November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

একজন পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবে আমি লজ্জিত!

তৌকির ইসলাম ।। আশামণির লিখে যাওয়া শেষ চিঠি বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরে বেড়িয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চিঠিতে উঠে এসেছিল এক কিশোরীর পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিজ পরিবারের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে আত্মবলির কথা। এই চিঠি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে আমরা কতটা অসহায়!

আশামণির চিঠির সবচেয়ে মুখ্য বিষয় ছিল তার পরিবারের সম্মান বাঁচানো। কিন্তু আশামণি কোনো অপরাধ করে নি, কোনো অন্যায় করে নি বরং অন্যায় হয়েছে তার সাথে। আর তাকেই ভাবতে হয়েছে নিজের পরিবারের সম্মান বাঁচানো নিয়ে। পুরুষতান্ত্রিকতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে যে ভার্জিন না হলে কিংবা কোনোভাবে ভার্জিনিটি রক্ষিত না হলে নারীর কিংবা নারীর পরিবারের কোনো সম্মান নেই। আশামণি হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে, তার পরিবারকে মানসিকভাবে কোনোদিনই বাঁচতে দেবে না। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি করা ব্যবস্থায় নারীকে শুধু দেহসর্বস্ব বস্তু ভাবা হয়, মানুষ নয়। আশামণির সাথে যা ঘটেছে তাতে সম্মান যাওয়া নিয়ে ভাবার কথা ছিল অপরাধীর পরিবারের। কেননা অন্যায় করেছে তাদের পরিবারের সন্তান। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো।

সমাজে প্রতিষ্ঠিত কুমারীত্ব, ভার্জিনিটি, সতীত্ব এসব শব্দ যতদিন থাকবে ভিক্টিম ব্লেইমিং হবে তত ইজি। শুধু কি ধর্ষণ! আমরা যদি সমাজের পুরুষের করা অন্যায়ের দিকে তাকাই সব দিক দিয়েই দেখতে পাব যে নারীকে কোনো না কোনোভাবে দোষ দেওয়া হচ্ছে। কোনো মেয়ে ইভটিজিং এর শিকার তো দেখা যাবে যে ছেলের পরিবার বলবে মেয়ে ঐভাবে অল্পবয়সী ছেলেদের সামনে চলে কেন! স্বামী পরকীয়া করছে তো সমাজ বলবে বউ মনে হয় ভালো নয়। আশামণি এই ব্যাপারগুলো বুঝতে পেরেছিল। আর সে যে ন্যায়বিচার পাবে না তাও সে জানতো হয় তো। আর তাই তো নিজের জীবনকে বলি দিতে সে ভয় পায় নি। আশামণির আত্মহত্যাকে আমি আত্মহত্যা বলতে পারি না বরং তাকে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব হত্যা করেছে।

আমরা কত আশামণির গল্প শুনতে পাবো তা হয়তো আমরা জানি না কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যে আমাদের কাউকেই ভালো থাকতে দেবে না তা কিন্তু আশামণি আরও একবার জানান দিয়ে গেল। নারীর সতীত্বের কনসেপ্ট পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি। নারীর ব্যাপারে সমাজের মগজ ধোলাইয়ের জন্য সতীত্ব কনসেপ্টকে খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যৌনকর্মীর বুকে যে পুরুষ খদ্দের হয়ে দিনের শেষে মুখ লুকায়, সকালে তার পাপ সমাজে ঠিকই মুছে যায়, যৌনকর্মী না পারে সমাজে ফিরতে, না পায় সম্মান। কেননা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে যার ভার্জিনিটি নেই তার কোনো সম্মান নেই। কিন্তু সম্মান আসলে কার নেই সেটাই বোঝার বিষয়।

সতীত্ব অথবা কুমারীত্ব নিয়ে কথা উঠলে অনেকে আবার ধর্মের কথা নিয়ে আসেন, ধর্মীয় অনুশাসনের কথা শোনান। একজন মুসলিম হিসেবে আমি যতটুকু জানি বা বুঝি আশামণির সাথে যা হয়েছে ধর্মীয় আইনে ধর্ষকের শাস্তি হওয়ার কথা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তা নিয়ে এখন সেই সকল ধার্মিকদের কোনো শব্দ নেই। তাহলে নারীর জন্য ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়া কেন! ধর্ম তো নারী-পুরুষ সকলের জন্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধর্মের অপব্যাখ্যা করে নারীকে শোষণ করেছে বারবার। নারীর সতীত্বের কথা উঠলেই যারা ধর্মকে টেনে নিয়ে আসেন তাদের একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার শাস্তি সমানভাবে অ্যাডাম এবং ইভ দুইজন পেয়েছিলেন, শুধুমাত্র ইভ একা নয়।

পুরুষতন্ত্র শুধু নারী নয় সমাজের প্রতিটি মানুষকে অন্যায়ভাবে অত্যাচার করে যাচ্ছে। যে নারী মনে করে পুরুষের সকল অন্যায়ের অধিকার আছে, সেও পুরুষতান্ত্রিক। তার কাছেও সমাজ নিরাপদ নয়। আশামণি মরে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে যে কি এক ক্ষতিকর অথর্ব অবস্থায় আছি আমরা।

মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে ঠিক কতটুকু বাবা-মাকে মিস করার আকুতি থাকলে শেষ শব্দ হিসেবে লেখা যায় “সোনা বাবা-মা” তা আমার জানা নেই। একজন পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবে আমি লজ্জিত!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *