April 29, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ২

সহী ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র ও নারীর বিরুদ্ধে মুসলিম পিতৃতন্ত্র

বাংলা ভাষার ব্লগার, সামাজিক – রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এক সময়ের সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, যিনি স্বপ্ন দেখেন একটি লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক সংস্কৃতি ও সমাজের। নারীবাদ তাই তার চিন্তা, পড়াশোনা ও লেখালেখির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন – ইসলামী নারীবাদ: মুসলিম পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষের সংগ্রাম। আজ পড়ুন এর তৃতীয় পর্ব।।

নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নে কুরআন ও হাদিসের বয়ান নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা রয়েছে আধুনিক কালের বিশ্বাসী মুসলিম নারীবাদীদের লেখালেখিতে। তার বিস্তৃত উল্লেখ এই লেখার পরবর্তী পর্বগুলোতে হাজির করা হবে। তবে এই পর্বের জন্যে কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু পরস্পর সম্পর্কিত প্রসঙ্গ উত্থাপন করার চেষ্টা করা হবে। এই পর্বের প্রসঙ্গগুলো ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক আলাপের চত্বরে বহুবার উল্লিখিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গগুলো হয়তো কেবলমাত্র নারীবাদের জন্যেই প্রাসঙ্গিক নয়, মোটের উপরে ইসলামের রাজনৈতিক আলাপের জন্যেও প্রাসঙ্গিক; কিন্তু ইসলামী নারীবাদীদের প্রায় সবাই নারীর মুক্তির প্রশ্নে, বিশ্বাসী মুসলিম নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নে তাদের আলোচনার পদ্ধতির অংশ হিসাবে এই প্রসঙ্গগুলোকে হাজির করেছেন।

প্রথম প্রসঙ্গটি হচ্ছে ইসলামের বিশ্বাস ও মুসলিম মানুষদের কর্ম প্রসঙ্গে। একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। নিউজউইক, টাইমস ও টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক কারলা পাওয়ার (Carla Power) ইসলাম, মুসলিম জনগোষ্ঠী ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে পড়তে শুরু করেছিলেন, আরবি ভাষা শিখেছিলেন এবং কুরআনের পদ্ধতিগত পাঠ আয়ত্ত করেছিলেন। তার একটি সংবাদ নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি কুরআন পাঠ করতে শিখেছিলেন ভারতীয় ইসলামী স্কলার শেখ মুহাম্মদ আকরাম নদভীর কাছ থেকে। শেখ আকরাম নদভী হচ্ছেন সেই মুসলিম স্কলার, মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই যার খ্যাতি ছড়িয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ‘ইসলামের ইতিহাসে নারী’ এই প্রসঙ্গে যিনি ইতিমধ্যেই এক ধরনের কর্তৃপক্ষীয় জ্ঞান অর্জন করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে প্রায় নয় হাজার নারীর ভূমিকা নিয়ে তিনি রচনা করেছেন মোট ৫৩ খণ্ডের এক সুবিশাল গ্রন্থসমগ্র। পরবর্তীকালে, মুহাম্মদ আকরাম নদভীর সাথে কারলা পাওয়ার তার দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্ব ও তাঁর কাছ থেকে কুরআন পাঠের অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভর করে বই লিখেছেন If the Oceans Were Ink: An Unlikely Friendship and a Journey to the Heart of the Quran। কারলা পাওয়ার এর লেখা এই বইটি পুলিৎজার পুরস্কারের জন্যে চূড়ান্ত মনোনয়ন লাভ করেছিল। সাংবাদিক পাওয়ার তাঁর বইটি শুরুই করেছেন ইসলামের গ্রন্থগত বয়ান ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনুশীলন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাঝে যে বিপুল ফারাক সেই প্রসঙ্গ দিয়ে। তিনি মুহাম্মদ আকরাম নদভীর জবানীতে উল্লেখ করেছেন একটি ভারতীয় অভিজ্ঞতা –

ভারতের উত্তর প্রদেশের এক গ্রামে একবার এক হিন্দু প্রতিবেশী তার এক মুসলিম প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে বললেন,
— তুমি কি আমাকে কুরআনের একটি কপি দিতে পারো?

মুসলিম প্রতিবেশীটি খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন,
— নিশ্চয়ই, আমার কাছে বেশ কয়েকটি কপি আছে, তোমাকে একটি দিচ্ছি।
কিছুদিন পরে হিন্দু প্রতিবেশীটি কুরআনের কপিটি ফিরিয়ে দিতে এসে তার মুসলিম প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসা করলেন –

— আমি তো তোমার কাছ থেকে কুরআনের একটা কপি চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে ‘আসল’ কুরআনের একটা কপি দিতে পারো?

মুসলিম প্রতিবেশীটি বেশ অবাক হয়ে বললেন,
— আমি তো তোমাকে কুরআনেরই একটা কপি দিলাম, তুমি পড় নি?

