November 2, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

‘‘স্লাট শেইমিং’’: পুরুষতন্ত্রের অস্ত্র

কারিন আশরাফ ।। 

“বে*শ্যা “মা*গী’’ ‘‘খা*ন*কি’’ “রাস্তার মেয়ে!” কথাগুলো প্রায়ই ছুড়ে দেওয়া হয় নারীর দিকে। এই শব্দগুলো দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় নারীর মন ও অনুভব, তার অস্থিমজ্জা ও আত্মবিশ্বাস। কী এমন শক্তি আছে এইসব শব্দের? আর সবচেয়ে বড় কথা, এসব কথা কেনই বা গালি হয়ে নারীর দিকে ছুটে আসে?

স্লাট (Slut) আসলে কারা? প্রকৃতপক্ষে, এর কোনো ধরাবাঁধা সংজ্ঞা নেই। যে সমাজব্যবস্থায় নারীদের জন্য যে প্রথাগুলো বেধে দেয়া হয়েছে, তার বাইরে যারা যায় – সেই ‘বেয়াড়া’ নারীরাই স্লাট তথা বেশ্যা বলে অভিহিত হয়। আরো শাব্দিকভাবে, স্লাট হচ্ছে তারা যারা কিনা চলনে-বলনে ও আচরণে নিজেদের যৌনতাকে প্রকাশ করে, বা ব্যবহার করে। ডিকশনারি বলছে – ‘‘a woman who has many casual sexual partners”। কোনো নারীর স্লাট হওয়ার জন্য তার যে সত্যিই অনেকজন সেক্সুয়াল পার্টনার থাকতে হবে, তাও কিন্তু নয়, এবং মনে রাখতে হবে, একজন ব্যক্তির এক বা একাধিক সেক্সুয়াল পার্টনার থাকা বা না থাকাটা সম্পূর্ণই ব্যক্তির ইচ্ছে ও স্বাধীনতা। এর বাইরে, সমাজের অনুমিত ড্রেসকোড, প্রথা ও নৈতিকতার মানদণ্ডের বাইরে গেলেই একজন মানুষকে চরিত্রহীন বা স্লাট বলে আখ্যা দেয়া হয়। অর্থাৎ নারীর যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটিকে কেন্দ্র করে সমাজের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চিন্তা, মনগড়া ব্যাখ্যা এবং জাজমেন্টাল আচরণই স্লাট শেইমিং এর উৎস।

সামাজিকভাবে, আমরা দেখি যখন কোনো নারী তার রোমান্টিক ও যৌনজীবন নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলছে, তখন ছি ছি রব পড়ে যায়। এর কারণ – আমরা ধরেই নিই নারীর অবদান সবসময় হবে নিষ্ক্রিয়? নারী চুপচাপ সয়ে যাবে। ভালো লাগুক আর খারাপ লাগুক মুখ ফুটে কিছু বলবে না।

নাটক, সিনেমা, সাহিত্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌনতা পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখানো হয়, যেখানে নারী প্যাসিভ। এমনকি যৌনকর্মের সবচেয়ে সাধারণ রূপটিতেও নারী শুধু গ্রহীতা, নিষ্ক্রিয় দর্শক। তাই যখন নারীরা নিজেদের যৌনতার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া থেকে শুরু করে নিজের পোশাক আশাক, পেশা নির্বাচন, সন্তান জন্মদানের ব্যাপারে মতামত দেওয়া শুরু করে, সেটি সমাজের আদর্শ নারীরূপের সঙ্গে যায় না। সমাজের কাছে প্রত্যাশিত এই যে, নারীর যৌনতা থাকবে, কিন্তু তা সে উপভোগ করবে না। যদি সে তা করে, তাহলে সমাজ অস্বস্তিবোধ করে। এই অস্বস্তি ঢাকতে শুরু হয় সেই নারীকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা: তথা স্লাট-শেইমিং।

স্লাট বলতে নারীটির যৌনতার যথেচ্চার কিংবা নারীটি বেশ্যাবৃত্তি করে, এমন ইঙ্গিত দেয়া হলেও, বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় যাদের এসব কথা বলে হেনস্থা করা হচ্ছে, তারা আক্ষরিক অর্থে যৌনতাবৃত্তি করেন না। তাদের আচরণ যৌনকর্মী বা বেশ্যার অনুরূপ বোঝাতে এই কথাটা বলা হয়।

প্রশ্ন আসে, বেশ্যারা আসলে কেমন হয় যে তাদের সাথে তুলনা করা হলে আমরা লজ্জিত আর অপমানিত হই!

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিতান্ত অভাবের বশে নারী ও শিশুরা এ কাজ করতে বাধ্য হন ও পরবর্তীতে এ থেকে বের হতে পারেন না। বাংলাদেশে যৌনকর্ম আইনি। অন্যদিকে, ধর্ষণবিষয়ক আইনে আবার আইনজীবী ধর্ষিতার সেক্সুয়াল হিস্ট্রি তুলে এনে তাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করতে পারেন, ধর্ষণের অভিযোগ রদ করে দিতে পারেন। দুইটি ঘটনার সমান্তরাল টানলে যেন মনে হয়, যৌনকর্মীদের ধর্ষণ হতে পারে না, বা হলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। এটি এক ভয়াবহ এলিয়েনেশনের উদাহরণ।

বেশ্যারা তৈরি হন পুরুষতন্ত্রের কারণে, পুরুষের চাহিদা মেটানোর জন্য। যদি ‘বেশ্যা’ শব্দটি গালিই হয়ে থাকে, তাহলে যে সিস্টেম নারীকে বেশ্যা বানায় – সে কেন দোষী হবে না? পুরুষতন্ত্র একই সঙ্গে নারীর দেহকে ভোগ করতে চায় অনেকে মিলে, আবার নারীকেই পর্যুদস্ত করে যখন জানতে পারে তার যৌন অভিজ্ঞতা রয়েছে।

স্লাট শেইমিং-এর পক্ষে অনেককে সাফাই গাইতে শুনেছি, ‘‘এর ভয়ে মেয়েরা চরিত্রহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত না হয়’’। এই সাফাই সমাজের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এর এক জলন্ত উদাহরণ। আবার চরিত্রহীনতার প্যারামিটার একেকজনের কাছে একেকরকম। সেই আপেক্ষিক আদর্শের ভিত্তিতে যদি বাছবিচার শুরু হয়, তবে ক্ষুণ্ণ হবে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষ বিচার লাভের সম্ভাবনা। পুরুষতন্ত্র নারীদের এক অসম্ভব ও ধরাছোঁয়ার বাইরের স্ট্যান্ডার্ড মেটাতে বাধ্য করে। এতে নারী হয় দেবী নয় বেশ্যা, সে রাঁধে আবার সে অফিসও করে, বাচ্চাও দেখে আবার পড়াশোনায়ও সে ভালো। নারীর এখানে নিজের আত্মপ্রকাশের, শুধু নিজের জন্য বাঁচার কিংবা ভুল করার সুযোগ নেই। পুরুষ বারবার সঙ্গী বদল করলেও তার মূল্য কমে না, কিন্তু একবার বিয়ে হলে নারীর দেহ যেন পচে যায়। এই যে দেহের ওপর মূল্য আরোপণ, এটি বাধ্য করে সম্মানহীন আর বিষাক্ত সব বিয়েতে মেয়েদের থেকে যেতে।

অভিনয়শিল্পী ও কণ্ঠশিল্পী যুগল তাহসান-মিথিলা’র ডিভোর্স ও তার পরবর্তী ঘটনাগুলো আমরা লক্ষ্য করতে পারি। তারা আলাদা হয়েছেন কয়েক বছর আগে। আমরা দেখেছি মিথিলা পরবর্তীতে বিয়ে করার পরে কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়াতে তাকে তুলোধুনো করা হয়েছে। ধরেই নেওয়া হয়েছে, মিথিলা একজন চরিত্রহীনা বলেই সে আবারও বিয়ে করেছে। এদিকে তার তুলনায় অপূর্ব তৃতীয় বিয়ে করেও কিন্তু এতটা তোপের মুখে পড়েননি।

বসুন্ধরার এমডি আর কলেজছাত্রী মুনিয়ার খবরটা আমরা শুনেছি। মুনিয়ার মৃত্যুর আগের কল রেকর্ডিং শুনে বোঝা যায়, সে ঠিক কতটা মানসিক চাপের শিকার হয়েছিল। ইংরেজিতে এরকম সম্পর্কগুলোকে বলা হয় ‘গ্রুমিং’। একজন ভালনারেবল সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণী আর প্রভাবশালী, ধনাঢ্য ও বিবাহিত শিল্পপতির মধ্যে যে সম্পর্ক – তাতে রয়েছে বিশাল এক ক্ষমতার পার্থক্য। এরকম অসৎ একটি সম্পর্কের করুণ পরিণতি হিসেবে যখন মুনিয়া মারা যায়, মানুষ তখন রায় দেয় – ঠিকই আছে। এরকম অর্থলোভী, চরিত্রহীন মেয়েদের সাথে এরকমই হয়, হওয়া উচিত। অথচ কারো মনে পড়ল না পুরুষটির চরিত্রের ময়নাতদন্ত করার কথা।

স্লাট-শেইমিং নারীদের জন্য একটা সীমা এঁকে দেয়। এই সীমার বাইরে গেলেই তাদের মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মানটুকুও দেওয়া হয় না। তখন তারা শুধুই ভোগ্যবস্তু হিসেবে গণ্য হয়। এই অমানবিকীকরণ (Dehumanization) এর কারণ নারীর উপর নৈতিকতা পুলিশিং চালানো। সমাজকে বুঝতে হবে যে একজন নারী যদি তথাকথিত সংজ্ঞানুসারে ‘স্লাট’ হয়ও, তবু সাংবিধানিক অধিকার তার প্রাপ্য।

জন্মের পর থেকেই শিখিয়ে দেওয়া হয় কারা ভালো মেয়ে, আর কারা খারাপ মেয়ে। এই বিভাজন অনেক সময় মেয়েরাও আত্মস্থ করে ফেলে। নারী যদিও পুরুষতন্ত্রের ভিক্টিম, সে নিজেও অনেক সময় হয়ে ওঠে পুরুষতান্ত্রিক। সমাজের শেখানো ভালো মেয়ের সংজ্ঞায় যারা পড়ে না, মেয়েরাই তাদের গঞ্জনা দিতে শুরু করে।

স্লাট শেইমিং-এর কারণে অনেক নারীর যথাযথ অভিযোগ সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক অগ্রাহ্য হয়েছে। অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন মানবাধিকার থেকে। এই নিদারুন অভিজ্ঞতার কারণে অনেক নারী মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বাধ্য হয়েছেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে। স্লাট শেমিংকে নির্মূল করার জন্য সমাজের মানসিকতা বদলাতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, ‘বে*শ্যা, মা*গী’ – এসব আক্রমণাত্মক শব্দের ওজন তখনই থাকবে যখন আমরা এদের গুরুত্ব দেব। ধীরে ধীরে সমাজ আরোপিত কঠোর প্রথাগুলো থেকে আমরা বেরিয়ে আসব, যেখানে নারীরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারবেন নির্ভয়ে – এই আমাদের প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *