বিবেক মরে যাওয়ার আগে একটা চড়!
শাফকাত আনোয়ার ।। উইল স্মিথের চড় মারার ভিডিও দেখলাম। কৌতুকের ব্যানারে সীমালংঘন করাটা কতখানি যুক্তিযুক্ত, কিংবা এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভায়োলেন্ট হয়ে যাওয়াটা ঠিক কিনা, এই নিয়ে অনেক আলোচনাও দেখছি সকাল থেকে। আসলে মানুষের সংবেদনশীলতা আজকাল কৌতুকের নামে কিংবা প্র্যাঙ্কের নামে কতখানি উপেক্ষিত, সেটার ইংগিত পাওয়া যায় এই ঘটনাগুলো থেকে। উইলয়ের খারাপ লেগেছে, এবং খারাপ লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। সে মনে আঘাত পেয়েছে, তার জবাব সে দিয়েছে শারীরিক আঘাত করে। এখন কোন আঘাতটা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, এটাই উঠে এসেছে আলোচনায়। শারীরিক ত্রুটি নিয়ে কটাক্ষ করে মানসিক আঘাতকে ততখানি ধারালো মনে হচ্ছে না, যতটা শক্ত মনে হচ্ছে চড় মেরে শারীরিক আঘাত করাটা। আবার উইলকে মানসিকভাবে আঘাত ক্রিস রক একা করে নাই, তার সাথে সাথে সমস্ত দর্শক করেছে, হাসতে হাসতে আনন্দ পেতে পেতে। এই যে অন্যের দুর্বলতাকে ক্যাপিটালাইজ করে কৌতুক বানিয়ে আনন্দ বিক্রি করার এই সংস্কৃতি, এটা তো একদিনে তৈরি হয়নাই। প্রতিবাদ করার ধরণটা যাই হোক, কয়জন প্রতিবাদ করেছে এর আগে? একদিন একজন প্রতিবাদ করে, তাকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়, তার বেনেফিট কিন্তু পরে বাকিরা নেয়। অন্যকে আঘাত করে বিনোদন তৈরি করার আগে এইসব কৌতুক বা প্র্যাঙ্ক যারা করেন, তারা হয়তো এবার দুইবার চিন্তা করবে। কিংবা কি জানি, নাও করতে পারে। কয়জন স্রোতের বিপরীতে চলার হ্যাডম রাখে?
এটাই হয়না। প্রতিবাদটাই কেউ করে না। লোকে কী বলবে, ক্যামেরায় ধরা পড়বে, কী দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে, এমন ভেবে ভেবে কেউ প্রতিবাদ করেনি কখনও। ব্যক্তিগত আক্রমন করা যে এক ধরণের অশ্লীলতা, সেটা জেনে বুঝে আঘাত পেয়েও চুপ থেকেছে বেশিরভাগ ভিকটিম। হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভান করা, কিংবা আমিও মজা পেয়েছি ভাব দেখানো, এমন কুৎসিত সংস্কৃতিকে উস্কে দিয়েছেই কেবল।
আমি যখন পাব্লিক কিছু গ্রুপের পোস্টে অন্যদের কমেন্ট দেখি, তখনই হতাশ হয়ে যাই। আশিভাগ মন্তব্য থাকে অপ্রাসংগিক। কেউ হয়তো একটা সমস্যার সমাধান চেয়ে পোস্ট দিলো। তার নিচে কেউ সেই সমস্যা নিয়ে কৌতুক করবে। কেউ অনর্থক বাজে রসিকতা করবে। কেউ ইসলামের বাণী দেবে। কেউ অন্য আরেকটা পেইজের লিঙ্ক দেবে। প্রাসংগিক মন্তব্য খুঁজে পাওয়া দুরূহ রীতিমত। এই নিয়ে কাউকে উচ্চবাচ্য করতে দেখি না, যেন বাজে কথা বলা বা সময় নষ্ট করা খুব স্বাভাবিক একটা কাজ। উল্টো মূল পোস্টের তুলনায় এই কমেন্টগুলাই হয়ে যায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কেউ যে একটা সাহায্য চেয়ে বসে আছে, সেটা কারো মাথাতেই থাকে না আর।
এই তো আমরা! প্রসঙ্গের বাইরে কথার অপচয় করি। সময় আমাদের কাছে সবচেয়ে সস্তা জিনিস তাই খরচ করি অশোভন কিংবা অপ্রয়োজনীয় কাজে। কারো উদ্যমে সাহায্যের হাত বাড়াই না, তাকে উৎসাহ দেইনা, কিন্তু তাকে আঘাত করি এবং তাচ্ছিল্য করি। কারণ জাতিগতভাবেই আমরা অলস, পরনিন্দুক, পরশ্রীকাতর। আমরা চ্যারিটি চাইবো, তা দিয়ে ফুটানি করবো কিন্তু দশ টাকা নিজে খেটে কামাবো না। কারণ সেটা দশ টাকা। চ্যারিটি মানে তো কম করে হলেও পাঁচশ টাকা। তাই কেউ যদি লোক ঠকিয়ে অলস হাত না পেতে, খাটনি করে দুই টাকাও কামায়, আমরা তাকে দুয়ো দেই, কারণ সে আমাদের মত ফুটানির রাস্তা ধরে নাই, তার শ্রমের প্রতি হিংসায় আমরা তার আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করি। কেউ কিন্তু আমাদের এই আচরণের প্রতিবাদ করে না, যেন এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এরপর যদি দুর্বলের প্রতি আমাদের আচরণ দেখি তখন আরেক ধরণের নোংরামি চোখে পড়ে। আমরা জানি, সে একা বা অক্ষম, তাকে দুইটা আঘাত করলেও সে পেরে উঠবে না। আমরা সেটা করে বাজে আনন্দ পাই। রাস্তার কোণায় পড়ে থাকা ছোট্ট কুকুরছানাটাকে আমরা সুযোগে দুইটা লাথি মেরে দেই। পথে ফুল বিক্রি করা ছোট ছেলেটাকে ছেঁড়া টাকাটা ধরিয়ে দেই। অফিসের মাথা নিচু করে কাজ করা নতুন কলিগটাকে নিয়ে প্র্যাঙ্ক করি। আর ইজি টার্গেট নারীদের আশেপাশে হেঁটে যাওয়ার সময়ে বাজে কিছু মন্তব্য করি কিংবা গায়ে হাত দিয়ে বসি। নারীকে প্রতিবাদ করতে দেখাটাও আমাদের জন্য এন্টারটেইনিং, সেটাও এঞ্জয় করি আমরা। ইচ্ছা করে মহিলাদের স্টিরিওটাইপ করি, তারা যদি নিঃসংকোচে পুরুষের সাথে মেশে তাকে বলি স্লাট, তারা যদি উঁচু পদে কাজ করে তাদের বলি অপরচুনিস্ট। আর এর প্রতিবাদ কেউ করলে আমরা আরো কুৎসিত আনন্দ পাই, আরো বেশি বাজে কথা বলতে থাকি। কারণ যে প্রতিবাদ করে সে তো একাই করে, অন্যেরা তো সেটা করেনা, তারা ভয় পায় কিংবা মজা নেয়।
আমার কর্মজীবনের কথাই বলি। খুব সম্প্রতি যেখানে কাজ করেছি সেখানে কয়েকজন পুরুষ সহকর্মী ছিলেন, যারা আমাকে সহকর্মী হিসেবে দেখার আগে, দেখতেন একজন নারী হিসেবে। এটাকে অবশ্য বাংলাদেশের মানুষেরা বিকৃত আচরণ হিসেবে গণ্যই করে না, কারণ তারা জন্ম থেকে এমনটাই হয়ে আসতে দেখেছে। কাজের জায়গায় কাজের উপরে প্রাধান্য পায় আপনি নারী কিনা, সিংগেল কিনা, দেখতে ভাল কিনা, ফিগার ঠিকঠাক কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কেরিয়ারের শুরুতে আমি এমন আচরণ দেখলে খুব প্রতিবাদ করতাম। পরে দেখলাম এই করতে গিয়ে কেরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাড়ার অশিক্ষিত দারোয়ানের চাইতে, এই শিক্ষিত অফিসের ভদ্রবেশি পুরুষ সহকর্মীদের পারভার্শন কোনো অংশেই কম না। তাদের আপনি মেধা দিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে গেলেই তারা আপনার পরিবার নিয়ে কথা বলবে, নারীত্বের মানদণ্ডে যাচাই করবে আপনাকে। আবার উল্টা খেলাও খেলতে পারে যে – ‘আমরা রাত পর্যন্ত অফিসে থাকি আপনি থাকেন না কেন। আপনি না বলেন ছেলে মেয়ে হিসাব না করতে?’ আমাকে তখন বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে, কী করবো, ঘরে তো বউ নাই, আপনার যেমন আছে। এমন জবাব আপনি যত দেবেন, তারা তত রুষ্ট হবে, তত আপনাকে নিয়ে গসিপ করবে। আর মজার ব্যাপার তো এটাই, একটা মহিলাকে নিয়ে গসিপ সবার জন্য খুব মুখরোচক খাদ্য এই দেশে। যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে এবং হতেই থাকবে। কারণ একটাই। কেউ প্রতিবাদ করে না।
আপনি হাল্কা করে নিষেধ করলে এরা সেটা গায়েই মাখায় না। তাই এক সময় আপনাকে প্রতিবাদ করতে হয় জোরালোভাবে। লোক দেখিয়ে, উদাহরণ সৃষ্টি করে। তাতে নিশ্চয়ই আপনাকে ঘিরে রোষ তৈরি হবে। আবার এমন কিছু কাপুরুষ আছে যারা বাইরে বাইরে আপনার চরম সমালোচনা করবে আবার গোপনে আপনাকে মেসেজ পাঠিয়ে থ্যাঙ্ক ইউ জানাবে। কেউ এটা দেখে না যে দেয়ালে কতখানি পিঠ ঠেকে গেলে একজন মানুষের প্রতিবাদের ভাষাটা এমন চরম হয়। ভদ্রতা দিয়ে যখন আপনি কারো অভদ্রতা থামাতে পারবেন না, তখন আপনাকে তার ভাষাতেই কিংবা তার চেয়েও বাজে ভাষাতে আংগুল তুলতে হয়।
নাহয় খারাপ কিছু দেখতে দেখতে হজম করতে করতে মানুষের চোখ সয়ে যায়, তারা খারাপকেই নেইম অফ দ্যা গেইম ভেবে নিজেরাও স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়।
যে কোনো ধরণের আঘাতই খারাপ। সেটা বুলিয়িং দিয়ে হোক, বাজে মন্তব্য দিয়ে হোক, কিংবা চড় দিয়েই হোক। তার চেয়ে বেশি খারাপ সহ্য করে যাওয়া, তার চেয়েও বেশি খারাপ অন্যায়ের আস্কারা দেওয়া। কিংবা অন্যায়কারীকে পাওয়ারফুল ভেবে তার পা চেটে স্বার্থসিদ্ধি করা। কেউ যতদিন প্রতিবাদ না করবে, অন্যায় চলতেই থাকবে এবং সেটা একসময়ে স্বাভাবিক বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েই যাবে। তখন হঠাৎ একদিন যদি আপনি প্রতিবাদ করেই বসেন আপনাকে উল্টো হাসির পাত্র হতে হবে স্রোতের বিপরীতে চলার অপরাধে। আপনি হাল্কা প্রতিবাদ করলে তখন আর কাজ তো হবেই না, বরং কড়া কিছু করতে হবে। হ্যাঁ, সাইড এফেক্ট হিসেবে নিজের গায়ে কিছু বাজে তকমা লাগাতে হবে, সমালোচিত হতে হবে। কিন্তু কেউ কেউ আবার আপনাকে ইনবক্সে লুকিয়ে লুকিয়ে ছোট্ট করে থ্যাঙ্ক ইউটাও হয়তো দেবে।
আসলে, সকলে যখন ধরেই নেয় যে সহ্য করা মানেই ভদ্রতা, তখন একটা দুইটা চড় আসলে মারা দরকার। আপনাদের সবার ঘুমিয়ে থাকা বিবেক পুরোপুরি মরে যাওয়ার আগে একটা লাস্ট অ্যাটেম্পট তো নেওয়া দরকার।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]