হিন্দু প্রতিবেশীটি বিস্ময়ের সাথে পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেন,
— ওহহ আচ্ছা, এটাই কুরআনের কপি? আমি এই কপিটি পড়েছি, এটাই যদি কুরআন হয়ে থাকে তাহলে মুসলমানেরা যা বলে, যা করে, যা ভাবে সেসবের উৎস কী? অন্তত এই কুরআন নয়।

শেখ মুহাম্মদ আকরাম নদভী একজন দেওবন্দী ইসলামী আলেম। উপরের ঘটনাটি কৌতুকাচ্ছলে বললেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে ঘটনাটি সত্যি। তিনি কারলা পাওয়ারকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইসলামের সবচাইতে ট্র্যাজিক দিক হচ্ছে, এর অনুসারীরা যা করেন, যা বলেন, যা ভাবেন তার সাথে কুরআনের মূল বয়ানের মিলের চাইতে অমিলই বেশি। এমনকি কুরআনের একই আয়াত বা শ্লোকের হাজার রকমের মনুষ্য ব্যাখ্যা চালু রয়েছে এর অনুসারীদের মাঝে। এই ব্যাখ্যাগুলোর কোনো কোনোটি আবার একেবারেই পরস্পরবিরোধী। একই সমস্যার উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত ইসলামী নারীবাদী আমিনা ওয়াদূদ তাঁর Qur’an and Woman: Rereading the Sacred Text from a Woman’s Perspective পুস্তকেও। অর্থাৎ ইসলামের গ্রন্থগত বয়ান, তার মনুষ্য বোঝাপড়া আর মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুশীলন ও চর্চার মাঝে এই বিপুল তফাতের ফলে এটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ইসলাম প্রকৃত অর্থে কী, সেই প্রশ্নের উত্তরটি। ইসলামকে কিভাবে বোঝা সম্ভব, মুসলিম জনগোষ্ঠীর চর্চা ও অনুশীলন দিয়ে নাকি কুরআনের বয়ান দিয়ে? পরবর্তীকালে হাদিস ও তাফসির এই বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি জটিলতা তৈরি করেছে। কেননা হাদিস ও তাফসির নিয়ে পরস্পরবিরোধী অনুধাবন ও বিতর্কও রয়েছে হাজার হাজার। ইসলামী নারীবাদের আলোচনায় কুরআন, হাদিস, তাফসির এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর চর্চা ও অনুশীলনের পরস্পরবিরোধী পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ রয়েছে। এমন কি ইসলামী নারীবাদীরা ব্যাখ্যা হাজির করেছেন এই বলে যে প্রচলিত ‘তাফসির’ বা কুরআনের ব্যাখ্যাসমূহ দারুণভাবে পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষের হাতে রচিত, প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত। এর বিপরীতে কুরআনের নারীবাদী পাঠ জরুরি এবং নারীবাদী তাফসিরও জরুরি।

এর পরের প্রসঙ্গটি হচ্ছে ‘আদর্শ ইসলাম’ বা ‘সহী ইসলাম’ এর ধারণা। ইসলামী নারীবাদ বোঝার প্রশ্নে যে বেশ কয়েকটি মৌলিক প্রসঙ্গে বেশিরভাগ ইসলামী নারীবাদী পণ্ডিত একমত হয়েছেন সে সকলের মাঝে অন্যতম একটি হচ্ছে ‘আদর্শ ইসলাম’ বা ‘সহী ইসলাম’ এর ধারণা। ইসলামী নারীবাদীদের প্রায় সকলেই এই বিষয়ে একমত যে ‘আদর্শ ইসলাম’ বা ‘সহী ইসলাম’ বলে আসলে কিছু নেই, হতে পারেনা, হবার দরকারও নেই। বরং ‘আদর্শ ইসলাম’ বা ‘সহী ইসলাম’ হিসাবে যে ধারণাটি সারা দুনিয়াতে গত দেড়হাজার বছর ধরে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে তা প্রবলভাবে আরব পিতৃতন্ত্রের সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয় পিতৃতন্ত্রের মিশেল দিয়ে এক অদ্ভুত ক্ষমতাতান্ত্রিক ব্যবস্থা যা মানুষের স্বাভাবিক বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণের এক মহাযজ্ঞ। এই তথাকথিত ‘আদর্শ ইসলাম’ মূলত পৃথিবীর দেশে দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতাতান্ত্রিক ও মোল্লাতান্ত্রিক ইসলামী গোষ্ঠীর তৈরি করা একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আখ্যান, যার পেছনে রয়েছে ইসলামের ইতিহাসের বংশতান্ত্রিক ক্ষমতাতন্ত্রের রাজনীতি, মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক শক্তি আর এশিয়া ও আফ্রিকার গরীব দেশগুলোর স্থানীয় মুসলিম মোল্লাতন্ত্র। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস বরং এই সাক্ষ্য দেয় যে পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের মাঝে ইসলামের অনুশীলন গড়ে উঠেছে দারুণভাবে ‘স্থানীয় ইসলাম’ হিসাবে। সে কারণেই ইউরোপের দেশ বসনিয়ার মানুষেরা যে ইসলামের অনুশীলন করেন তা আরব – মধ্যপ্রাচ্য বা এশিয়ার দেশগুলোর চাইতে অনেক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিতভাবে আলাদা। মধ্য এশিয়ার দেশ আজারবাইজানের ইসলাম আর দক্ষিণ এশিয়ার ইসলাম অনুশীলনের দিক থেকে যথেষ্ট ভিন্ন। এশিয়ার মঙ্গলয়েড অঞ্চলগুলোতে ইসলাম যেভাবে চর্চিত হয়, দ্রাবিড় অঞ্চলে সেভাবে চর্চিত হয়না। এমন কি একই দেশের মাঝে বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে ইসলামের অনুশীলন আলাদা হয়ে উঠেছে। ভারতের উত্তরের মুসলিম আর একেবারে দক্ষিণের মুসলিম ধর্মের বিশ্বাসগতভাবে হয়তো নিকটতর কিন্তু ধর্মের সাংস্কৃতিক অনুশীলনের দিক থেকে একেবারেই আলাদা। আফগানিস্তানে ইসলাম বিকশিত হয়েছে প্রধানত গোত্রগত বিশ্বাস আর অনুশীলনকে সাথে নিয়েই। এই ‘আদর্শ ইসলাম’ এর আলাপটি জরুরি এই জন্যে যে আধুনিক মুসলিম পিতৃতন্ত্রের একটি প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে এই ‘আদর্শ ইসলাম’ বা ‘সহী ইসলাম’ ধারণাটি। ঐতিহাসিকভাবে এই ‘সহী ইসলাম’ এর ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে শাসকগোষ্ঠী ব্যবহার করেছে স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব থেকে শুরু করে আধুনিককালে রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকেও। আর এই ‘সহী ইসলাম’ ধারণাটি ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে, মানুষের আচরণ, আনুগত্য, চর্চা, অনুশীলন, মনোনিবেশ সবকিছুকে ইসলামী শাসক গোষ্ঠীর মতাদর্শের অনুগামী করার জন্যে। এই নিয়ন্ত্রণের একটি বড়ো অংশ জুড়েই রয়েছে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা।

অধ্যাপক মাসুদা বানু তাঁর The Revival of Islamic Rationalism বইয়ে একটি পুরো অধ্যায় ব্যয় করেছেন ‘ইসলাম কী?’ এই প্রশ্নের উপরে। ‘ইসলাম কী’? এই প্রশ্নটি তিনি ব্যাখ্যা করেছেন সহী মুসলিম থেকে একটি দীর্ঘ হাদিস উল্লেখ করে। এই হাদিসটি সংকলিত হয়েছে খলিফা উমর এর বয়ানে। তিনি উল্লেখ করছেন এভাবে –

“একদিন আমরা রসুলের সাথে বসে ছিলাম, সেসময় একজন অচেনা মানুষ আমাদের কাছে আসলেন, মিশমিশে কালো চুল আর ধবধবে সাদা পোশাক পরা সেই মানুষটি রসুলের মুখোমুখি বসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন – “মুহাম্মাদ আপনি আপনার ধর্ম সম্পর্কে আমাকে বলুন, ইসলাম আসলে কি”? রাসুল্লাহ তাঁকে বললেন –
“ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদকে স্বীকার করা, ঘোষণা করা, আল্লাহ ছাড়া আর কোনও উপাস্য নেই, মুহাম্মদ হচ্ছেন তাঁর প্রেরিত রাসুল। ইসলাম হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, যাকাত আদায় করা, রমজান মাসে রোজা আদায় করা এবং সামর্থ্য ও উপায় সহায়ক হলে হজ্ব পালন করা”।

সেই অচেনা মানুষটি মুহাম্মদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন – ‘আপনি সত্য বলেছেন’ কিন্তু এবার আমাকে একটু বলুন সত্যিকারের বিশ্বাস বা ঈমান বলতে ইসলাম আসলে কী বলে? রাসুল তাঁকে উত্তর দিলেন – “এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা, তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসুলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, ফেরেশতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করা, তাঁর প্রেরিত গ্রন্থসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং কিয়ামত বা বিচারদিনের আসন্নতার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করা।”

অচেনা ব্যক্তিটি এর পরে প্রশ্ন করলেন – তাহলে ‘ইহসান’ বা সম্পর্কে আমাকে বলুন, সত্যিকারের ইহসান আসলে কী?’ রসুল উত্তর দিলেন-
“সত্যিকারের ইহসান হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, তাঁর বন্দনা করা, তাঁর কাছে এমন ভাবে প্রার্থনা করা যেন তাঁকে আমরা দেখছি, এমন কি তাঁকে দেখা যাক বা না দেখা যাক, তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন করা আর বিশ্বাস করা যে তিনি সব দেখছেন”।

লোকটি চলে যাবার পরে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ তাঁর সহচর উমরকে নিশ্চিত করলেন যে এই অজানা লোকটি আসলে ছিলো আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইল, যিনি নিশ্চিত করতে এসেছিলেন ‘ইসলাম কী’? এই প্রশ্নটি নিয়ে আল্লহর রাসুলের মাঝে কোনও ভুল বোঝাবুঝি আছে কিনা (Sahih Muslim, 1.37: hadith 8)।

এই হাদিসটি থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, ইসলামের আবির্ভাবকালে এই ধর্মটির বোঝাপড়া পুরোটাই ছিলো বিশ্বাসকেন্দ্রিক। ইসলাম ছিল একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা বা Belief System। এই বিশ্বাস ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে ঈমান – আকিদা ও ইহসান। ঈমান উত্তর দেয় বিশ্বাস – অবিশ্বাস প্রশ্নের, আকিদা উত্তর দেয় কী বিশ্বাস করতে হবে এই প্রশ্নের, ‘ইহসান’ উত্তর দেয় কিভাবে বিশ্বাস করতে হবে তার। ইসলামের মৌলিক আকিদায় ছয়টি শর্ত অন্তর্ভুক্ত –

এক: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেকে যেভাবে মানবজগতের কাছে উপস্থাপন করেছেন ঠিক সেভাবে তা সত্তাগতভাবে, গুণগতভাবে এবং কর্মগতভাবে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করা।
দুই: ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস: তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে কুরআন ও সহী হাদিসে যে রকমের বর্ণনা ও চরিত্রায়ন রয়েছে ঠিক সেভাবে বিশ্বাস করা।
তিন: আল্লাহ প্রেরিত রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস : তাঁদের নবুওয়াত ও তাদের চারিত্রিক পবিত্রতার উপর নির্দ্বিধায় বিশ্বাস স্থাপন করা।
চার: সকল আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস : মূল চারটি কিতাব তথা যাবুর, ইঞ্জীল, তাওরাত ও কুরআনসহ নাযিলকৃত অন্যান্য ছোট ছোট কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস রাখা।
পাঁচ: শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস : অর্থাৎ মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে যাবতীয় সংবাদসমূহ যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলের মাধ্যমে দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন, তার প্রতি বিশ্বাস রাখা।
ছয়: তাক্বদীরের উপর বিশ্বাস : অর্থাৎ যা কিছু দুনিয়ার বুকে ঘটছে তা আল্লাহ রাববুল আলামীনের জ্ঞাতসারেই ঘটছে, তাঁর ইচ্ছাতেই ঘটছে এবং তিনি সৃষ্টিজগত তৈরির বহু পূর্বেই ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন- এই বিশ্বাস জাগ্রত জ্ঞান সহকারে পোষণ করা।

ইহসান হচ্ছে, কিভাবে এই আকিদাসমূহ ধারণ করতে হবে সেই উত্তর। ইসলামী বিশ্বাস মতে, এই আকিদাসমূহকে ধারণ করতে হবে প্রশ্নের অতীত হিসাবে। অর্থাৎ এই বিষয়গুলোকে বিশ্বাস করতে হবে একেবারে হৃদয়ের গভীর থেকে, কোনো রকমের সংশয় ছাড়া। ঠিক যেভাবে ইসলামের রাসুল বর্ণনা করেছেন – আল্লাহকে বিশ্বাস করতে হবে এমনভাবে যেন আল্লাহর সাথে আমার দেখা হয়েছে, এমন কি যদি দেখা নাও হয়ে থাকে, যদি দেখা হবার কোনো সম্ভাবনাও না থাকে, তবু বিশ্বাস করতে হবে এবং এটা বিশ্বাস করতে হবে যে মানুষ আল্লাহকে দেখতে না পারলে আল্লাহ সর্বদাই মানুষকে দেখছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন। এই সংশয়াতীত বিশ্বাসই হচ্ছে প্রকৃত মুমিন মুসলমানের বৈশিষ্ট্য। যদিও ইসলামের ইতিহাসে মুতাজিলা ধারাসহ আরও অনেকেই এই আকিদাগত বিশ্বাসগুলোকে যুক্তির নিক্তিতে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন।

ইসলামের এই তিনটি মৌলিক ধারণা, ঈমান, আকিদা ও ইহসান নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্বাসী মুসলিম মানুষদের মাঝে খুব বিরাট কোনো মতবিরোধ বা ভিন্নতা দেখা যায়না। জেনে বুঝে সচেতনভাবে হোক কিংবা অবচেতনভাবেই হোক, বিশ্বাসী মুসলিম মাত্রই ইসলামের বিশ্বাসগত শর্তগুলোতে নিরঙ্কুশ নতজানু সমর্থন ব্যক্ত করে থাকেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে ইসলামের গড়ে ওঠার ইতিহাসে (Formation period of islam) তা কেবল সাধারণ বিশ্বাসী মানুষের বিশ্বাস ব্যবস্থা হয়ে সীমিত থাকেনি, বরং তা যুক্ত হয়েছে রাজনীতির সাথে, দখলদারিত্ব, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সম্পদ অর্জন সর্বোপরি এর অনুসারীদের উপরে সর্বাত্মক কর্তৃত্ববাদী একটি মতবাদ হিসাবে। প্রয়াত ভারতীয় ইসলামী স্কলার মাওলানা ওয়াহিদউদ্দিন খান মনে করেন, ইসলামের নবী মুহাম্মদের সময় পর্যন্ত প্রচারিত ও চর্চিত যে ইসলাম তা কেবলই একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা হিসাবেই প্রচারিত ও চর্চিত ছিল। ‘আদর্শ ইসলাম” বা ‘সহী ইসলাম’ বলে যদি কিছু থেকেই থাকে তা হচ্ছে এই মৌলিক বিশ্বাস ব্যবস্থা বা Core Belief System, কোনোমতেই মনুষ্য সৃষ্ট ইসলামী রাজনৈতিক মতবাদ বা তার আইন নয়।

বিশ্বাস ব্যবস্থা (Belief system) থেকে রাজনৈতিক মতবাদ হয়ে ওঠার এই রূপান্তর ঘটেছে গত কয়েক শতকে। বিশ্বাস ব্যবস্থা থেকে একটি রাজনৈতিক মতবাদ হয়ে ওঠার পেছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছে ইসলামের আইনশাস্ত্র বা তার উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ইসলামী শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা যার প্রচলিত নাম ‘শরীয়াহ’। প্রচলিত অর্থে ‘শরীয়াহ’ কে অনেকেই ইসলামী আইনের সমষ্টি বলে মনে করেন কিন্তু শরীয়াহ মূলত ইসলামী শাসনতন্ত্র বা শাসনব্যবস্থা যার মূল উৎস হিসাবে দাবি করা হয়ে থাকে কুরআন ও হাদিস থেকে উৎসারিত বিধি বিধান। আর ফিকহ হচ্ছে আইনশাস্ত্র যার নিবিড় অধ্যায়নের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ইসলামী বিধি বিধানের বিষয়ে বোঝাপড়া অর্জন করেন। শরিয়াহ গড়ে ওঠে ফিকহ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রের বোঝাপড়ার উপরে ভিত্তি করে, কিন্তু সেটা কেবলই কিছু আইনের সমষ্টি নয়। কিন্তু ইসলামী আইন গড়ে ওঠার উৎস হিসাবে কেবল কুরআন ও হাদিসকে দাবি করা হলেও ঐতিহাসিক উৎসগুলো থেকে জানা যায় ইসলামী আইন হিসাবে এমন অনেক প্রথাকে গ্রহণ করা হয়েছে যা প্রকৃত বিচারে প্রাক-ইসলামী সমাজের নানান প্রচলিত প্রথা থেকে নেয়া। উমাইয়া খিলাফতের বিচারকগণ তাদের নানান বয়ানে আইনের উৎস হিসাবে কুরআন বা হাদিসের উল্লেখ করতেন না। এমন কি উমাইয়া খিলাফতের বিচারক বা কাজীদের জন্যে কুরআন জানাটা অত্যাবশ্যকীয় হলেও হাদিস জানাটা বাধ্যতামূলক ছিল না (জিহাদ ও খিলাফতের সিলসিলা, পারভেজ আলম)। এই সকল ঐতিহাসিক সূত্র আমাদের বলে যে ইসলামের প্রাথমিক বিকাশের কালে ‘ইসলামী আইন’ বলে সুসঙ্ঘবদ্ধ তেমন কিছু ছিল না।প্রাক ইসলামী যুগের নানান প্রথার উপরে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল প্রাথমিক কালের কথিত ‘ইসলামী আইন’।

বাংলাদেশের গবেষক পারভেজ আলম তাঁর ‘জিহাদ ও খিলাফতের সিলসিলা’ বইটিতে একটি অধ্যায় যুক্ত করেছেন “সহী ইসলাম ও ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রসঙ্গে” শিরোনামে। এই অধ্যায়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কেন ‘সহী ইসলাম’ ও ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ এই দুটি বর্গ ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাস ও এর আদি ইতিহাসের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তিনি ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের তথ্যসূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে ‘সহী ইসলাম’ ও ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ এই ধারণাদুটি গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ইসলামী ক্ষমতাতন্ত্রের খায়েশ পূরণের জন্যে।

প্যাট্রিসিয়া ক্রোন আর ইগনাজ গোলজিহারের বরাতে পারভেজ আলম তাঁর ‘জিহাদ ও খিলাফতের সিলসিলা’ বইটিতে লিখছেন –

‘ইসলামী আইন বলতে সাধারণত যা বোঝানো হয় তার উৎপত্তি ঘটেছে মূলত আব্বাসীয় খেলাফতের সময়ে ইরাকে। কাঠামোগত দিক থেকে ও বিভিন্ন আইনের ক্ষেত্রে ইসলামী আইন লেট অ্যান্টিক প্রচলিত রোমান, ইহুদী ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য প্রথাগত আইনের সাথে অনেক দিক থেকেই সাযুজ্যপূর্ণ। প্রচলিত আইন খুব সহজে বিলুপ্ত হয়না। আরবদের হাতে বিজিত হওয়ার আগে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব আইন প্রচলিত ছিল, আরব বিজয়ের পরেও সেসব আইনের বড়ো অংশই টিকে ছিল। মধ্যপ্রাচ্য ও রোমান আইনের বিভিন্ন ধারা উমাইয়া খেলাফতের আমলে বহাল তবিয়তে ছিল, যা প্রয়োগ করতেন খলিফা অথবা তার প্রতিনিধিরা।’
… উমাইয়া খলিফারা যেহেতু প্রায় ১০০ বছর সিরিয়া থেকে শাসন করেছে এবং তার অধিকাংশ নাগরিকেরা ইসলামপূর্ব সময়ে ছিল খ্রিস্টান রোমান সাম্রাজ্যের নাগরিক, তাই এই সময়ে শরিয়া আইনের যে ডেভেলপমেন্ট হয়েছে তাতে রোমান আইন, বিশেষ করে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত আইনের যথেষ্ট প্রভাব ছিলো বলা যায়। ইগনাজ গোলজীহার রোমান আইন আর শরিয়া আইনের কাঠামোগত মিল আবিষ্কার করেছিলেন বহু আগেইন। তিনি এই দুই আইনের মাঝে কোনও না কোনও দিক থেকেই সম্পর্ক আছে বলে নিশ্চিত ছিলেন।’
(খিলাফতের সিলসিলা, পৃষ্ঠা ১৭৮)

পারভেজ আলম এই বইতে বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও জানাচ্ছেন যে কিছু সিরীয় রোমান আইনের ধারা আর শরীয়াহ আইনের ধারায় হুবুহু মিল আছে। এমন কি সিরীয় রোমান আইনের ক্ষেত্রে ‘সুন্নাহ’ শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায় ইসলামের আবির্ভাবেরও প্রায় দুইশ বছর আগে। এমন কি ইসলামের নবী মুহাম্মদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে তিনি জমি জমা সংক্রান্ত বিরোধ মেটানোর জন্যে যে পদ্ধতি ব্যবহার করছেন তা আসলে রোমান আইনেরই কিছু পদ্ধতি, যেমন লটারি পদ্ধতি ছিল রোমান আইনে ব্যবহৃত পদ্ধতি জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ মেটানোর জন্যে যা একটি হাদিস মোতাবেক জানা যায় মুহাম্মদও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। অর্থাৎ ইসলামের অন্তত প্রথম একশ বছরেরও বেশি সময়কাল পর্যন্ত ইসলামী আইন বলে খুব সুসঙ্ঘবদ্ধ আইন বা বিধি ছিল না। খলিফা ও তার প্রতিনিধিরা নানান ধরনের ঐতিহাসিক সূত্র থেকে পাওয়া বিভিন্ন বিধি বিধান ব্যবহার করে আইনি সমাধান দিতেন। ‘কুরআন ও সুন্নাহ’র ভিত্তিতে’ ইসলামী আইন গড়ে ওঠার দাবিটি শুরু হয় আটশ শতকের পর থেকে। প্রধানত ইসলামী উলামাদের উদ্যোগে খলিফাদের তৈরি করা আইনের বিরুদ্ধে এক ধরনের বৈধতা তৈরির জন্যেই ‘কুরআন ও সুন্নাহ’র সূত্র ব্যবহার শুরু হয়। যদিও ইসলামী আইন বলে যে সংকলিত আইনসমূহ, তা আরব ও মধ্যপ্রাচ্যেরই নানান প্রচলিত প্রথা ও বিধিবিধান থেকে নেয়া।

‘ইসলামী আইন’ কিংবা শরীয়াহর বিধি বিধান সম্পর্কে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটি জানা জরুরি এই জন্যে যে সারা দুনিয়াতেই ইসলামী আইনের নামে যে নানান ধরনের বিধি বিধান চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বিশ্বাসী মানুষের উপরে, তার একটা বিরাট অংশই মূলত সেই সময়ের আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রচলিত বিধিবিধান যার হাড়ে মজ্জায় লেগে ছিল আরব পিতৃতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রথা, বিধিবিধান। আজকের যুগে ইসলামী আইনকে ‘কুরআন ও সুন্নাহ’র ভিত্তিতে তৈরি বলে দাবি করা হলেও বাস্তব ইতিহাস হচ্ছে এই আইনগুলো সকল অর্থেই মনুষ্য অনুধাবনের উপরে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে মুহাম্মদ পরবর্তী ক্ষমতাতান্ত্রিক ইসলামের স্বার্থ সংশ্লিস্ট বিষয়াদি যার প্রধান শিকার হচ্ছে নারী।

এই সকল ঐতিহাসিক পর্যালোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, তা হচ্ছে বিশ্বাসী মানুষের কাছে কুরআন একটি ডিভাইন বা ঐশ্বরিক কিংবা স্বর্গীয় গ্রন্থ কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ইসলামী আইন ‘ডিভাইন’ বা ঐশ্বরিক কিংবা স্বর্গীয় কোনও বিষয় নয়। কুরআন ‘নাজিল’ হয়েছিলো সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহর তরফ থেকে কিন্তু ইসলামী আইন আল্লাহর কাছ থেকে ‘নাজিল’ হয়নি, বরং এটা সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষের নিজেদের বোঝাপড়ার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আর কুরআন ও হাদিসের সেই সকল বোঝাপড়া যদি হয়ে থাকে পিতৃতান্ত্রিক, তাহলে সেই ইসলামী আইনও পিতৃতান্ত্রিক হতে বাধ্য। বাস্তব ইতিহাস আমাদের সেটাই বলে।

এই নিবন্ধটির সবশেষ প্রসঙ্গটি হচ্ছে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বিষয়ক। ইসলামী নারীবাদীদের অনেকেই তাদের লেখালেখিতে এই কথিত ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রসঙ্গটি নিয়ে আলাপ তুলেছেন। যদিও ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ এই ধারণাটির আলাপকে অনেকটাই আচ্ছন্ন করেছে সাম্প্রতিক সময়ের ‘আই এস’ বা ‘আইসিস’ নামের ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের কার্যক্রম। পশ্চিমা সমাজগুলো মধ্যপ্রাচ্যের এই উগ্র ইসলামী দল ‘আই এস’ কে দেখিয়েই ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠীকে চরিত্রায়ন করার এক নতুন প্রকল্প হাজির করেছে, যদিও পৃথিবীর একটি বিরাট অংশের মুসলিম জনগোষ্ঠী মনে করেন ‘আই এস’ বা ‘আইসিস’ কেবলই একটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক – সামরিক গোষ্ঠী এদের সাথে ইসলামের মূল বিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই। সাম্প্রতিক সময়ের ‘আইএস’কে বাদ দিলে ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে যে দেশগুলোর আলাপ প্রাসঙ্গিক হয় তা হচ্ছে প্রথাগত অর্থে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ পরিচয়ের রাষ্ট্র সমূহ। এদের মধ্যে যেমন ইসলামী রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবারতান্ত্রিক রাজতন্ত্র সৌদি আরব রয়েছে, আবার অপর দিকে রয়েছে আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তিতে চলমান ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বা উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো। মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি’র সদস্য মোট ৫৭ টি দেশ হলেও ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদায় রয়েছে ২৬ টি দেশে। এই সকল দেশগুলোকে নানান ভাবেই ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বলা হলেও এদের মাঝে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তফাত। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণবাদী ভূমিকার দিক থেকে মুসলিম প্রধান তুরস্কের সাথে সৌদি আরব বা ইরানের সামাজিক অবস্থার রয়েছে বিস্তর তফাত। আর তফাতগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নারীর জন্যে প্রাসঙ্গিক। তাই তুর্কী নারী তার ঘরে ও বাইরে যতটা স্বাধীন ও মানবিক – নাগরিক অধিকার চর্চার সুযোগ পেয়ে থাকেন নিশ্চিতভাবেই তা সৌদি আরব বা ইরানের চাইতে অনেক ভিন্ন ও গুনগত প্রশ্নে উন্নত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই সকল ইসলামী রাষ্ট্রের মাঝে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা, অনুশীলন ও নাগরিকের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই বিপুল তফাতের কারণ কী? যদি এরা সকলেই ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ হয়ে থাকে, তাহলে তো তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলোও একই রকমের হবার কথা। কিন্তু বাস্তবতা মোটেও সেই রকমের নয়। কেন?

এর কারণ হিসাবে ইসলামী নারীবাদীরা তো বটেই, বহু ইসলামী স্কলার ও অমুসলিম ইসলামী গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন আদৌ ইসলামী রাষ্ট্র বলে কিছু আছে কিনা? এঁদের অনেকেই উল্লেখ করেছেন ইসলামী রাষ্ট্র ধারণাটি সাম্প্রতিক এবং সেই অর্থে এটা ইসলামের মূল মর্মশাঁস এর সাথে সম্পর্কিত কোনো ধারনা নয়। ভারতীয় ইসলামি পণ্ডিত মাওলানা ওয়াহিদউদ্দিন খান বলছেন – ইসলাম কেবলই একটা বিশ্বাস ব্যবস্থা, একে সারা দুনিয়াতে ‘শাসন ব্যবস্থা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়ার বিষয়টি ইসলামের গোড়ার দিকের বিষয় ছিলোনা। ইসলাম কেবলই মানুষকে একটি সত্যিকারের বিশ্বাস ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করতে চেয়েছিল, মানুষের উপরে কোনো রকমের নিয়ন্ত্রনবাদী শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার দর্শন নয় ইসলাম। তিনি উল্লেখ করছেন – ইসলামকে রাষ্ট্রবাদী ব্যবস্থার ধারণা খুব সাম্প্রতিক সময়ের, মাত্র দুই শতকের আবিষ্কার, সেই অর্থে ইসলামকে রাষ্ট্রবাদী ধারণার সাথে যুক্ত করাকে তিনি মনে করেন ‘বিদআত’ বা নব্যসৃষ্টি। মাওলানা ওয়াহিদউদ্দিন খান ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণারকে অবিভক্ত ভারতের পরে পাকিস্তানের ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবুল আলা মওদূদীর চিন্তার সাথে যুক্ত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন উপমহাদেশে ইসলামকে একটি ভয়ংকর মতাদর্শ হিসাবে হাজির করার জন্যে মাওলানা মওদূদী ও তার মতো খুব হাতেগোনা কয়েকজন রাজনীতিবিদকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। সাম্প্রতিককালে বাংলায় প্রকাশিত পুস্তক ‘খিলাফত ও জিহাদের সিলসিলা’ গ্রন্থে পারভেজ আলম আরও সরাসরি উপসংহার টেনেছেন এই ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রসঙ্গে। তিনি লিখেছেন –

“ইসলামী রাষ্ট্রও একটি আধুনিক ধারণা এবং ইউরোপীয় উপনিবেশ বিস্তারের আগে মুসলিম দুনিয়ায় এই ধারণাটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ইসলামী সমাজের সিলসিলা সন্ধান করতে গেলে কোনোভাবেই ১৪০০ বছর আগের আরব সমাজ ও ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (স) পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব নয়, টেনেটুনে বড়জোর গত শতকের গোড়ার দিকের ব্রিটিশ ভারত ও সেই সময়ের ইসলামিস্ট তাত্ত্বিক আবুল আলা মওদূদী পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব। আর ইসলামী রাষ্ট্র নাম নিয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় যা হাজির হয়েছে এবং এখন যাদের নামে বাংলাদেশে বিদেশি ও শিয়া হত্যাকাণ্ড ঘটছে তাদেরে আইডিওলজির সিলসিলা পাওয়া যাবে সৌদি আরবের জন্মের ইতিহাসে, আব্দুল ওয়াহাবের সালাফিবাদে, টেনেটুনে সর্বোচ্চ বারো শতকের ইবনে তাইমিয়ার জিহাদি আদর্শবাদে। ইসলামের ফরম্যাটিভ ও নরম্যাটিভ পিরিয়ড পর্যন্ত এর সিলসিলা টেনে নেওয়া কঠিন।”
(জিহাদ ও খিলাফতের সিলসিলা, পৃষ্ঠা ৫১)

অর্থাৎ ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ হিসাবে যে ধারণাটি আমাদের সামনে হাজির রয়েছে সেটিও ইসলামের মৌল ধারণার সাথে সম্পর্কিত নয়, অন্তত ছিল না। আজকের দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র নামের যে সকল প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে, ভৌগলিক অঞ্চলে রাজত্ব করছে তা মূলত ইসলামকে ভিত্তি করে এক ধরনের নিয়ন্ত্রনবাদী রাজনৈতিক ক্ষমতাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, যার সাথে বিশ্বাস ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামের সংযোগ খুবই ক্ষীণ। দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে এই নিয়ন্ত্রণবাদী ক্ষমতাতান্ত্রিক ইসলামী রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণ প্রধান শিকার হচ্ছে নারী। সে কারণেই ইসলামী নারীবাদে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রসঙ্গটি একটি প্রধান আলোচনার বিষয়।

সারসংক্ষেপে বলা যায়, –
● ইসলামী নারীবাদের আলাপে ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং তাদের কর্মকাণ্ডের মাঝে একটা তফাত রেখা টানার বিষয়ে আলাপ জরুরি।
● ‘সহী ইসলাম’ বা ‘আদর্শ ইসলাম’ বলে আসলে কিছু নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন ভূমিতে বিশ্বাসী মানুষেরা ইসলামের চর্চা ও অনুশীলন করেছেন তাদের নিজেদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রথার সাথে মিলিয়ে। বরং ‘সহী ইসলাম’ এর ধারণাটি গড়ে উঠেছে এক ধরনের নিয়ন্ত্রনবাদী রাজনীতি থেকে যার মূল বেনিফিশিয়ারী হচ্ছে মুসলিম পিতৃতন্ত্র।
● শরীয়াহ ব্যবস্থা ও ইসলামী আইন ‘কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক’ বলে দাবি করা হলেও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসের সাথে এর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। শরীয়াহ ও ইসলামী আইন গড়ে উঠেছে কুরআন ও হাদিসের পাঠ-জনিত ভাষ্য বা interpretation এর উপড়ে ভিত্তি করে। ইসলামী নারীবাদীদের দাবী মতে কুরআন ও হাদিসের এই পাঠ-জনিত ভাষ্য বা interpretation ঐতিহাসিক ভাবেই প্রবল পিতৃতান্ত্রিক।
● ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ধারণাটি একটি আধুনিক ধারণা। এর সাথে মুহাম্মদীয় ইসলামের সংযোগ টানার কোনও ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়না। বরং ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ধারণাটির সংযোগ রয়েছে খুব সাম্প্রতিক শতাব্দীর ইসলামকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ক্ষমতান্ত্রিক রাজনীতির। ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ও সাধারণ অর্থে ধর্ম বিশ্বাস প্রবণ মানুষের স্বার্থ বরং নানান দিক থেকেই পরস্পরবিরোধী। বিশেষত আজকের দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্রই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলিম বিশ্বাসী নারীর মুক্তির ও স্বাধীনতার প্রধান প্রতিপক্ষ।

ইসলামী নারীবাদের বিস্তারিত আলোচনায় এই প্রসঙ্গগুলো জরুরি এবং এই সকল প্রসঙ্গের গভীর পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ (Critical analysis) ব্যতীত বিশ্বাসী মুসলিম নারীর মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলিম বিশ্বাসী নারীবাদীরা সেই পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ হাজির করার চেষ্টা করছেন গত কয়েক দশক ধরে। বাংলাদেশের বিশ্বাসী মুসলিম নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যেই স্থানীয়ভাবে এই প্রসঙ্গগুলোর আলাপ তোলাটা জরুরি।

 

[চলবে]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *