বিনোদনের নামে যৌন হয়রানির হাওয়া কি বদলাবে?
খাদিজা শারমিন অন্তরা ।। সোশাল মিডিয়াতে প্রায়ই হালের কিছু বাংলা নাটকের ছোট ছোট ক্লিপ চলে আসে। ইউটিউবে লাখ লাখ ভিউজ, প্রচুর জনপ্রিয় একটি নাটকের ক্লিপে দেখছিলাম একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যিনি কিনা আবার ব্যাপক জনপ্রিয় একজন অভিনেতা, হাতের অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করছেন আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী। নারীটি আবার প্রতিবাদ করে যখন বললেন আপনি একজন মেয়ের সামনে কিভাবে এমন অঙ্গভঙ্গি করছেন, সেই চরিত্রটি অসভ্যের মত বললো, “আমি তো লাগাচ্ছি, লাগানো ভালো, সবাই লাগায়।” অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে নাটক নামক জায়গায় রীতিমতো যৌন হয়রানির প্রমোশন দেখে হতবাক হয়ে গেলাম।
ইউটিউবে নাটকটির নাম দেখলাম – ব্যাপক কাপঝাপ। বাংলা নাটকে বেশ অনেক আগে চমৎকার নামকরণের অভ্যেস হারিয়ে গেছে। শব্দচয়ন,কমেডির নামে ভাঁড়ামি আর অসভ্যতা আকাশ ছুঁয়েছে তবে এরকম অবস্থায় বাংলাদেশের শিল্পের একটি অংশ দাঁড়িয়ে আছে যেখানে একজন নারীকে যৌন হয়রানি করে, এইসব অঙ্গভঙ্গি এবং শব্দকে নরমালাইজ করা যেতে পারে তা ভাবতেই পারছিলাম না।
বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে এমন নারী খুব কম পাওয়া যাবে যিনি রাস্তায় পুরুষদের যৌনতার লোলুপ অঙ্গভঙ্গির শিকার হননি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আপনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হলেও আপনার চেয়ে পেশাগত দিক থেকে বহু নিচের একজন রিকশাচালক বাজে অঙ্গভঙ্গি ছুঁড়ে দিতে পারে। আর “আপা বাদ দেন” নামক সামাজিক প্রতিবাদে আপনি প্রায়ই মুখে তালা দিয়ে এইসমস্ত পরিস্থিতি থেকে সরে আসেন কারণ নারীদের সরে আসতে হয়, প্রতিবাদী নারীকে খারাপ নারী ট্যাগ দিতে একদল এমনিতেই বসে থাকে।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী যত সহজে এইসমস্ত বাজে ব্যাপার এড়িয়ে চলতে পারেন, সদ্য কৈশোর অথবা একজন শিশু কন্যা এইসব এতো সহজে হজম করতে পারেনা । এই পৃথিবী থেকে সে তখন লুকিয়ে থাকে। ইভটিজিং সহ্য করতে না পেরে অসংখ্য ছাত্রীর আত্মহননের পথ খুঁজে নেয়া একদমই নতুন কোনো খবর নয়।
আমাদের সামাজিকভাবে প্রতিবাদ হবার কথা এই সমস্ত ইভটিজিং এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে। সেখানে নাটকের মতো একটি মাধ্যম যেখানে মানুষ বিনোদনের সাথে বার্তা পায় সমাজ পাল্টানোর সেখানেই নরমালাইজ করা হচ্ছে যৌন হয়রানিকে।
এর প্রভাব দেখার জন্য অবশ্য বহু বছর আমাদের অপেক্ষাও করতে হচ্ছেনা। বাংলাদেশে শিক্ষার হার বেড়ে গেল হুহু করে কিন্তু এই সার্টিফিকেটওয়ালা ‘শিক্ষিত জেনারেশনে’র নারীর প্রতি ক্ষোভ যেন আরো বেশি। টিকটকে কোনো নারী নাচ গান করেছে তার সেই নাচের নানান অঙ্গভঙ্গি জুম করে অশ্লীল হিসেবে উপস্থাপন করে, ব্যবহার করা হচ্ছে হয়রানিমূলক বাক্য আর তার নাম দেয়া হচ্ছে “রোস্টিং”। সেখানে মন্তব্যের ঘরে মন্তব্য করছে কম বয়সী ছেলেমেয়েরাই, যারা লিখছে এদের নাকি এভাবেই “শায়েস্তা” করতে হবে। একজনের ব্যক্তিগত ভিডিও, তার অনুমতি না নিয়ে নানান কাটপিস জুড়ে দিয়ে একটি বিশাল বড় প্ল্যাটফর্মে এসে তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ভিডিও বানিয়ে শায়েস্তা করার এই মহান দায়িত্ব আমাদের এই জেনারেশনের শিশু কিশোরদের হাতে কে তুলে দিয়েছে?
আমাদের বড় বড় নারী সেলেব্রিটিরা যখনই এসব হয়রানির শিকার হওয়া শুরু করলেন আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম তারা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে এইসবের লাগাম টানবেন। সোশাল মিডিয়ায় নারীর প্রতি এইসব হয়রানি একেবারেই নতুন কিছু নয়। একজন নারী কিছু বলছে, তার কথা শোনার প্রয়োজন নেই, তাকে এসে একটা গালি দিয়ে মন্তব্য করাই বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ আসল পুরুষের কর্ম হিসেবে বিবেচনা করে, যার প্রমাণ মেলে কমেন্ট বক্সে। যারা ব্যবস্থা নিতে পারতেন তাদের উদাসীনতায় দিনকে দিন এইসব অপরাধ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে ছোট ছোট মেয়েরা, কিশোরীরা বিশাল আকারে রোস্টিংয়ের নামে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। যারা এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে তারা কেউ কেউ মিডিয়ায় এইসব হেয় করা নাটকে দেদারসে অভিনয় করে যাচ্ছেন। অবশ্য অভিনেতা / অভিনেত্রী হলে এইসব করা যায়, শিল্পীর সাথে ফারাকটা এখানেই।
বাংলা ছায়াছবির কালো যুগ হিসেবে বিবেচ্য সময়ে ডিপজল, আলেকজান্ডার বো বা ‘পুত কইরা দিমু’ গান করা আগুন খানকে কোনো দোষ দেয়া হয়না। দোষ সব পরে মুনমুন আর ময়ূরীর উপরে যারা আবার পরিচালক আর প্রযোজকদের কাটপিস ক্রাইমের শিকার। নারীর প্রতি যৌন হয়রানি উস্কে দেয়া এই ব্যাপক কাপঝাপ, পাড়ায় নতুন মেয়ে আসায় সেই মেয়ের জীবন বিষিয়ে তোলা ইভিটিজারদের হিরো হিসেবে দেখানো নাটক যেগুলো আবার হুহু করে বাড়া কিশোর গ্যাংকে নতুন মাত্রা দিতে যথেষ্ট, এই কালো যুগের দোষ এখন কাদের ঘাড়ে? যুক্তি আসতে পারে ভালো নাটক হচ্ছে, হ্যাঁ হচ্ছে কিন্তু নারীকে চুড়ান্ত হেয় প্রতিপন্ন করা, যৌন হয়রানি এবং ইভটিজিং উস্কে দেয়া এই বিষফোঁড়াগুলোকে সেই নাটকগুলো কি বাতিল করে দিতে পারছে?
বৃহস্পতিবারে পুরো পরিবার মিলে “এই সপ্তাহের নাটক”এও বিনোদন ছিল। নির্মাতা কলাকুশলীরা বিনোদন অনেকভাবেই দিতে পারেন তবে নারীকে হেয় করে তার প্রতি হয়রানি উস্কে দেয়া বিনোদন বোধহয় বাংলাদেশের নতুন ট্রেন্ডের মত নিখুঁত আর কোথাও দিতে পারেনা।
“হাওয়া” নামের নতুন যে মুভি আসছে, বলা হচ্ছে এই হাওয়া নাকি হাওয়া বদল করে দেবে বাংলা সিনেমার। আমারও সেই প্রত্যাশা। কিন্তু যেই শিশু বা কিশোর ছেলেটি সিনেমা হলে যেতে পারেনা, ওয়েব সিরিজের চমৎকার কনটেন্ট এর এক্সেস নেই, পরিবার পরিজন নিয়ে দেখার মত টিভিতে বাংলা কনটেন্ট নেই তার মনের হাওয়ার কি হবে? হালের ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে ইউটিউবে যা পাওয়া যায় সেই ভরসাই যখন তাকে যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, নারীকে নিচু ও হেয় প্রতিপন্ন করতে বাধ্য করে সেই হাওয়া কবে পাল্টাবে?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]