ধর্ষককে কেন বিয়ে করতে চান?
তানিয়া কামরুন নাহার ।। “এক হাতে তালি বাজে না” এ ধরণের একটি কথা সমাজে প্রচলিত রয়েছে। কোথাও কোনো ধর্ষণের অভিযোগ উঠলেই ভিকটিম ব্লেমিং শুরু হয়ে যায় মূলত এই পুরোনো কথাটি দিয়ে। গ্রাম্য সালিশ বা পঞ্চায়েতের মাতব্বরেরা শেষ পর্যন্ত তাদের মনমর্জি মতো বিচার করেন, রায় দেন, “এক হাতে তালি বাজে না”। এবং তারা ধর্ষণের শিকার ভিকটিমের (নাকি ধর্ষকের) এত বড় শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েন যে, মেয়েটিকে ধর্ষকের সাথেই বিয়ে দিয়ে সহজে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে চান। গ্রাম্য মাতব্বরেরা সবাইকে বোঝান যে, ধর্ষণের শিকার হলে নারীর মান ইজ্জত সব মাটিতে মিশে যায়। এ নারী কলঙ্কিত। তাকে আর কেউ বিয়ে করবে না। একটা ট্যাবুর মধ্যে নারীকে বন্দী করে ফেলে তারা। যেহেতু একজন নারীর জীবনে বিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তাই তার জীবন রক্ষার জন্যই মাতব্বরেরা সুন্দর (!) সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ধর্ষকের সাথে ভিকটিমের বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। নারীটিরও এ বিয়েতে মত দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
প্রকৃতপক্ষে ঐ সব মোড়লেরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেয় ধর্ষণের অভিযোগ তুলে বিচার চাওয়াটাই সেই নারীর অপরাধ। আর এমন অপরাধে তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে। বরং ধর্ষক এখানে পুরষ্কৃত হচ্ছে। মূল অপরাধী এভাবেই পার পেয়ে যায়, “এক হাতে তালি বাজে না”র রাজনীতিতে। সেই পুরোনো গ্রাম্য সালিশ বা ফতোয়ার প্রভাব থেকে এখনো সাধারণ মানুষ বের হয়ে আসতে পারে নি। তাই এখনো দেখা যায়, ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটলেই সাধারণ মানুষ ফতোয়া দিতে শুরু করে দেয়, “এক হাতে তালি বাজে না”। শুরু হয় ভিকটিম ব্লেমিং। যেখানে অপরাধের মাত্রাভেদে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো শাস্তির দাবি তোলা হচ্ছে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য আন্দোলনকারীরা পথে নামছেন, সেখানে ধর্ষকের সাথেই ধর্ষণের শিকার নারীটির বিয়ে দিয়ে সব কিছুকে যেন একটা পরিহাসের বিষয় করে তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের আদালত প্রাঙ্গন ও জেলখানার গেটেও এরকম একাধিক বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। আদালতই যদি গ্রাম্য মাতব্বরদের মতো ফতোয়াবাজি করে ধর্ষকের সাথে ভিকটিমের বিয়ে দিয়ে অপরাধের সহজ সমাধান দিয়ে ফেলে, তবে দেশের সাধারণ নিরীহ নারীরা কোথায় বিচার পাবে? এমনিতেই ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিচার হবার উদাহরণ প্রায় নেই বললেই চলে।
কয়েক বছর আগে ক্রিকেটার রুবেল ও তার বান্ধবী হ্যাপিকে নিয়ে স্ক্যান্ডালের কথা সবাই নিশ্চয়ই ভুলে যান নি! “বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ”- এমন অভিযোগে রুবেলের বিরুদ্ধে হ্যাপি মামলা করেছিল। ধর্ষণ সত্যি অনেক বড় অপরাধ। অপরাধী যে-ই হোক এমন অপরাধের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু সব কিছু হাস্যকর ও খেলো হয়ে গেল, যখন হ্যাপি বললো, বিয়ে করলে মামলা তুলে নেবে! বড় আজব এক প্যারাডক্স। বিয়ে না করলে ধর্ষক আর বিয়ে করে ফেললেই বুঝি ধর্ষক নয়?
শুধু রুবেল বা হ্যাপির ঘটনাটিই নয়, এখনো আমরা প্রায়ই পত্রিকার পাতায় শিরোনাম দেখি, ‘‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ/প্রতারণা’’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক, অল্পবয়সী, কমশিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী নয়, এমন নারীরাই এ ধরণের প্রলোভনের শিকার হয়ে থাকেন। এমন নারীদের জীবনে সব স্বপ্ন ও সফলতা কেবলমাত্র একটি বিয়েকে ঘিরেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজই তাদেরকে এভাবে ভাবায়। সুযোগসন্ধানী পুরুষেরাও বিয়ের টোপ ফেলেই এই নারীদের ব্যবহার করে। কোনো আবেগময় মুহূর্তে নারীটি হয়তো নিজ থেকেই সম্মতি দিয়ে ফেলে। কিংবা কখনো হয়তো সত্যিই ধর্ষিত হয়। কিন্তু ধর্ষক তখন তাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে সহজেই নমনীয় করে ফেলে। এর ফলে নারী পরবর্তীতে দিনের পর দিন সেই পুরুষ দ্বারা ব্যবহৃত হতে থাকে। দুজনের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়াও থাকতে পারে বিয়ে সংক্রান্ত। এভাবেই নারীটি প্রতারণামূলক সম্মতি দিয়ে থাকে। ফলে পরবর্তীতে “বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’’ মামলা করলেও নারীর পক্ষে ধর্ষণ প্রমাণ করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। আর “এক হাতে তালি বাজে না’’ তত্ত্বের জনকেরা উদয় হতে থাকে। নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে তার নিজের বোকামি আর লোভই দায়ী।
শুধু অল্পবয়সী বা কম শিক্ষিত নারীরাই যে “বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’’ এমন অভিযোগ তোলে তাই নয়, ইদানিং আমরা দেখছি, অনেক প্রতিষ্ঠিত, উচ্চশিক্ষিত, সফল, প্রাপ্তবয়স্ক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারীও এমন অভিযোগ করে সব কিছুকে একটি হাসির খোরাকে পরিণত করছেন। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে সুস্পষ্ট কোন বিধিবিধান নেই বলেই এভাবে মামলা করে অনেক সময় অনেক পুরুষকে বিপদেও ফেলা হচ্ছে। যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও শিক্ষিত নারী হিসেবে ধর্ষণের শিকার হলে প্রথমেই এ বিষয়ে অভিযোগ তোলা ও আইনের আশ্রয় নেয়া উচিত। তা না করে, দিনের পর দিন তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েই যাচ্ছেন! অপরাধীকে বারবার প্রশ্রয় দিয়েই যাচ্ছেন। আবার সেই ধর্ষককে বিয়ের তাগাদাও দিচ্ছেন। জেনেশুনে একজন ধর্ষককে কেন বিয়ে করতে চাইবেন? এখানে তো কোনো গ্রামের মাতব্বর এসে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে মীমাংসা করছে না! তারপরেও এই প্রাপ্তবয়স্ক ও শিক্ষিত নারীরা এ কাজটিই করছেন? তারাও কি তবে সেই সব অশিক্ষিত/ কমশিক্ষিত, অল্পবয়সী নারীদের মতো বোকা? নাকি তাদের শুধু বয়সই বেড়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক হন নি? ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধকে এই নারীরা এতটাই হালকা করে ফেলেন যে, ধর্ষণ অপরাধগুলোই এক পর্যায়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
ধর্ষণের প্রশ্নে আমাদেরকে “জিরো টলারেন্স” নীতি অবলম্বন করতে হবে। আদালতের কাছে শুধুমাত্র ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই প্রার্থনা করা যায়। এর বাইরে আর কোনো কিছু নয়। ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবার অবিবেচক সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে, তা সেটা গ্রাম্য সালিশেই হোক কিংবা আদালত প্রাঙ্গনই হোক। তাহলে মেয়েরাও এ শিক্ষা পাবে, ধর্ষণের অভিযোগ তুলে কোনো পুরুষকে চাইলেই বিয়ে করা যায় না। নারীদেরকেও সচেতন হতে হবে, একজন ধর্ষককে শুধু ঘৃণাই করা যায়, তাকে কখনো বিয়ে করা যায় না। একজন ধর্ষককে বিয়ে করার মানসিকতা বা ইচ্ছে একজন উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত নারীর হয় কী করে?
বিয়ের আগে নর-নারীর মধ্যকার প্রেম স্বাভাবিক। সেই প্রেমে যতই বিশ্বাস থাকুক, যতই আশ্বাস থাকুক, বিয়ের পূর্বেই প্রতারক প্রেমিকের খপ্পরে পড়ে গেলে একজন নারীকে ছলনার শিকার হতে হয়। আবেগের দুর্বলতায় শারীরিক সম্পর্কে নিজেই সম্মতি দিয়ে বসলে একমাত্র নারীই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। যেমন-
নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারে।
অন্তসত্তা হয়ে যেতে পারে।
গর্ভপাতের চেষ্টা করলে নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে, এমন কি সে মারাও যেতে পারে।
সন্তান প্রসবের পর তার পিতৃত্ব নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
ক্রমাগত ব্ল্যাকমেইলিং এর শিকার হতে পারে।
নারী পাচারকারী চক্রের হাতে পড়ে যেতে পারে
এছাড়াও নারীকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। এমন কি সে খুনও হতে পারে।
যেহেতু নারীই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বেশি, তাই নারীদের এ ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। পরিবার থেকেও তাকে শিক্ষা দিতে হবে যে বিয়েটাই জীবনের সব কিছু নয়। নিজের মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা বৃদ্ধিতে তার মনোযোগ দিতে হবে। প্রেমের সম্পর্ক সব সময় নাও টিকতে পারে। সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে পারে। ভালো না লাগলে, ইচ্ছে করলে মেয়েটি নিজেই পুরুষটিকে লাথি দিয়ে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ালে পুরুষটিকে দোষারোপ করার বা অভিযোগ করার কিছুই নেই। নিজের সিদ্ধান্ত ও সম্পর্কের দায়িত্ব নিজে নেওয়া শিখতে হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]