November 3, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

‘ওহ তুমি তো আবার নারীবাদী!’

সাদিয়া মেহজাবিন।। অনেকে গালিকে ভাষার ঐতিহ্য হিসেবে মানেন। গালি অবশ্যই একটি ভাষা কিন্ত এ ভাষার প্রেক্ষাপট এবং ব্যবহারের প্রয়োগ, সহজে আপনার মানবিক ভাবনাগুলোর সম্পর্কে অপরজনকে একটা চিত্রপট ভাবার সুযোগ দেয় যা খানিক খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। গালিকে অনেকে ঐতিহ্য হিসেবে অহংকার করে। তবে গালিগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখায় যায় প্রত্যেক উচ্চারিত শব্দে থাকে প্রচুর পরিমাণে বিদ্বেষ, বর্ণবৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য সাথে বিরাট অংশ থাকে অন্যকে অবমাননাসহ বিপুল নারীবিদ্বেষ। আমি একসময় ভেবেছিলাম গালি নিয়ে একটা শব্দকোষ বানাবো। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, প্রত্যেক শব্দের বিশ্লেষণে এত পরিমাণ নারীবিদ্বেষ কথা দেখে আমি রীতিমত দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু আমার একটা সাবলীল প্রশ্ন হলো, গালি কি আপনার অজান্তে পরিবেশ দ্বারা রচিত তথাকথিত মনোবাসনা নয়? অথবা হাজার বছর ধরে সমাজে অন্যকে অবমাননা করার একটা বিচ্ছিরি কৌশল নয়? তাহলে এই উচ্চারিত গালিগুলোতে এত নারীবিদ্বেষী ভাব, বর্ণবৈষম্য আর শ্রেণিবৈষম্য কেন? কারণ আপনারা সম্পূর্ণরূপে এমনই ছিলেন, হয়তো এরচেয়ে ভালো বা খারাপ ছিলেন কিন্তু আপনাদের মনে সুপ্ত বাসনা শোষণই ছিল। আমি মানতে বাধ্য হই দীর্ঘ বছর ধরে ইংরেজ, পাকিস্তান ইত্যাদির শোষণ দ্বারা আপনারা জর্জরিত কিন্তু যখনই সময়ের তাগিদে এগিয়ে এসে আধুনিকতার লেবাস আপনারা ধরেছিলেন তখন কেন আপনাদের মনে হয়নি, আপনাদের নিজেদের বদলাতে হবে?

আমি জানি এখন চট করেই আপনার আঙ্গুল আমি বা আমরা যারা এসব লিখছি, তাদের উপর উঠবে। তাহলে বলে রাখি আমিও তুলসী পাতায় ধুয়ে মুখে গালি না তুলে সাবিত্রী সেজে বসে থাকি না। হ্যাঁ সময়ের প্রয়োজনে আমিও প্রচুর গালমন্দ করি কিন্তু আমি বা আমাদের সমাজ কি এমন হতে চেয়েছিল? নিশ্চিত যারা কাণ্ডারি হাতে তলোয়ার নিয়ে ঘাড়ে চেপে আছেন তারাই আমাদের যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক নারী হিসেবে তৈরি করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। এখন ছোট একটি প্রশ্ন, এই আপনারা কারা? যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তারাই কি শুধু এর অংশ? নাকি যারা মেছো বিড়াল সেজে বসে আছেন তারাও?

লিখতে গিয়ে বেশি প্রশ্ন করছি দেখে এখন আবার গালমন্দ করতে পারেন তবে নিজের অভিজ্ঞতাকেই আশ্রয় করে কিছু বিষয় পরিস্কার করি। বিভিন্ন সময় আমার লেখালেখি সূত্রে মানুষ আমাকে বাগে ফেলতে এবং সুযোগ পেলেই নানান প্রশ্ন করে, প্রমাণ করতে চেষ্টা করে আমি যা লিখি তার বেশিরভাগ আমি বিশ্বাস করি না অথবা এসবে আমি দ্বিমুখী। আর কোনোক্রমে ভুল ত্রুটি পেলেই একটা গালি ব্যবহার করে – ‘নারীবাদী’। হ্যাঁ আমি হলফ করে বলছি তারা আমাকে তখন গালিই দেন। শুধু আমাকে না, অনেককেই ‘নারীবাদী’ বলে গালি দেন। ধরুন আপনার পার্টনার কোনো ইনকাম না করে, ঘরে বসে আপনাকে ঘরের কাজে সাহায্য করলো তখন প্রশ্ন করলো – আপনি এই ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখবেন? মানে বলতে চাইছে যুগ যুগ ধরে নারীরা যেভাবে ঘরের কাজ করে আর পুরুষেরা বাইরে যায়, তা যদি উল্টো হতো তখন? আমার একটা সহজ উত্তর, কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ মন চাইলে ঘরে বা বাইরে কাজ করতে পারে কিন্তু আমার পরামর্শ থাকবে কারো উপর কেউ যেন বোঝা না হয়, যে যার যার কাজ করুক আর দুজন দুজনকে সাহায্য করুক। আর ঘরের কাজ করে দাসীর মত খাটা খুবই বিরক্তিকর তাই স্বাধীনভাবে নিজের কাজ খুঁজে নেওয়া উত্তম। তাছাড়া প্রত্যেকের অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত এবং সাবলম্বী হওয়া উচিত।

এখন উত্তর তাদের পছন্দ হোক বা না হোক, তারা ভেবে নেয় আমি বেকার পার্টনার পছন্দ করি না এবং আমাকে ‘কী নারীবাদী হইছো’ বলে গালি দিয়ে চলে যায়। আবার অনেকে ছোটখাট ভুল চোখে দেখলেই ‘ওহ তুমি তো আবার নারীবাদী’ বলে গালি দেয়। যারা এসব গালি দেন তাদের ভেতর প্রগতিশীলদের সংখ্যাই বেশি।

সমসাময়িক কিছু ঘটনা আমাদের সামনে আসছে। মন্ত্রী মুরাদ সাহেব খালেদা জিয়া ও তার নাতনীকে নিয়ে বেশ গালমন্দ করেছে, শ্লীলতাহানী করেছেন এবং সদ্য পাওয়া কিছু তথ্যে দেখা যায় উনি বেশ গালাগালিও করছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন এই মুরাদ সাহেব কি একজন নাকি তার পেছনে একটা গোটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজও আছে? তিনি কি ঐ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন না? ভাবনার জট খুললে দেখতে পাবেন বাংলাদেশের অনেকের সুপ্ত মনোবাসনা এসব শব্দ এবং গালি। চলতে পথে বেশিরভাগ মানুষ এসব গালিই দেন, এবং গালি ঐতিহ্য বলে এটাকে সংস্কৃতি বানিয়ে ফেলছেন। এখন পুরুষদের কি এসব গালি দেওয়া, চরিত্র নিয়ে কথা বলা অথবা তাদের শ্লীলতাহানী হয় না? হয়, তবে মনে রাখবেন পুরুষতন্ত্রের কুফল স্বয়ং পুরুষদেরকেও ছাড়ে না। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। তেমনই যে আগুন আপনারা অন্যদেরকে দেন তা দিনশেষে আপনাদের নিজেদের গড়া দেবালয়কেও পুড়িয়ে ছাড়বে। যদিও  অনেক পুরুষ নিজেদের চরিত্র নিয়ে কেউ গালি দিলে বেশ মজা পান এবং দাম্ভিক আচরণ করেন, কেননা আপনাদের ধারণা এইসব কর্ম পুরুষদেরই করার কথা। যদি আপনি সমীকরণ মেলাতে যান তাহলে দেখবেন, নারীরা যাই করুক সবই খারাপ এবং নারীদের জন্যে তাদের নিজেদের একটা নীতিবই আছে। আপনি যাই করেন তারা নিজের মা বোন বাদ দিয়ে বাকি সকলকে বিচ্ছিরি গালি দেবেন এবং সময়ে নিজের মা বোনদেরকেও ছাড়ে না।

ফেসবুকের নিউজফিড ঘুরে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা লিখেছেন, ‘যারা সময়ে অসময়ে আমাদেরকে নারীবাদী বলে গালি দেন এবং এখন কেন নারীবাদীরা প্রতিবাদ করছে না বলে আবার গালি দিচ্ছেন, ভাই তারা কি আমাদেরকে দেখেন না? নাকি আমাদেরকে নারীবাদী ভাবেন না?’ ব্যাপারটা আসলেই সত্য। আপনারা শুধু গালিই দেবেন কেননা আপনারা এমনই। আপনাদের অন্তরে প্রচুর ঘৃণা এবং নারীবিদ্বেষ। আপনারা সুযোগে শুধু গালি দেবেন কিন্তু নিজেদের দিকে আঙ্গুল তুলে কিছু বলবেন না। অথবা প্রশ্ন করবেন না মুরাদ বা এই হাবিজাবি বাকি সবাই কেন এমন করলো, বলবেন না যে মুরাদের এটা করা অন্যায় বা এর শাস্তি হওয়া উচিত। আপনারা আজন্ম কিছু বুলি শিখেছেন, শুধু তা আওড়াচ্ছেন কিন্তু নিজেরকে এবং সমাজের এই অন্যায় অবিচার নিয়ে আপনারা বিন্দুমাত্র চিন্তিত না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *