অসাম্প্রদায়িক মনন কি আর সম্ভব?
ফারহানা রহমান ।। এই যে প্রতিবার পূজার সময় অথবা নানা ছুতোয় নানা সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, সেটা কি শুধু এমনই যে অন্য ধর্মের মানুষই শুধু এই বিপর্যয়ের শিকার? এটা সত্যি যে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যখন আক্রমণ চালানো হয় তখন সেটার সাথে ভূসম্পত্তি দখল, লুটপাট, হানাহানি যুক্ত হয়। আর এসব দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যেহেতু আমাদের বিচার ব্যবস্থা শুধুমাত্র ক্ষমতাবানদের পক্ষেই কাজ করে। তবে শুধু যে অন্য ধর্মাবলম্বীরাই নানা হেনস্থা আর লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন তাই নয় কিন্তু। আমরাও এই নব্য ধার্মিক দেশের অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ যারা এখন পর্যন্ত ধর্মের লেবাস গায়ে চাপাইনি, তারাও কি পদে পদে এই সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছি না?
অন্যদের কথা বাদ দিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে আমি আমাদের সমাজের মৌলবাদী আচরণের সরাসরি শিকার। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে আমাকে বহুভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে। হয়তো কোনো দোকানে গেছি বা বাজারে গেছি কিছু কেনাকাটা করবো বলে, পাশ থেকে কোনো একজন ধর্মান্ধ পুরুষ বা নারী বলে উঠলো- ‘‘মাথায় কাপড় দেন, মাথায় কাপড় দেন, কবরে যাইতে হবে।” কিন্তু আমি তো বুঝতে পারি না কবরের সাথে মাথায় কাপড় দেওয়ার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আবার হয়তো রিক্সা করে মসজিদের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, আমার মাথার টিপ দেখে কেউ চিৎকার করে উঠলো “হিন্দুতে ভরে গেছে আমাদের দ্যাশটা!” পার্লারে গিয়ে কখনো যদি ম্যানিকিওর বা প্যাডিকিওর করে নেইলপলিশ দিতে বলি তাহলেও পার্লারের কর্মীরা জানতে চায়, ‘‘আপু আপনি নামাজ পড়েন না? নেইলপলিশ কি দিয়ে দেব?” তখন বাধ্য হয়ে বলতে হয়, আমি তো হিন্দু, নামাজ পড়ি না। তখন ওরা স্যরি টরি বলে নেইলপলিশ দিয়ে দেয়। এরকম হাজারো হেনস্তার শিকার হচ্ছি পদে পদে। রোজার সময় রোজা রেখেছি কি না জানতে চাওয়া, আজান পড়লে নামাজ পড়ার আহ্বান, তারপর আছে মহিলাদের দ্বীনের দাওয়াত। দু’একবার সেজেগুজে দাওয়াত খেতে গিয়ে তো মহাবিপদে পড়তে হয়েছে। অবশ্য ইদানিং আমাকে নিয়ে সবাই যারপরনাই হতাশ হয়ে গেছে। তাই অত্যাচারও একটু কমেছে। যাহোক, এসব পরিস্থিতি তো আর এক দিনে হয়নি।
গত ৪৫ বছর ধরে যে সুচিন্তিত উপায়ে নিরলসভাবে আমাদের এই সমাজে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভেতর ধর্মান্ধতা আর সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হয়েছে তা যে এখন এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে, সেটা আমরা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এদেশে এখন লাখ লাখ মাদ্রাসা। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ এক কথায় ধর্মান্ধ। আর ৭০-৮০ ভাগ মানুষের কাজ হচ্ছে সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠানো। আর এই বাচ্চাগুলো ছোটবেলা থেকেই হুজুরদের দ্বারা বলাৎকারের শিকার হতে হতে বড় হয়ে নিজেরাও সমাজের একই দশা করে ছাড়ে। এই মনে প্রাণে সাম্প্রদায়িক জনগণই আমাদের বর্তমান সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থানে আছে। ফলে এরাই ডাক্তার, এরাই ইঞ্জিনিয়ার, এরাই ব্যবসায়ী, সাংবাদিক আর কবি-সাহিত্যিক এবং আর সমাজের অন্যান্য সব পেশাদারী মানুষও এরাই। হাতেগোনা কয়েকজন হয়তো প্রকৃতপক্ষেই মননে অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু বেশিরভাগই লেবাস পরা আর মুখোশ পরা মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে। এদের মনে এক আর মুখে আরেক।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেমন দুর্নীতি ছড়িয়ে আছে ঠিক তেমনই একইভাবে ধর্মান্ধতাও ছড়িয়ে আছে। ধর্মের লেবাস গায়ে দিয়ে সমস্ত অন্যায় করা যায়। এরা সমাজ সংসার, বিবেক কোনোকিছুর তোয়াক্কা করে না। একটি গরীব দেশকে ষড়যন্ত্র করে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা কী করে সম্ভব হল তার পিছনে নিশ্চয়ই অজস্র কারণ আছে। একদল ক্ষমতালোভী মানুষ ৫০ বছর ধরে চেষ্টা করে দেশের যে হাল করেছে তা তো রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয় আর সেটা সবাই বোঝে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সব কিছু তো নষ্টদের হাতে চলে গেছে, সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে বলে দায়সারা হয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হবে। কখনোই নয়।
এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে একে অপরকে দায়ী না করে প্রত্যেককে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করতে হবে। দেশের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, কবিসাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, এঁরাই হচ্ছেন সমাজ গড়ে তোলার কারিগর। একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে তাঁদেরকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হয়। সমাজের প্রতি এঁদের দায় অসীম। বহু বছরের অর্জিত পরিস্থিতি পরিবর্তন করার জন্য আবারও বহু বছর ধরে আমাদেরকেই চেষ্টা চালাতে হবে।
একটি প্রায় মৌলবাদী দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে হলে প্রথমেই যেটা করা দরকার তা হল শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা করা দরকার। একদিকে মাদ্রাসা, একদিকে ইংরেজি মাধ্যম অন্যদিকে বাংলা মাধ্যম! এতো বিভেদ! শিশুকাল থেকেই তো এরা এভাবেই সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে। আমি আমার নিজের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করা সন্তানকে দেখেছি বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা করা বন্ধুদেরকে হেয় চোখে দেখতে। আর বাংলা মাধ্যমে পড়া বহু ছাত্রছাত্রীকে দেখেছি হীনমন্যতায় ভুগতে। ফলে এসব বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার অবসান হওয়া এখন শুধুই সময়ের দাবি। আর অবশ্যই প্রতিটি স্কুলে শিল্পসংস্কৃতি ও বিজ্ঞানকেই একমাত্র প্রাধান্য দিতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্ম্মকাণ্ডের বিকাশ না হলে মগজ ধোলাই ঠেকানো সম্ভব নয়। এছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, এমন বহু বহু বিষয়। তবে আপাতত রাষ্ট্রধর্মের সংবিধানের সংশোধন অতি আবশ্যক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর রাষ্ট্রধর্ম? রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কীসের? রাষ্ট্র কি কারো নিজের সম্পত্তি? এখানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম হবে কেন? তাই এর সমাধান হচ্ছে ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া। কারণ এছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]