November 22, 2024
ফিচার ৩

৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণ মামলা নয় কেন!

আফরোজ ন্যান্সি ।। রেইনট্রি হোটেলের আলোচিত ধর্ষণ মামলার ক্ষমতাধর আসামীরা যে শেষমেশ বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে সেটি সম্ভাব্যই ছিল। এতে নতুন করে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে অবাক হয়েছি, এই রায়ের বিচারক বেগম কামরুন্নাহারের বক্তব্যে। আড্ডায় বসে নারীর পোশাক এবং চরিত্র নিয়ে কথা বলা কুশিক্ষিত পুরুষতান্ত্রিক পুরুষদের বক্তব্যের সাথে মাননীয় এই বিচারকের বক্তব্যের কোনো অমিল না পেয়ে আমি হতাশ। যখন উনার মতো পুরুষতান্ত্রিক ব্যক্তিরা “নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের” মতো গুরুত্বপূর্ন এবং স্পর্শকাতর পদে বসেন তখন এদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ না হয়ে উপায় কি!

বিশ্বব্যাপী যখন যৌনকর্মী ধর্ষণ কিংবা বৈবাহিক ধর্ষণের মতো গুরুতর বিষয়গুলিকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে আইন পাশ করা হচ্ছে সেই সময়ে আমার দেশের মহামান্য আদালত ধর্ষণ আইনের বিচার করতে বসে বলছেন – “মামলার দুই ভিক্টিম বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভিক্টিম দুইজন আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত, হাসপাতাল রিপোর্ট তাই বলে।”

ওনার বক্তব্য শুনে তা অসংলগ্ন বলেই মনে হয়। কেননা একদিকে তিনি মেয়ে দুটিকে ভিক্টিম বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন। যদি মেয়ে দুটি ভিক্টিমই হয়, তবে আসামীরা বেকসুর খালাস পায় কীভাবে! আর যদি আসামীরা নিরপরাধ হয়, তাহলে মেয়ে দুটিকে উনি বাদী না বলে ভিক্টিম বলা ওনার মানসিক অসংলগ্নতার লক্ষণ প্রকাশ করে। আবার বলছেন, এদের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয় কেননা তারা যৌনকাজে অভ্যস্ত ছিল। যৌনকাজে অভ্যস্ত বলতে উনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, সেটিও স্পষ্ট নয়। উনি কি সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ থাকা বুঝিয়েছেন নাকি সেক্স ওয়ার্কার হওয়া বুঝিয়েছেন? সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ থাকা যদি বুঝিয়ে থাকেন তাহলে আমার প্রশ্ন কোনো বিবাহিত নারী যদি কারো দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন সেক্ষেত্রে সেটি ওনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে কিনা! আর যদি উনি সেক্স ওয়ার্কার বুঝিয়ে থাকেন তাহলে আমি জানতে চাইবো ধর্ষণ কাকে বলে সেটি উনি জানেন কিনা!

যেকোনো সাধারণ মানুষও এখন এটি জানেন যে, জোরপূর্বক, ক্ষমতা প্রদর্শন পূর্বক, ভয়ভীতি প্রদর্শন অথবা অস্ত্রের মুখে সম্মতি ব্যাতীত কোনো নারীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়াই ধর্ষণ। যে পরিস্থিতিতে একজন নারী সঙ্গমে লিপ্ত হতে সম্মতি জানায় না, কিংবা সম্মতি প্রদানে অক্ষম থাকে অর্থাৎ তাকে নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করানো হয় কিংবা কোনোভাবে অজ্ঞান করা হয় কিংবা নারীটি যদি মানসিক প্রতিবন্ধী, বা বিকলাঙ্গ হয়ে থাকেন, এই পরিস্থিতিতে তার সাথে সঙ্গম করা মানেই ধর্ষণ করা। তাছাড়া যদি ওই নারীর বয়স ১৬র নীচে হয় তবে তার সম্মতি থাকলেও তা ধর্ষণ বলে গন্য হবে। ভিক্টিম যদি যৌনকর্মীও হন, আর যদি অনুমতি ব্যতীত তার সাথে যৌনমিলন করা হয় তা অবশ্যই ধর্ষণ এবং তা অপরাধ বলেই বিবেচিত হবে। অথচ বেগম কামরুন্নাহার বলছেন যেহেতু মেয়ে দুটির পূর্বের সেক্সের অভিজ্ঞতা আছে তাই তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়!

শুধু তাই নয়, রায় ঘোষণার পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, “এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এখন থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘন্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায়, তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।” যদি কোনো নারীকে ধর্ষণ করার পর ৭২ ঘন্টা  আটকে রাখা হয় সেক্ষেত্রে বেগম কামরুন্নাহারের কথা অনুযায়ী কোনো মামলা নেওয়া যাবে না কেননা ৭২ ঘন্টা পরে ভিক্টিমের শরীরে কোনো আলামত পাওয়া যায় না। কি হাস্যকর এবং বালখিল্য যুক্তি! যে দেশে এমনিতেই ধর্ষণের মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতে চায়না, মামলা নিলেও ধাপে ধাপে ভিক্টিমকে হেনস্থা করা হয় সেই দেশে মাননীয় আদালতের এই বক্তব্য কাদের পক্ষে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। আদালতের কাজ দোষীকে শাস্তি দেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেওয়া অথচ উনার বক্তব্য শুনে উল্টোটাই মনে হচ্ছে। ধর্ষণ শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষতি নয় বরং এটি ভিক্টিমকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেকক্ষেত্রে ভিক্টিম দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ট্রমাটাইজড থাকে ফলে  সাথে সাথে থানায় মামলা করতে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা থাকেনা অধিকাংশ নারীরই। আমাদের দেশে যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এর মধ্যে আক্রান্ত হবার পরপরই থানায় এসে মামলা করার ঘটনা খুবই কম। এছাড়াও আছে সামাজিক, পারিবারিক চাপ, লোকলজ্জার ভয়, একঘরে হবার ভয়। এসব কাটিয়ে মামলা করতে যেতে যেতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়, আবার মামলা নেওয়া, মেডিকেল টেস্ট করানো এসবের প্রতিটা ধাপেই আছে দীর্ঘসূত্রিতা। ধর্ষণের মামলা করতে চাইলে পুলিশ ভিক্টিমকে সরকারি হাসপাতালে টেস্টের জন্য পাঠান অথচ জেনে অবাক হতে হয় যে, এই ২০২১ সালে এসেও ঢাকার বাইরের সব সরকারি হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারই নেই। আর ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার যদিওবা থাকেও সেক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের কচ্ছপের গতিতে চলা প্রক্রিয়ার কারণে ৭২ ঘন্টার মধ্যে আলামত সংগ্রহ এবং পরীক্ষা করা আদৌ সম্ভব কিনা সেটিও ভাববার বিষয়। এছাড়াও ধর্ষণের বিচারকার্যে মেডিকেল টেস্টই একমাত্র অবলম্বন নয়। তাই ৭২ ঘন্টা পার হয়ে গেলে মামলা নেওয়া যাবেনা এই ধরণের পরামর্শ দেওয়ার পেছনে কোনো সুযুক্তি নেই।

কেউ কেউ এই মামলার পর্যবেক্ষনের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। শুধু কি নারী নির্যাতন আইনেরই অপব্যবহার হয়? অন্য কোনো আইনের অপব্যবহার হয়না! যদি ধরে নেই, দেশে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার হার ৫০%, তাহলে যে ৫০% সত্যি মামলাগুলি আছে তাদের দ্রুত সুবিচার পাইয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় কেন কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। আইনের অপব্যবহার ঠেকানোর জন্যেই তো এতো থানা-পুলিশ, নিম্ন আদালত, উচ্চ আদালত এসব তৈরি করা হয়েছে। আইনের অপব্যবহার হতে পারে এই আশঙ্কায় সত্যিকারেই যেসব অপরাধ হচ্ছে তা অস্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই। মহামান্য আদালতের এই ধরণের বালখিল্য আলাপ বরং অপরাধীকে আরো বেশি অপরাধ করতে উৎসাহিত করবে এবং ভিক্টিম নারীকে আইনের আশ্রয় নিতে নিরুৎসাহিত করবে। পৃথিবী যত সভ্য হচ্ছে,  আইন তত বেশি ভিক্টিমবান্ধব করা হচ্ছে, অথচ আমাদের দেশে আজো ধর্ষণের শিকার নারীকেই প্রমাণ করতে হয় যে তিনি ধর্ষিত হয়েছেন। আজো এদেশের ধর্ষণের বিচারিক প্রক্রিয়ায় মধ্যযুগীয় গলদ রয়ে গেছে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই এদেশের নারীরা ধর্ষণের শিকার হলেও মামলা করতে যান না। মামলা করা হলেও অনেক সময় ক্ষমতার বলে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করা হয় ভিক্টিমকে। এদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় এখনো ধর্ষকের সাথে ভিক্টিম নারীকে বিয়ে করিয়ে দেওয়াকেই একমাত্র সমাধান ভাবা হয়। ধর্ষণের মতো একটা ভয়ঙ্কর অপরাধকে গ্রামীন বিচার-সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা কিংবা ধামাচাপা দেওয়ার প্রবনতাই বেশি দেখা যায়। এই বাস্তবতায় মাননীয় আদালতের এই অশিক্ষিত পরামর্শ নারী নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়াবে বৈ কমাবে না।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *