগারদের যখন শান্ত করা গেছে, তখন খড়গটা নেমে এসেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর। এই প্রসেসের ধারাবাহিকতায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এক সময় দেশ ছাড়বেন নয়তো লুকিয়ে ধর্মপালন করবেন, তখন কী হবে? তখন শতভাগ মুসলিমপ্রধান দেশ নিয়ে খুব সুখে থাকবে বাংলাদেশ?
নাহ! আফগানিস্তানের দিকে দেখতে পারেন। যেদিন বাংলাদেশে মূর্তি ভাঙার উৎসব হচ্ছিল, সেদিন আফগানিস্তানের একটা মসজিদে বিস্ফোরণে মারা গেছিল ১৬ জন। তারা তো প্রত্যেকে ছিল মুসলিম, আফগানিস্তানেও কায়েম হয়েছে বঙ্গীয় মুসলিমদের স্বপ্নের শরিয়া শাসন। তাহলে সেখানে কেন মুসলিমদের মরতে হল? কারণ তারা ছিল সুন্নীদের তুলনায় সংখ্যায় কম ‘শিয়া’ সম্প্রদায়। সত্যি কথা বলতে, এটাই বাংলাদেশের পরিণতি। একটা সময়ে এই দেশ শতভাগ মুসলিমের দেশ হবে, তখন সুন্নীরা শিয়াদের মসজিদে আগুন লাগাবে, বাড়িঘর ভেঙে দেবে।
তিন
তৌহিদী জনতার আক্রোশে যে কেউ মারা গেলে, যেকোন একটা গোষ্ঠী বিপুল ক্ষতির শিকার হলে তখন এক শ্রেণির লোক দেখা যায়। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, তাদের নিজ নিজ ধর্ম আসলে শান্তির ধর্ম। বিপুল উৎসাহে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, তাদের তৌহিদী ভাইয়েরা যেটা করেছে সেটা মোটেও ‘সহিহ’ না। ‘সহিহ’ বিষয়বস্তু অন্য কথা বলে। যারা এসব করেন তারা কি টের পান তারা আসলে কী করছেন? তাদের এই ধর্মপ্রচারে ক্ষতিগ্রস্তরা কী মনে করে? যদি টের না পান তাহলে আমিই বলে দিচ্ছি।
বাংলাদেশ যখন পুড়ছিল, আপনি তখন ব্যস্ত ছিলেন কেন আপনার ধর্ম শান্তির সেটা প্রচার করতে!
বাংলাদেশের এই পরিণতির পিছনে আসলে এইসব মডারেট ভাইবোনদেরও বিশাল একটা অবদান আছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-নাস্তি
আজকে যে হামলা হচ্ছে, যে শোষণ হচ্ছে, যে নির্যাতন হচ্ছে- তাতে এদেরও অবদান কিঞ্চিত বেশি বৈ কম নেই!
চার
দুর্গোৎসবে হামলার সূচনা হয়েছিল কুমিল্লার ঘটনায় কুরআন শরীফ রাখার মধ্য দিয়ে। সেখানে গণেশের কোলে পাওয়া গেছিল মুসলিম ধর্মের এই পবিত্র গ্রন্থ। মুসলিমদের দাবি অনুসারে সেখানে কুরআন অবমাননা হয়েছে। একটা পাল্টা প্রশ্ন করা যাক তবে।
যদি কখনও মসজিদে বাইবেল পাওয়া যায়, তাহলে কার অবমাননা হবে? মসজিদের নাকি বাইবেলের? অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর অঞ্চলভেদে ভিন্ন হবে। কিন্তু যদি এই ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে, তাহলে নিশ্চিত অর্থেই তৌহিদী জনতা দাবি করে বসবেন এখানে মসজিদের অবমাননা হয়েছে।
সমস্যাটা আসলে এখানেই। ‘অবমাননা’ শব্দটা সবসময় ব্যবহৃত হয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের জন্যেই।
পাঁচ
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা দীর্ঘদিনের একটা ফসল। সংখ্যাগুরু মতাদর্শের বাইরে এখানে যে যেকোনো কিছু করলে সেটাকে খাটো চোখে দেখা হয়, কখনও কখনও মেরেও ফেলা হয়- আজকের বাংলাদেশ তার ফল। কোনো মেয়ের পোশাক নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা, স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় চুল ছেটে দেওয়া, মেয়েদের রাতে বাইরে কাজ করাটা খাটো চোখে দেখা- এই প্রত্যেকটা ছোটখাট ব্যাপার আজকের এই বড় ব্যাপারটাকে ফুয়েল জুগিয়েছে। অথচ আজকে যারা প্রতিবাদ করছে, মন খারাপ করছে তারা হয়তো কেউ কেউ মনে করে- ধর্ষণের জন্যে পোশাকও দায়ী! এই দ্বিচারিতা নিয়ে কখনও কিছুই করা যাবে না।
যদি বাংলাদেশ একটা সমাধানে পৌঁছাতে চায়, তাহলে আগে নিশ্চিত করতে হবে- বাংলাদেশে যে যেটা করতে চায় সে ব্যক্তিস্বাধীনতায় সেটা করতে পারবে। এই বাংলা যতটুকু মুসলিমদের, ততটুকুই বাকি সব মতাদর্শের হবে!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]