উৎসব যেন জেন্ডার রোলে আটকে না যায়
আমি আমার ছোটবেলায় দেখেছি ঈদ মানেই মায়েরা রান্নাঘরে ঘামে জবজবে হয়ে থাকেন। বিশেষ করে কুরবানির ঈদের দিনগুলোতে সন্ধ্যার আগে তাদের রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যেত না। প্রতিটা ঈদের রান্না শুরু হতো ঈদের আগের দিন। এই রান্নার পাট মায়েরা চুকাতেন ঈদের দিন বিকাল সন্ধ্যা অব্দি। এরপর ঘামে ভেজা কর্মক্লান্ত মায়েরা ধীরে সুস্থে স্নানঘরে ঢুকতেন। স্নান শেষে কোনোরকম একটা সুতি শাড়ি শরীরে জড়িয়ে হয়তো খেতে বসতেন সারাদিন পর। ঈদের দিনে সবাই যখন সকাল বেলায় ডাইনিং টেবিলে বসে মায়ের রান্না করা নানান সুস্বাদু খাবার খেত, মায়েরা তখনও রান্নাঘরেই হাড়ি ঠেলতেন। এই ছিল চিরাচরিত দৃশ্য।
বেগম রোকেয়া বাঙালির রসনা বিলাস নিয়ে লিখেছিলেন। এই বিলাসের সাথে নারীর এই শ্রম আর সবার স্বাস্থ্যগত দিকটির ঝুঁকির কথা তুলেছিলেন। সেই কত বছর আগের লেখা। আজো কি বাঙালি নারী রান্নাঘরের এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে? এমনকি উৎসবের দিনেও?
পরিবারের আনন্দ, প্রথা, সন্তানের প্রতি ভালবাসা স্নেহ, সকলের প্রতি কর্তব্য, মেহমানদারি, সামাজিকতার ধরে রাখার নাম করে এতে নারীকেই নানাভাবে ব্যবহার করা হয়। নারীই হয় সব কর্মের শ্রমদাসী। পুরুষ আতর মেখে ঈদের নামাজে যায়, ফিরে রেডি সেমাই চটপটি খায়। এরপর টিভি দেখে। মেহমানদের সাথে কোলাকুলি করে। বাড়ির নারীটি তখন ত্যানা ত্যানা কাপড় পরে রান্নাঘরে পোলাউ রাঁধে, কোরমা রাঁধে। ছুটে ছুটে মেহমানদারি করে। গৃহসহকারীর সাথে টেবিলে খাবার লাগায়। এই তো নারীর জীবন। কুরবানির ঈদে মাংস না আসা অব্দি নারীর কাজ শেষ হয় না। মাংস এলে পা ছড়িয়ে বসে সেই মাংস রাত পর্যন্ত বাছা, ধোয়া, কোটা, ভাগ করা ও রান্না করে খাইয়ে এরপর নারীর রান্নাঘর থেকে মুক্তি। আদৌ কি মুক্তি বলে নারীর জীবনে কিছু আছে?
আধুনিক কর্মজীবী নারীরা হয়তো অনেকটা বেরিয়ে আসতে পেরেছেন এসব থেকে। কিন্তু মনে রাখবেন এদের সংখ্যাটা খুব কম। বেশিরভাগ নারীকেই এখনো ওই রসনা বিলাসের দায়ে দাসীবৃত্তি করতে হয়। পিতৃতন্ত্রের মূল ক্ষমতা কৌশলই হলো নারীর দাসত্বকে জিইয়ে রাখা।
উৎসব যেন কারু জীবনের দাসত্বের বোঝাকে উৎকট আর কুশ্রী করে না তোলে। উৎসব যেন জেন্ডার রোলে আটকে না যায়। উৎসব যেন কাউকে এক্সপ্লয়েট করার মাধ্যম না হয়ে ওঠে।
ঈদের শুভেচ্ছা সবাইকে।