April 29, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

কুররাত আল আইন: রোম্যান্টিক বিপ্লবী, ইসলামী নারীবাদের পথ প্রদর্শক

বাংলা ভাষার ব্লগার, সামাজিক – রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এক সময়ের সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, যিনি স্বপ্ন দেখেন একটি লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক সংস্কৃতি ও সমাজের। নারীবাদ তাই তার চিন্তা, পড়াশোনা ও লেখালেখির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন – ইসলামী নারীবাদ: মুসলিম পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষের সংগ্রাম। আজ পড়ুন এর পঞ্চম পর্ব।।

 

এই লেখার সময়কাল যেহেতু ১৮০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত, তাই এই সময়ের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নারী নারীবাদীর জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে কিছু বিস্তারিত আলাপ থাকা দরকার। আর শুরুটা করা যেতে পারে ইসলামের ইতিহাসের দারুণ উল্লেখযোগ্য এক প্রতিবাদী নারী কুররাত আল আইন’কে দিয়ে। কিন্তু কুররাত আল আইনের সাথে সম্ভবত আরও একজন নারী প্রাসঙ্গিক হবেন আলোচনার জন্যে। তিনি এই শতকের একজন অভিজাত নারী যার অন্ততপক্ষে খানিকটা অবস্থান তৈরি হয়েছিল নারীর জীবন বদলে দেয়ার মত কিছু করার। শাহারজাদ মোজাব যেমনটা উল্লেখ করেছেন, ইসলামী সমাজে নারীর সংগ্রামের শুরুটা হয়েছিল অভিজাত নারীদের হাত ধরে। বেশিরভাগ সময়ই এই অভিজাত নারীরা নানান বাস্তবতার কারণেই তাদের শ্রেণিস্বার্থের বাইরে গিয়ে তাদের প্রতিবাদকে আরও গণমুখী করে তুলতে পারেন নি। যেমন উল্লেখ করা যেতে পারে মাহা শরাফ খানুম কুর্দিস্তানীর কথা।

মাহা খানুম জন্মেছিলেন ১৮০৫ সালে, কুর্দিস্তানের এক সামন্ত ভূস্বামী পরিবারে। বলা হয়ে থাকে গোটা উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্যের  মুসলিম সমাজে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী পেশাদার ইতিহাসবিদ। উচ্চশিক্ষিত ও জ্ঞানী নারী হিসাবে তাঁর নিজের সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও কদর ছিল। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তার ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতার কারণেই কুর্দি নারীদের জন্যে ইসলামী আকিদা বিষয়ক একটি প্রস্তাবনা হাজির করতে বলা হয় তাকে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নারীর অধিকারের অসমতার বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ হলেও লিখিত আকারে তিনি নারীর প্রসঙ্গে ইসলামী আকিদার যে প্রস্তাবনা হাজির করেন সেখানে সেই প্রসঙ্গটি ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। প্রায় একই সময়ের মানুষ ছিলেন কবি, বিপ্লবী কুররাত আল আইন, যার পারিবারিক নাম ছিল ফাতিমাহ বারাগানি উম্মে সালমি। তিনি জন্মেছিলেন ১৮১৪ সালে (মতান্তরে ১৮১৭ সাল) সেই সময়ের পারস্যের কাজভিন শহরে যা আজকের ইরানের একটি বড়ো শহর, তেহরান থেকে মাত্র একশো পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে। কুররাত আল আইন সময়ের বিবেচনায় মাহা খানুম এর মাত্র এক দশক পরে জন্মেছিলেন, কিন্তু ইসলামের ভেতরের ক্ষমতাতন্ত্রকে মোকাবিলা করার বৈপ্লবিক ভূমিকার জন্যে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। এই দুইশ বছরের ইতিহাসে তিনিই সম্ভবত প্রথম নারী ইসলামের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে।

গত প্রায় একশ ষাট বছর ধরে তাহিরী কুররাত আল আইন ইরানের ইতিহাসে নিষিদ্ধ একজন মানুষের নাম। যার নাম সকলেই জানেন, পরম বিশ্বাসী নারীদের কাছেও যিনি এক অন্য ধরনের প্রেরণার উৎস, এমন কি ইরানী পুরুষদেরও অনেকের কাছেই যিনি একজন বিপ্লবী নারী হিসাবে পরিচিত, অথচ কারো সাহস নেই কুররাত আল আইনকে নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশংসাসূচক লেখালেখি করার। ইরানের ইসলামী রাজতন্ত্র, কথিত সেকুলার জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রবাদী ক্ষমতাতন্ত্র এবং সবশেষের ইসলামী বিপ্লব পরবর্তী শিয়া ইসলামী ধর্মতন্ত্র এই সকল ক্ষমতাতন্ত্রই কুররাত আল আইনকে একজন ‘ঐতিহাসিক খলচরিত্র’ হিসাবে গণ্য করেছে এবং জনগণকে বাধ্য করেছে এই বিপ্লবী নারীকে নিয়ে গভীর নীরবতা পালন করতে, বাধ্য করেছে তার কথা প্রকাশ্য মাহফিলে উচ্চারণ না করতে, অন্তত প্রশংসাসূচক কোনো উচ্চারণ তো নয়ই। নিন্দা ও ঘৃণাবাচক স্তবকে অবশ্য তেমন বাধা নেই। কুররাত আল আইনের জীবন ও সংগ্রামের সাথে প্রত্যক্ষ অর্থে তো বটেই এমন কি প্রতীকী অর্থেও পরবর্তীকালের মুসলিম নারীর সংগ্রাম জড়িয়ে আছে আজও। বাংলা ভাষায় তাহিরী কুররাত আল আইন’কে নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য লেখা খুব সুলভ নয়, তাই খানিকটা ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে শুরু করাই ভালো হবে।

কুররাত আল আইনের জন্ম হয়েছিল অভিজাত শিয়া মুসলিম পরিবারে। পরিবারের দেয়া নাম ছিল ‘ফাতিমাহ বারাগানি’। অবশ্য তাঁর জন্ম সাল নিয়ে যেমন দ্বিমত আছে তেমনি তার পরিবার প্রদত্ত নাম নিয়ে গবেষকদের মাঝে ভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিলো ‘উম্মে সালমাহ’, কিংবা ‘জারিন তাজ’। যদিও তাঁর সময়ে এবং পরবর্তী কালে তাঁকে নানান নামে সম্বোধন ও স্মরণ করেছেন নানান লেখক, গবেষক। কেউ কেউ বলেছেন ‘জাকিয়াহ’ বা বুদ্ধিদীপ্ত, কেউ ডেকেছেন ‘নোকতা’ বা চিহ্ন, ‘তাহিরীহ’ বা বিশুদ্ধ, ‘খাতুন এ আযম’ বা পারস্যের রাজকন্যা। আবার কেউ কেউ তাঁকে সম্বোধন করেছেন ‘বিনতে তালেহ’ বা সাক্ষাত শয়তানের কন্যা হিসাবেও। তাঁর বাবা মোল্লাহ সালেহ ছিলেন একজন স্বনামধন্য ইসলামী আলেম। মোল্লাহ সালেহ ও তার ভ্রাতা মোল্লাহ ত্বকী উভয়েই ছিলেন কাজভিন প্রাদেশিক ইসলামী সমাজে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য দুজন ইসলামী আলেম। আজকের দুনিয়ায় ইসলামী ধর্মতন্ত্রের যে অমানবিক গোঁড়া ছবিটি আমরা দেখি প্রায় প্রতিটি সমাজেই, পারস্যের ইসলাম তেমনটা ছিলনা। ইসলামী পিতৃতন্ত্র প্রবলভাবে বিরাজ করলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বহু উদারনৈতিক ইসলামী আলেম সেই সময়ের পারস্যে ধর্মচর্চা ও ধর্ম প্রসারের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন। মোল্লাহ সালেহ ছিলেন সেই রকমের একজন উদারনৈতিক ইসলামী আলেম যিনি তার নিজের কন্যাকে তার ছাত্রদের সাথে একই সাথে পাঠগ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। একই শ্রেণিকক্ষে পর্দার পাশ থেকে কুররাত আল আইন পিতার কাছ থেকে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও পারস্যের ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ নেয়ার সুযোগ লাভ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, শ্রেণিকক্ষের কিশোর – তরুণদের সাথে ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করারও সুযোগ পেয়েছিলেন। কৈশোরেই ফাতিমাহ বা কুররাত আল আইন ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও পারস্যের সাহিত্যে এতোটাই পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন যে তার পিতা মোল্লাহ সালেহকে আক্ষেপ করে বলতে হয়েছিল যে ‘ও যদি মেয়ে না হয়ে আমার ছেলে হয়ে জন্মাতো, তাহলে সে পারস্যব্যাপী নাম অর্জন করতে পারতো আর আমার পরম্পরাকে বয়ে নিয়ে যেতে পারতো’। কিন্তু কে জানতো যে এই মেয়ে শুধু সুখ্যাতিই নয়, পরিবারের জন্যে ইতিহাসে এক ভয়ংকর ‘কলঙ্কজনক’ প্রসিদ্ধি বয়ে নিয়ে আসবে? সেই প্রসিদ্ধি হচ্ছে একটি প্রবল পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর সমতা দাবি করার মতো ‘ভয়ংকর’ দাবির স্বপক্ষে শুধু সংগ্রাম করাই নয়, সেই সমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নিজ ধর্ম ইসলাম ত্যাগ করে আরও সমতাভিত্তিক একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তিনি।

মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে চাচাত ভাই মুহাম্মদ আহমদের সাথে পারিবারিকভাবে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। সেই সময়ের প্রথা অনুযায়ী ইসলামী আলেম হবার উদ্দেশ্যে পুরুষ ছাত্রগণ প্রখ্যাত ইসলামী আলেমদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণের উদ্দেশ্যে নিজগৃহ ত্যাগ করে ‘শায়খ’ বা গুরুর গৃহে চলে যেতেন। স্বামীর এই পাঠগ্রহণের সূত্রে কুররাত আল আইনকে তাঁর স্বামীকে অনুসরণ করে বাগদাদে চলে যেতে হয়। বাগদাদে কুররাত আল আইন প্রায় তের বছর স্বামীর সংসার দেখভাল করে প্রায় চারটি সন্তান জন্ম দেন (মতান্তরে তিন সন্তান)। কিন্তু এই তের বছরে সংসার ও সন্তানাদি হলেও কুররাত আল আইনের সাথে তাঁর স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পর্কটি ভেঙ্গে পড়ে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়ার জন্যে দায়ী করেছিলেন ‘মেয়ে মানুষের বেশি পড়াশুনা করা’কে, ‘মেয়ে হয়ে বেশি বোঝা’কে। কিন্তু বাস্তবে তাদের সম্পর্কটি ভেঙ্গে পড়েছিল স্বামীর সাথে ইসলামের নানান বিষয়ে, প্রসঙ্গে কুররাত আল আইনের বোঝাপড়ার তফাতের কারণে। স্বামী মুহাম্মদ আহমদ প্রথাগতভাবেই ইসলামের প্রবল পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন আর অন্যদিকে কুররাত আল আইনের ব্যাখ্যা ছিল আল্লাহ যদি ন্যায়পরায়ন হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি নারী – পুরুষের মাঝে এতো ভেদ, অসমতার বিধান দিতে পারেন না। ইসলামের ব্যাখ্যায় নারী পুরুষের ভূমিকার এই বিপুল তফাত, অসমতা আসলে সবই ইসলামী পিতৃতন্ত্রের বানানো এবং নিশ্চিতভাবেই নারীর উপরে শোষণমূলক। কুররাত আল আইনের এই বোঝাপড়াকে শুধুমাত্র তাঁর স্বামীর পক্ষেই নয়, বরং তাঁর নিজের পিতা ও শ্বশুরের পক্ষেও মেনে নেয়া কঠিন ছিল। এমন কি সেই সময়ের সকল ইসলামী আলেমদের জন্যেও এই ধরনের প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ ছিল ভয়ংকর পাপ ও আল্লাহর ইচ্ছার ‘বরখেলাপ’।

ইসলামের তিনশ বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ইসলামের বিনির্মাণ পর্বেই (Formation period) ইসলাম নামের বিশ্বাস ব্যবস্থাটি কুক্ষিগত হয় খলিফা, আমীর, রাজা, সামন্ত, ভূস্বামী এই ধরনের নানান বর্গের ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর হাতে। সাধারণ বিশ্বাসী মানুষের সম্মুখে ধর্ম ও বিশ্বাস হাজির হতে শুরু করে নতুন স্বরূপ, নতুন বয়ান নিয়ে। এই সকল নতুন স্বরূপ আর বয়ানের একটা বড় অংশই হচ্ছে বিনির্মিত বয়ান  বা ‘Constructed Narrative’, যার মূল লক্ষ্য ছিল যেকোনোভাবেই হোক ধর্মকে ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে ক্ষমতাতন্ত্রের পক্ষে ব্যবহার করা, ক্ষমতাতন্ত্রকে নিরাপদ করা। ইসলামের প্রধান দুটি ঘরানা সুন্নি ও শিয়া উভয় অংশই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে এই ধরনের ক্ষমতাতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে। নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর দিন থেকেই এই ক্ষমতাতন্ত্রের লড়াইয়ের ইতিহাসের শুরু। শুরুতে নবীর পরিবার ও তাঁর বিশ্বস্ত মানুষের মাঝে এই ক্ষমতাতন্ত্রের লড়াই সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে তা ছড়িয়ে পড়ে অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতাতন্ত্রের মাঝে লড়াইয়ে। যে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল মানুষের ধর্ম হিসাবে, তার দখল চলে যায় ‘বংশ পরম্পরা’র কাছে। ফলে খিলাফতের নামে সুন্নি ও শিয়া উভয় ঘরানার মাঝেই বিশ্বাসের দখল চলে যায় অসংখ্য পরিবার বা বংশকেন্দ্রিক ক্ষমতাতন্ত্রের কাছে। ধর্ম যখন বিশ্বাস ব্যবস্থা থেকে ক্ষমতাতন্ত্রের ভিত্তি হিসাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে তখন থেকেই বিশ্বাসী মানুষের সংগ্রাম শুরু হয় তাদের বিশ্বাসকে ক্ষমতাতন্ত্রের হাতিয়ার হওয়া থেকে রক্ষার করার। দশম শতক থেকেই আরব, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, ইরান ও ইরাকের শাসন ক্ষমতা তাই চলে যায় এই সকল ‘বংশ’কেন্দ্রিক ক্ষমতাতন্ত্রের কাছে। ফলে বিভিন্ন স্থানে এই সকল ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম গড়ে ওঠে যার নেতৃত্বে বেশিরভাগ সময়েই ইসলামী পুরুষ আলেমদের একটি অংশ ছিলেন, ইসলামের দীক্ষায় শিক্ষিত নারীর ভূমিকা ছিল খুবই অনুল্লেখযোগ্য। অন্তত মধ্যযুগের পরের ইতিহাসে কুররাত আল আইন সম্ভবত প্রথম প্রকাশ্য নারী বিপ্লবী যিনি ক্ষমতাতন্ত্রের হাত থেকে তাঁর বিশ্বাসকে রক্ষার করার জন্যে আত্মাহুতি দেন। ইরানের শিয়া ইসলামী বংশকেন্দ্রিক ক্ষমতাতন্ত্রের নিপীড়নমূলক চরিত্রের কারণে ইরানের ইসলাম অনুসারী একটি অংশের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে আস্থার জায়গাটি দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। এদেরই একটি অংশ সৈয়দ আলী মুহাম্মদ সিরাজির নেতৃত্বে এক ‘অন্য ধরনের’ ইসলামের সন্ধানে জড়ো হতে থাকেন। ইসলামের নামে যে শিয়া ক্ষমতাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল ইরানে তার থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে ১৮৪৪ সালে আলী মুহাম্মদ সিরাজি গড়ে তোলেন ‘বাব’ আন্দোলন। ফার্সি ‘বাব’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে দরোজা। আক্ষরিক অর্থেই শিয়া ইসলামের নিপীড়নমূলক বাস্তবতা থেকে রক্ষা পাবার জন্যে, আরও অনেক বেশি কল্যাণমূলক ও সমতাভিত্তিক ইনসাফের সমাজ গড়ে তোলার জন্যে আলী মুহাম্মদ সিরাজির নেতৃত্বে একদল শিয়া মুসলিম একটি নতুন ধর্মের কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। আরও অনেক পরে যা বাহাই ধর্ম হিসাবে আবির্ভূত হয়। এই নতুন ধর্মের কাছে প্রত্যাশার একটি প্রধান দিক ছিল শিয়া ইসলামের নারী পুরুষের মাঝে যে বিদ্যমান অসমতা ও বৈষম্য তা দূর করা। নারী পুরুষের এই সমতাভিত্তিক সমাজের প্রত্যাশার দিকটিই আকৃষ্ট করে কবি কুররাত আল আইনকে এই আন্দোলনের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে। একটি নিবেদিত প্রাণ মুসলিম পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি মূল ইসলাম থেকে সরে গিয়েছিলেন কেবল নারীর প্রতি তার সময়ের মূলধারার ইসলামের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। ইরাকের কারবালাকেন্দ্রিক পণ্ডিত শায়খ আহমদ আশাই’র দর্শনের শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্যে তিনি ইরান থেকে কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শায়খ আহমদ আশাই’র শিষ্য কাজিম রশতি’র সরাসরি শিষ্যত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্যে সেই সময় তিনি একাই কারবালা যাত্রা করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে পৌঁছানোর আগেই তাঁর দার্শনিক গুরুর মৃত্যু ঘটে। কারবালার উদ্দেশ্যে যখন তিনি যাত্রা করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র তেইশ বছর (মতান্তরে ২৬ বছর)। খুব স্বাভাবিক প্রথাগত কারণেই তাঁর এই যাত্রার ঘোরবিরোধী ছিলেন তাঁর নিজের পিতা, স্বামী ও শ্বশুর। কিন্তু নিজের বোধের কাছে এতোটাই সংকল্পবদ্ধ ছিলেন কুররাত আল আইন যে সেই সময় ইরানের মতো একটি চরম সংরক্ষণবাদী সমাজের একজন নারী হিসাবে নিজের মতামতকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাকেই তিনি প্রধান কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন। ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাঁর এবং তিনি সন্তানদের অভিভাবকত্ব হারান। কিন্তু এরপরেও তিনি নিজেকে নিবেদিত করেন এক নতুন ধর্মীয় দর্শনের প্রচারে।

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই কুররাত আল আইন ‘বাবি’ আন্দোলনের একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতার পর্যায়ে উত্তীর্ণ হন তাঁর গভীর পড়াশুনা ও সৃজনশীলতার জন্যে। শিয়া ইসলামের ইতিহাস, আইনশাস্ত্র ও দর্শন বিষয়ে বিশেষ পাণ্ডিত্যের জন্যে সেই সময়ের বাবি আন্দোলনের অনেক পুরুষ অনুসারীরাও তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রামের সাথে যুক্ত হন। কুররাত আল আইন তিন বছর কারবালায় অবস্থান করেন, পরবর্তীকালে ১৮৪৭ সালে ইরানে ফিরে আসার পর থেকেই সেই সময়ের শিয়া ক্ষমতাতন্ত্র তাকে এক রকমের নজরদারীর মধ্যে রাখে। ক্ষমতাতন্ত্রের নজরদারী এড়ানোর জন্যে ভিন্ন ভিন্ন শহরে আত্মগোপন করেছেন, গোপন বৈঠক করেছেন তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে। যখন ইরানের সমাজে পরিবারের বাইরের পুরুষের সাথে কথা বলাও নিষেধ তখন তিনি তাঁর পুরুষ অনুসারীদের উদ্দেশ্যে একের পর এক গোপন সভায় বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। সবচাইতে অবাক করা হলেও সত্যি যে সেই বক্তৃতাগুলোতে কুররাত আল আইনের মাথায় কখনোই হিজাব থাকতো না, নারীর জন্যে ইসলামের প্রথাগত পোশাকের বিধিবাধ্যকতা তিনি কখনোই অনুসরণ করেন নি । তিনি মনে করতেন হিজাব পরা বা না পরার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণই নারীর নিজের। হিজাব ও নারীর পোশাক বিষয়ে ইসলামী পিতৃতন্ত্রের বেঁধে দেয়া কাঠামোকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং এক পর্যায়ে সেই কথিত কাঠামোকে তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নারী প্রসঙ্গে শিয়া ইসলামের বয়ানকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করা, পরিবারের বাইরের পুরুষদের সাথে নতুন ধর্মীয় দর্শনের প্রচারণা আর নারীর প্রথাগত পোশাক হিজাব প্রায়শই বর্জন করার মতো ‘অপরাধ’ এর কারণে তাঁর সাথে স্বামী ও শ্বশুরের সম্পর্ক বিচ্ছেদ ঘটে। স্বামী ও শ্বশুরের সাথে বিচ্ছেদ তাকে তাঁর ধর্ম প্রচার থেকে টলাতে না পারলেও তাঁর গতিবিধিকে সীমিত করে দেয় তাদের বিরোধিতা। এশিয়াটিক জার্নাল এর ১৮৬৬ সালের সপ্তম সংখ্যায় কুররাত আল আইনকে নিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধে বিস্ময় প্রকাশ করা হয় যে একটি চরম সংরক্ষণবাদী ইসলামী পরিবারে জন্ম নিয়ে, একটি অত্যন্ত পুরুষনিয়ন্ত্রিত সমাজে ও সংরক্ষণবাদী মফস্বল এলাকার মেয়ে হয়ে কিভাবে এরকমের নেতৃত্ব পর্যায়ে উঠে এসেছিলেন কুররাত আল আইন। তাঁর পুরুষ অনুসারীগণ বিমুগ্ধ হয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনতেন বলে ইতিহাস রয়েছে। তাঁর দুটি নাম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, ‘কুররাত আল আইন’ আর ‘তাহিরিহ’ এর কোনটিই তাঁর পরিবার প্রদত্ত নাম নয়, বরং দুটোই তাঁর দুই দার্শনিক গুরুর দেয়া নাম। এই নামেই তিনি ইরানের পরবর্তী কালের সকল নারী ও নারীবাদী মানুষের কাছে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন।

কুররাত আল আইন পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিলেন তাঁর ঘর থেকেই। অর্থাৎ তাঁর পিতা, দুই চাচা ও স্বামীকে চ্যালেঞ্জ করার মধ্যে দিয়েই ইসলামের মোল্লাতান্ত্রিক বোঝাপড়ার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান নেয়ার শুরু হয়। আগাগোড়াই তিনি এই সকল প্রথাগত মোল্লাদের ইসলাম বিষয়ক বোঝাপড়াকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তাঁর নিজের পাঠ ও বোঝাপড়া দিয়ে। পিতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে মতবিরোধের এক পর্যায়ে তিনি তাদের সাথে সরাসরি বিতর্ক করা এমন কি কথা বলাও বন্ধ করে দেন, তবে শুধুমাত্র পিতাকে ধর্মীয় নানান বিষয়ে লিখিতভাবে প্রশ্ন করতেন। এই রকমের মোকাবিলা পাল্টা মোকাবিলার এক পর্যায়ে ১৮৪৭ সালে তিনি বাগদাদকেন্দ্রিক ইসলামী আলেমদের বোঝাপড়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং তাঁর সাথে বিতর্কে আহ্বান করেন। কিন্তু বাগদাদকেন্দ্রিক ইসলামী আলেমদের কেউই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর সাথে বিতর্কে রাজী হন নি, বরং তাঁরা সকলেই বাগদাদের ইসলামী শাসককে চাপ প্রয়োগ করেন কুররাত আল আইনকে পুনরায় ইসলামী আলেমদের কাছে পাঠানোর জন্যে যেন তাঁর কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে তাঁকে নতুন করে শিক্ষিত করে তোলা যায়। এই চাপের মুখে সেই সময়ের বাগদাদের প্রশাসক তাকে নতুন করে ইসলামী জ্ঞানের অর্জনের জন্যে সেই সময়ের বাগদাদের কাজী ও প্রখ্যাত ইসলামী আলেম ইবনে আলুসি’র কাছে প্রেরণ করেন। বলাই বাহুল্য খোদ ইবনে আলুসি নিজে মুগ্ধ হয়ে যান কুররাত আল আইনের ধর্মীয় পাণ্ডিত্যে। কিন্তু তিনি তাঁকে ব্যাখ্যা করেন যে তাঁর পক্ষে কুররাত এর পক্ষ নেয়া অসম্ভব কেননা তাঁকেও কাজ করতে হয়ে ধর্মীয় ক্ষমতাতন্ত্রের তরবারির নিচেই।

সেই সময়ের ইসলামী পিতৃতন্ত্রের কাছে তাহিরিহ কুররাত আল আইন এক পর্যায়ে একজন আতংকের নাম হয়ে ওঠেন। কেননা কুররাত আল আইন তাঁর সমকালীন অনেক পুরুষ পণ্ডিতদের চাইতেও অধিক পাঠ করা একজন নারী যা ইসলামী পিতৃতন্ত্রের কাছে দারুণভাবে অগ্রহণযোগ্য একটি বাস্তবতা। ইসলামী সমাজে একজন নারী কখনোই ধর্ম ব্যাখ্যাকারী হিসাবে কর্তৃত্ব অর্জন করেন না, করতে পারেন না। ইসলামী সমাজে ঐতিহাসিকভাবেই ধর্ম, কুরআন ও সুন্নাহকে ব্যাখ্যা করার একচ্ছত্র অধিকার পুরুষের। আজও এই ২০২১ সালেও সারা পৃথিবীর ইসলামী সমাজগুলোতে ইসলামের সকল রকমের বয়ান, ব্যাখ্যা গড়ে উঠেছে পুরুষ ইসলামী আলেমদের দ্বারা। এমন কি ‘ইসলামী আলেম’ এই শব্দবন্ধটিও পুরুষবাচক। কুররাত আল আইন এই প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। সম্ভবত তিনিই সর্বপ্রথম বলেছিলেন আল্লাহর বানীকে বোঝার, ব্যাখ্যা করার অধিকার সকল বিশ্বাসী মানুষের হক এবং এই হক আদায়ের ক্ষেত্রে নারী – পুরুষের মাঝে কোনও তফাত নেই। কুরআন ও সুন্নাহকে পাঠ করার ও ব্যাখ্যার অধিকার নারীর ঠিক ততটুকুই যতটুকু একজন পুরুষের।

নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা নিয়ে ইসলামী সমাজের প্রতিষ্ঠিত ধারণা হচ্ছে নারী পুরুষের চাইতে ‘কম’ বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা ধারণ করেন এবং নারীর উপরে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার দেয়া। এই প্রথাগত ইসলামী ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন কুররাত আল আইন। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নারী পুরুষের সমান তো বটেই এমন কি পুরুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে শুধুমাত্র যথাযথ সুযোগ লাভ করলে। তিনি শুধু এই ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করেননি, বরং তিনি প্রকাশ্যে সেই সময়ের পুরুষ ইসলামী আলেমদেরকে ইসলামের বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিতর্কের জন্যে আহ্বান করতেন। তিনি তাদেরকে প্রকাশ্য বিতর্ক বা পাবলিক ডিবেইটের জন্যে আহ্বান করেছেন প্রায় নাম ধরে ধরে যা ছিল সেই সময়ের ইসলামী পিতৃতন্ত্রের জন্যে চরম বিব্রতকর ও ক্রোধ উদ্রেগকারী। তাই কুররাত আল আইন একজন পণ্ডিত মানুষ হবার বদলে ইসলামী পিতৃতন্ত্রের কাছে হয়ে ওঠেন একজন নিয়ন্ত্রনহীন ‘অবাধ্য’ নারী। সারা দুনিয়াতেই ‘অধিক শিক্ষিত’ নারীকে সমাজ খল চরিত্রায়ন করেছে, অধিক শিক্ষিত ও বিদূষী নারী ততক্ষণ পর্যন্ত সহনীয় ও গ্রহণযোগ্য যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর জ্ঞান পুরুষের জ্ঞানকে ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ না করে।

ফারজানেহ মিলানি তাঁর লেখা ​​’Words, Not Swords: Iranian Women Writers and the Freedom of Movement’ পুস্তকে কুররাত আল আইনকে উপস্থাপন করেছেন আরও দুইটি বিশেষ ঘটনার সাথে উপমিত করে। কার্ল মার্কস ও তাঁর রাজনৈতিক বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস মিলে ১৯৪৮ সালে প্রকাশ করেন কমিউনিস্ট ইশতেহার আর দুনিয়ার আরেক প্রান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই একই বছর ঘটে চলেছিল আরেক মহান ঘটনা, জুলাই মাসে নিউ ইয়র্ক শহরের সেনেকা ফলস সম্মেলন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী অধিকার আন্দোলনের প্রকাশ্য কর্মসূচী ছিল। সেনেকা ফলস সম্মেলনের সংগঠকদের একজন এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটনের বক্তৃতায় উঠে এসেছিল সেই সময়ের নারীর কণ্ঠ –

“আমরা এখানে সমবেত হয়েছি এমন এক ধরনের সরকার ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানাতে যে সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, অস্তিত্বশীল হয়ে আছে এবং শাসন করছে শাসিতদের সম্মতি ছাড়াই। আমরা এখানে এসেছি আমার মুক্তি ও স্বাধীনতার দাবি ঘোষণা করতে, মানুষ হিসাবে আমাদের মুক্তির কথা, ঠিক যেমনটা পুরুষ মুক্ত। আমরা এখানে এসেছি সরকারে আমাদের প্রতিনিধিত্বের কথা জানাতে, যে সরকার থেকে আমরা আমাদের ট্যাক্সের টাকায় চালাই সেই সরকারে আমাদের প্রতিনিধিত্বের দাবি জানাতে। আমরা এসেছি সেই সকল আইনের প্রতিবাদ জানাতে যে সকল লজ্জাজনক আইনের বলে পুরুষ নারীর উপরে তাদের ক্ষমতার চর্চা করতে পারে, নারীকে চাইলেই বন্দী করতে পারে, নারীর উপার্জন নিজের বলে নিয়ে নিতে পারে, এমন কি নারীর উত্তরাধিকার ও সন্তানও কেড়ে নিতে পারে।”

সেনেকা ফলস সম্মেলন রাতারাতি কিছু এনে দেয়নি নারীকে, কিন্তু এই সম্মেলনটিই বদলে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীর ইতিহাসকে।

সেই একই বছর অর্থাৎ ১৮৪৮ সালে ইরানের বাদাশত শহরে সংগঠিত হয়েছিল সেই সময়ের ‘বাবি’ আন্দোলনের প্রথম সম্মেলন। ব্যক্তিগত বিশ্বাস ব্যবস্থা থেকে ইসলাম যখন ক্ষমতাতান্ত্রিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে রূপান্তরিত হয় তখন নানান দিক থেকে ইসলাম ত্যাগ করা মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে এই আধ্যাত্মিক ‘বাবি’ আন্দোলন যা পরে বাহাই ধর্ম হিসাবে আবির্ভূত হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে সেদিন এই গোপন সম্মেলনে একাশি জন পুরুষের মাঝে একমাত্র নারী হিসাবে এবং বাবি আন্দোলনের নেত্রী হিসাবে হাজির হয়েছিলেন কুররাত আল আইন। প্রবল পরাক্রমশালী ক্ষমতাতান্ত্রিক ধর্ম ব্যবস্থা ইসলামের বিপরীতে আরও সমতাভিত্তিক ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাস হিসাবে বাহাই ধর্মের পথ চলার ঘোষণা দেন কুররাত আল আইন। বাবি আন্দোলনের সম্মেলনে কুররাত আল আইন এক অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন যা তাঁর পুরুষ সহকর্মীরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছিলেন। এই আবেগঘন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন –

“কিয়ামত ও পুনুরুত্থানের দিনে যে শিঙ্গা বেজে উঠবে, আমি তার দোহাই দিয়ে আপনাদের ডাক দিচ্ছি, ভাইসকল জেগে উঠুন। জেগে উঠুন ভাই সকল, কুরআন তার প্রতিশ্রুতি রেখেছে, এখন নতুন দিনের শুরু! আমি কি আপনাদের বোন নই? আপনারা কি আমার ভাই নন? যদি একজন নারীর হিজাববিহীন মুখ দেখে আপনি আপনার মনের কলুষতাকে দূরে সরিয়ে দিতে না পারেন তাহলে কুরআন যে বিরাট কল্যাণের দায়িত্ব দিয়েছে আমাদের উপরে তা কিভাবে এগিয়ে নেবেন? কিভাবে কুরআনের সেই মহান কারণকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি করবেন? আপনারা কি জানেন না যে পর্দা প্রথাকে আজকে ভয়ংকর কড়াকড়ির মতো করে আরোপ করা হচ্ছে খোদ মহানবী কখনোই সেরকমের করে তা আরোপ করেন নি? আপনারা কি কখনোই শোনেন নি যে মহানবীর সাথে তাঁর বিভিন্ন যাত্রাপথে সঙ্গী হওয়া তাঁর স্ত্রীদের মুখমণ্ডল সবসময় খোলা থাকতো? আপনারা কি কখনো শোনেন নি যে মহানবী প্রায়শই তাঁর সাহাবীদের পাঠাতেন তাঁর স্ত্রীদের কাছ থেকে কিছু কিছু বিষয়ে পরামর্শ নেয়ার জন্যে? তাদের কাছ থেকে শুনে আসতে? এমন কি মহানবীর সময়ে এসব ‘আইন’ হিসাবে হাজির না থাকলে আজকে আমাদের সামনে দারুণ এক আলোকিত সময় হাজির হয়েছে, এটা নিজেদের জেগে ওঠার দিন। আসুন পুরুষের হৃদয়কে সেই আলোতে জাগিয়ে তুলি। আসুন আমাদের নারীদের মুক্তির মধ্যেদিয়ে আমাদের সমাজকে সংস্কার করি, আমাদের কুসংস্কার আর আত্মাভিমানের কবর থেকে নিজেদেরকে বের করে নিয়ে আসি, বিচার দিন কিন্তু সমাসন্ন, এখনই সময় সারা দুনিয়ার জেগে ওঠার। বিবেক আর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দেয়ার এখনই সময়। আমার নিজেকেই মনে হচ্ছে যেন এই জেগে ওঠার ডাক”।

সেনেকা ফলস সম্মেলনে দুইশো ষাট জন নারীর সাথে চল্লিশ জন পুরুষ হেঁটেছিলেন। আর বাদাশত সম্মেলনে একাশি জন পুরুষের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একা কুররাত আল আইন। এই পুরুষদের সকলেই তাঁর প্রতি সদয় ছিলেন না। এই পুরুষদের সকলেই সাংস্কৃতিকভাবে, ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে নারীর নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার জন্যে তৈরি ছিলেন না। তাই কুররাত আল আইনের সংগ্রাম ছিল সেনেকা ফলসের নারী আন্দোলনকারীদের চাইতেও আরও অনেক দুস্তর, কঠিন। সেনেকা ফলস আন্দোলনের সংগঠকের বক্তব্য আর কুররাত আল আইনের বক্তৃতার মাঝে কি কোনো মৌলিক তফাত আছে? দুপক্ষই দাবি করছেন নারীর অধিকার, যে অধিকার দখলকৃত হয়ে আছে পুরুষ আর পিতৃতন্ত্রের হাতে। সেনেকা ফলসের সংগ্রামীদের সংগ্রাম আধুনিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, পিতৃতান্ত্রিক আইনের বিরুদ্ধে। কুররাত আল আইনের সংগ্রাম তাঁর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাঁর বিশ্বাস যে দখলদারদের হাতে বন্দী হয়েছে, বেহাত হয়েছে সেই দখলদার ইসলামী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যেকোনো সংবেদনশীল পাঠ আমাদের বলে দেবে যে এই দুই এই আন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষা আসলে একই, মানুষের সমতাভিত্তিক সমাজ, যেখানে কেবল লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে নারীকে অধিকারহীন হয়ে থাকতে হবেনা।

বাদাশত সম্মেলনের পর থেকেই কুররাত আল আইনের উপরে নজরদারী বেড়ে যায়। সেই সময়ের ইরানের কাজার বংশীয় শিয়া ইসলামী শাসকযন্ত্র তাকে তাড়িয়ে ফিরেছে এক জায়গা থেকে অন্য যায়গায়। প্রধান সড়কে তাকে অপদস্থ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে। নারীকে অসৎ পথে পরিচালিত করার অভিযোগ দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নিজের ধর্ম বিষয়ক বোঝাপড়া ও ইসলাম ত্যাগ করে নতুন সাম্যভিত্তিক ধর্ম ও বিশ্বাস ব্যবস্থা গড়ে তোলার অপরাধে তাঁর সাথে পরিবারের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। ঠিক এই রকমের একটি সময়ে কুররাত আল আইনের শ্বশুর মোল্লা ত্বকীকে নামাজ পড়া অবস্থায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী পরে নিজ থেকেই ধরা দেয় এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দেয়, কিন্তু তবুও এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়ানো হয় কুররাত আল আইনকে এবং সেই অপরাধে তাঁকে প্রথমে অন্তরীন রাখা হয় এবং পরবর্তীতে হত্যা করা হয়।

কার্ল মার্কস আর ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ইশতেহার আজও দুনিয়ার নানান প্রান্তে মানুষকে উজ্জীবিত করে চলেছে। আজও সমগ্র পশ্চিমা দুনিয়া মাঝে মাঝেই কমিউনিজমের ভুত দেখে আতংকিত হয়ে ওঠে। পৃথিবীর দেশে দেশে সাম্যবাদী গণআন্দোলনকে ঠেকানোর জন্যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আর তার সরকারগুলো কাড়ি কাঁড়ি টাকা বরাদ্দ করছে। আর সেনেকা ফলস সম্মেলন তো সারা দুনিয়ার নারীদের অধিকার আদায়ের প্রতীক হয়ে আছে ইতিহাসে। সেনেকা ফলস আন্দোলন বদলে দিয়েছে মার্কিন সমাজের নারীদের রাজনৈতিক অবস্থানকে। কিন্তু প্রবল ক্ষমতাতান্ত্রিক ইসলামী পিতৃতন্ত্র ইসলামের ইতিহাসে তো বটেই এমন কি ইরানের ইতিহাস থেকেও কুররাত আল আইনকে উধাও করে দিয়েছে। পদ্ধতিগতভাবে মানুষকে বাধ্য করা হয়েছে কুররাত আল আইনকে ভুলে যেতে। তাঁর সংগ্রামকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘বিদআত’ হিসাবে, ‘ফিতনা’ হিসাবে। তাঁকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘খল চরিত্র’ হিসাবে, ‘বাজে মেয়ে মানুষ’ হিসাবে। সারা দুনিয়াতেই ইসলামী পিতৃতন্ত্রের সবচাইতে বড় সাফল্য হচ্ছে ধর্মের নামে, ধর্মের বর্ম ব্যবহার করে, কুরআন ও হাদিসকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে  ইসলামী পিতৃতন্ত্র শুধু তার ইতিহাসের নারীর মুক্তিসংগ্রামের দারুণ মেধাবী বিপ্লবীদের খুনই করেনি, বরং এর সাথে সাথে সেই সংগ্রামগুলোকেও খুন করেছে, বিদায় করে দিয়েছে ইতিহাস থেকে। তাই দুশ বছর আগে ইরানের কাজভিন প্রদেশের তরুণী কুররাত আল আইন যে সমান অধিকারের দাবি নিয়ে এসেছিলেন, সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, নিজের জীবন দিয়ে সেই একই দাবি নিয়ে আজও মুসলিম বিশ্বাসী নারীরা সংগ্রাম করে চলেছেন আরব দেশগুলোতে, ইরানে, ইরাকে, মরক্কো, তিউনিসিয়া, আফগানিস্তানে, ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে।

প্রায় দুশ বছর আগে কুররাত আল আইন তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন –

‘বন্ধুরা দরোজায় দাঁড়িয়ে, কড়া নাড়ছেন,

দরোজা খুলুন হে দ্বাররক্ষক,

কি এমন বাধা এই দ্বার খোলাতে?

আর কাঁহাতক এভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইবো?

কতোটাই বা সবুর করা যায়?

আর কতদিনই বা এই পথ তৈরি করা?’

(‘বন্ধুরা দরোজায় কড়া নাড়ছেন’ – কুররাত আল আইন)

হয়তো একদিন কুররাত আল আইনের সংগ্রাম সফল হবে নতুন বিশ্বাসী নারীদের মুক্তি সংগ্রামের মধ্যদিয়ে। সেদিন হয়তো ইসলামী পিতৃতন্ত্র পরাস্ত হবে, ইসলামী পিতৃতন্ত্রের দ্বাররক্ষীরা দরোজা খুলে দিতে বাধ্য হবেন। কুররাত আল আইনকে নিয়ে সেদিন হয়তো নতুন ইতিহাস লেখা হবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *