December 23, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

“পোশাকের কোনো জেন্ডার নেই, যৌনতার জন্য হিল-স্কার্ট পরি না’’

বিদেশি আর্টিকেল অবলম্বনে লিখেছেন সাদিয়া মেহজাবিন ।।

অনেকেই বিশ্বাস করেন, পোশাকের ‘জেন্ডার’ আছে। আমাদের সমাজ এই ধারণাটা পেয়েছে যে, কিছু জিনিস পুরুষ অথবা নারীদের জন্যে মানানসই আর কিছু জিনিস মানানসই না। যদিও পৃথিবীতে এমন কিছু মুক্তমনা মানুষ আছে, যারা তাদের ইচ্ছামত পোশাক পরেন আর নিজেদেরকে স্বাধীনভাবে মেলে ধরেন। তারা মনে করেন ‘স্টেরিওটাইপ’ হয়ে বাঁচার প্রয়োজনীয়তা নেই। যেমন মার্ক ব্রায়ান। তিনি প্রমাণ করলেন, অবশেষে সময় এসেছে ‘জেন্ডার স্টেরিওটাইপ’ থেকে বের হয়ে আসার, বিশেষ করে পোশাকের ক্ষেত্রে।

মার্ক ব্রায়ান একজন আমেরিকান যদিও তিনি এখন জার্মানিতে থাকেন এবং পেশায় একজন রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ার। ‘জেন্ডার স্টেরিওটাইপ’ কে ভাঙ্গতে তিনি প্রায় প্রত্যেকদিন অফিসে অথবা শহরে যাওয়ার সময় স্কার্ট ও হিল পরে যান; এমন কি বাসাতেও তিনি এসব পরেন।  এবং সত্যি বলতে তিনি যখন এসব করেন তখন তাকে দেখতে দারুণ লাগে।

মার্ক  জানান, ‘‘আমি এভাবে পোশাক পরি সকলের থেকে আলাদা হতে। যে নারীরা টাইট স্কার্ট আর হিল পরেন, তাদের আমার ভালো লাগে। এটা যৌনতা না, বরং এটা দিয়ে তারা তাদের ক্ষমতা উপস্থাপন করছেন। আমি যৌনতার জন্যে পোশাক পরি না কিন্তু যেকোনো পেশাদার মহিলার মত পোশাক পরতে পারি। আমার কাছে, পোশাকের কোনো ‘জেন্ডার’ নেই। আমি স্কার্টকে একটা পোশাক হিসেবে দেখি। পোশাক আমাকে কখনো অনুমতি দেয় না কাপড়ের সাথে ‘জেন্ডার’কে মেলাতে। আমার পছন্দ কোমরের উপরে একটি ‘পুরুষালী’ এবং কোমরের নিচে ‘নন-জেন্ডার’ দৃষ্টিভঙ্গি। মূলত  ‘কাপড়ের কোনো জেন্ডার’ নেই।

হিল এবং স্কার্ট পরতে তিনি কেন উৎসাহী হয়েছিলেন জানতে চাওয়া হলে মার্ক কলেছেন, ‘‘পুরুষদের প্যান্টের ফ্যাশনের সব অপশনে, খুব কম কালারের অপশন আছে; কালো, ধূসর, নীল, বাদামী রঙের ছাড়া কোনো প্রিন্টের প্যান্ট নেই। তবে স্কার্টের ক্ষেত্রে আপনি লাল, সবুজ, উজ্জ্বল নীল, ফুলের ছাপ, প্রাণিদের ছাপচিত্রসহ পাবেন। জুতোর ক্ষেত্রেও তেমন এবং হিলের মধ্যে বিভিন্ন ডিজাইন এবং স্টাইলের আছে। এছাড়াও আবহাওয়া সুন্দর হলে আপনি খোলা পায়ের জুতো পরতে পারেন’’।

‘‘আমার নিজেকে নিজের কাছে আলাদা মনে হয় না। এটা শুধুমাত্র পোশাকেই। সাধারণভাবে শীতকালীন সময়ে হিল জুতো পরতে শারীরিকভাবে আলাদা লাগে। আমার নিজেকে লম্বা মনে হয় কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতায়িতও। সব মিলিয়ে, সম্ভবত আমার ভেতরের শক্তি যা আমাকে ভিন্ন রকম পোশাক পরতে আত্মবিশ্বাসী করেছে, তা আমার কর্মক্ষেত্রেও কাজের চাপ নিতে আত্মবিশ্বাসী এবং শক্তিশালী করে তুলেছে’’।

মার্কের এগারো বছরের সুখী দাম্পত্য জীবন এবং সে তার স্ত্রী এবং পরিবার থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা পায়। মার্ক বলেন, ‘‘আমার স্ত্রী মাঝেমাঝে আমাকে পরামর্শ দেয়, আমার কী পরা উচিত। আমার মেয়ে তো সবসময় কামনা করে আমার জুতোগুলো ধার করে পরার”।

মার্কের মানানসই পোশাকগুলো খুঁজে বের করতে তার কী করতে হয় তার সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন- ‘‘আমি ছয় ইঞ্চি লম্বা এবং ওজন ১৬৫ পাউন্ড। আমারো মাঝারি থেকে ছোট পা আছে। আমি ইউ এস এ ৮.৫ এবং ইউরোপে ৪১ নম্বর জুতো পরি। আমার কোমড় ২৯, তাই ইউ এস এ  ৮’’ স্কার্ট এবং ইউরোপে ৩৮” পরি। আমি সপ্তাহে ২-৩ বার ওয়ার্ক-আউট করি। তাই আমার সাইজের কাপড় খোঁজা কোনো সমস্যাই নয়”।

‘‘আমি আমার বেশিরভাগ হিল অনলাইনে কিনি, যাতে করে আমি ঘরেই এসব পরীক্ষা করে দেখতে পারি। এইভাবে আমি জুতোগুলো নিয়ে কিছু সময় কাটাতে পারি এবং সিঁড়ি দিয়ে উপরে- নিচে হেঁটে পরীক্ষা করি। হিলের ‘স্টিলেটোসে’র সক্ষমতা পরীক্ষা করার সময় দেখি, তারা কতটুকু পিছলে যাচ্ছে। এক-আধ ঘণ্টা বসে থাকার সময়েও আমি হিল পরে থাকি, যদি তখন ব্যাথা পাই তবে তাদেরকে আবার আগের বাক্সে করে ফেরত দিয়ে দিই। তাই একটা আরামদায়ক ভালো জুতো বেশ গুরুত্বপূর্ণ; সাথে এর স্টাইলও”।

আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঁচ ইঞ্চির স্টিলেটো। এটি আমাকে যেভাবে উপস্থাপন করে এবং আমাকে যে সুন্দর অনুভূতি দেয় তা আমার পছন্দের। অমসৃণ তল যেমন ফাঁকা পাথরের রাস্তা অথবা ফুটপাতে যেখানে বড় বড় গর্ত আছে এবং হিল জুতো আটকে যায়, সেখানে অবশ্য স্টিলেটো হিল পরে হাঁটা আমার পছন্দ না।

 

 

মার্ক পোশাক পরার ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে পছন্দের স্টাইলগুলোর সম্পর্কে জানান, ‘‘আমি শুধুই টানা পেন্সিল স্কার্ট আর স্টিলেটো হিল পরি। এটা আমার স্টাইল না, এমন মনোভাব নিয়ে আমি পোশাক পরি না; বরং এটা কোমরের উপরে পুরুষ এবং নিচে ‘নন-জেন্ডার’ হিসেবে পোশাককে উপস্থাপন করছে। আমি বেশিরভাগ স্কার্ট হাঁটুর উপরে এক বা দুই ইঞ্চি কম বা বেশি পরতে পছন্দ করি। আমার পছন্দের হিলের গড় উচ্চতা আনুমানিক চার ইঞ্চি’’।

মার্ক জানান, সাধারণত ৩০-৪০ বছরের কাছাকাছি নারীরা তাকে প্রশংসা করে। পুরুষেরা হয় মন্তব্য করে নাহয় প্রশ্ন, কিন্তু কখনোই তার বেশভূষার প্রশংসা করেন না।

‘’ধরুন একজন উজ্জ্বল সবুজ চুলের ব্যক্তি। সবুজ রঙের চুল স্বাভাবিক না। আপনি উপরে তাকালেন এবং দেখলেন সেই ব্যক্তিকে; আপনার মস্তিষ্ক বললো ইনি একজন ব্যক্তি যার চুল সবুজ, আপনি নিজে ভাবলেন এটা অস্বাভাবিক অথবা মজার ব্যাপার, তারপর আবার আপনি আপনার কাজে ফিরে গেলেন এবং এ বিষয়ে আর দ্বিতীয়বার ভাবলেন না। আমি বিশ্বাস করি এটা যখন লোকেরা আমাকে স্কার্ট আর হিলে দেখে তাদেরও তাই হয়’’।

যেসব পুরুষেরা স্কার্ট এবং হিল পরতে চান কিন্তু বেশ ভয় পাচ্ছেন, তাদের জন্যে মার্ক কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। ‘‘যদি আপনি হিল নিয়ে জানতে চান তাহলে আমি বলবো প্রথমে কম উচ্চতার হিল দিয়ে শুরু করুন এবং আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়ার সাথে কাজের উচ্চতাও বাড়ান। আপনি ভয় পেতে পারবেন না। কিছু ব্যক্তি পশুর মত আচরণ করে এবং তারা দুর্বল জায়গায় প্রথমে আঘাত করে। আপনার আত্মবিশ্বাস দেখান এবং পৃথিবীকে জানান দিন যে আপনি ভয় পান না এবং দেখবেন তারা আপনাকে আর বিরক্ত করবে না। আপনার একমাত্র একটি ভয় আছে এবং সেটি হলো নিজেকে ভয় পাওয়া। স্কার্ট? পরে ফেলুন। সম্ভবত ‘হাই হিল’ এর সাথে নয়। কিন্তু পুরুষের স্কার্ট পরা তুলনামূলক বেশি গ্রহণযোগ্য একজন পুরুষের ‘হাই হিল’ পরার চেয়ে।

 

 

যখন মার্কের কাছে জানতে চাওয়া হয়, সে কীভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো স্কার্টের সাথে হিল পরার, তখন মার্ক জানান, ‘‘আমার কলেজের পুরানো বান্ধবী আমাকে তাদের সাথে নাচতে অনুরোধ করত যেখানে আমরা দুজনই ‘হিল’ পরে ছিলাম। আমরা প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন করতাম। আমি বেশ ভালো ছিলাম হিল পরে হাঁটতে এবং নড়াচড়ায়। বছরের পর বছর আমি হিল পরেছি আবার পরিনি কিন্তু স্কার্টের সাথে এমন হয়নি। আমি কেবলই পাঁচ বছর ধরে স্কার্টের সাথে হিল পরা শুরু করেছি। আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো, প্যান্ট আর হিলের চাইতেও স্কার্ট আর হিলে বেশি মানাবে আমাকে’’।

‘‘আমার যথেষ্ট ভালোভাবে মনে আছে, স্কুলে থাকতে আমার সহপাঠী মেয়ে বান্ধবীরা প্যান্ট পরতে পারত না। তবে এখন প্যান্ট একটি ‘নন-জেন্ডার’ পোশাক হয়ে গিয়েছে পরার জন্যে। তাহলে কেন স্কার্ট আর হিল ‘নন-জেন্ডার’ পোশাক হতে পারবে না? পাশাপাশি পুরুষেরা নারীদের আগ থেকেই হিল পরছে। সম্ভবত আজকের এই স্টিলেটো স্টাইলের হিল নয় কিন্তু পুরুষেরা নারীদের আগ থেকেই হিল পরেছে’’।

মার্ক কেবল একজন ইঞ্জিনিয়ার নন, তিনি ফুটবল দলের প্রধান কোচও।

মার্ক বলেন ‘‘সমকামীতা বা বৈচিত্রময়তার আখ্যা না নিয়েই পুরুষেরা এসব করতে পারে। এসব মানেই যৌনতা নয়। বেশিরভাগ সময়  পুরুষেরা মন্তব্য করেন- ‘আমি মেয়েলী আচরণ করিনা’। তারা আমার সাথে কথা না বলার আগ পর্যন্ত ধরে নেয়, আমি একজন মেয়ে এবং সমকামী।  আমি একজন সাধারণ, স্বাভাবিক, সোজা এবং সুখী বিবাহিত লোক মাত্র। আমি ভালোবাসি সুন্দর নারী, পোর্শে গাড়ি এবং শুধুই চাই আমার পোশাকের আলমারি হিল আর স্কার্টে ভরে উঠুক”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *