পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০৩]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।।
সকাল থেকে লাইব্রেরিতে এসে বসে আছে দোলন। উদ্দেশ্য– দুই একটা রেফারেন্স বই ঘাটাঘাটি আর খানিকটা লেখালেখি যদি এগিয়ে নেয়া যায়। বই পড়ার দুর্নিবার নেশা ছুটতে বসেছে ভারচুয়াল জগতের তোপে। কিন্তু ইচ্ছেটা উবে যায়নি। এখনও নতুন বা পুরনো বইয়ের পাতার ঘ্রাণে ডুবে থাকতে মন চায় ঘন্টার পর ঘন্টা। দোলনের অনেকদিনের ইচ্ছে– একটা লাইব্রেরি করবে, সাথে ছোট্ট কফি কর্নার– হতে পারে চেনা অথবা একেবারে অচেনা কোনো শহরে।…
“এই যে আব্বু! এই দেখো! এটাই হলো লাইব্রেরি!”
– একজন ভদ্রমহিলা তার স্কুল-ফেরত বাচ্চাকে নিয়ে ঢুকলেন লাইব্রেরিতে। দৃশ্যটা সুন্দর হলেও উচ্চস্বরে কথা বলাটা কানে বাঁধলো।
“কোন বই পড়বে? এই দেখো কত বই!”
একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে ঘুরপাক খেতে মজা পাচ্ছে আট/ নয় বছরের ছেলেটা। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, দেখি ভালো লাগে কি না!
“সব বই পড়ে শেষ করবে আব্বুটা! আমার বিএ পাশ ছেলে তো! আব্বু তাকাও! সেল্ফি নেই একটা। !”– দ্বিগুণ উৎসাহিত মা।
লাইব্রেরির পিনপতন নীরবতাটুকু উপভোগ করছিলো দোলন। মা-ছেলের অস্থির আগমনে মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটে। বইয়ে চোখ রেখে পড়ার ভান করলেও লাভ হয় না।
তাক থেকে কবিতার বই এনে ছুটন্ত ছেলের পেছনে মাও ছুটতে থাকেন– “আব্বু, এই যে কবিতার বই। তুমি তো কবিতা ভালোবাসো!”
বই খুলে বলেন, “জোরে জোরে পড় আব্বু! আচ্ছা দাও আমি পড়ে শোনাই।”
ছেলে খালি চেয়ারটা আরো জোরে ঘুরান দিয়ে বলে, “কোন কবিতা? উনি আবার কে?”
মা গর্বের সাথে জোরে হেসে ওঠেন, যেন তার ছেলে পৃথিবীর সেরা কৌতুকখানা বলে ফেলেছে!
: উনি কেউ না আব্বু। কি করে যে তোমাকে বোঝাই এটাই তো বুঝতেছি না!
: আম্মু, আমিও যখন কিছু বুঝতেছি না, তুমিও বুঝতেছো না– তাহলে চলো বাসায় যাই। নাইলে মোবাইলটা দাও। ভাল্লাগতেছে না। এখানে কিচ্ছু নাই।
: আব্বু, কী করলে যে তোমার কইলজাটা ভরবে এইটাই তো বুঝি না বাপজান!
বাচ্চার হাইপার হবার কারণ বোঝা গেলো– মোবাইল ফোন। প্রথম থেকে মা-ছেলের অস্থির উপস্থিতি বিরক্তিকর লাগলেও আসক্তি দূর করতে মা লাইব্রেরি দেখাতে এনেছেন এটা ভেবে ভালো লাগলো। কিন্তু বেচারির দিশেহারা অবস্থা দেখে খারাপই লাগে। বড়রা আসলে বুঝতেই পারে না যে, কোথায় ভুল হয়ে যায়।
ফোনটা ভাইব্রেট করছে। দোলন বের হবার প্রস্তুতি নেয়। আজকের মতো লেখাপড়ার এখানেই ইতি।
“তুই কি ব্যস্ত?”– ফোনে রিমির এই প্রশ্নটা দোলনের খুব পরিচিত। এই প্রশ্নের মানে হলো রিমির অনেক কথা জমা হয়ে আছে বলবার জন্যে। রিমির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয় এমন না। কিন্তু সম্পর্কটা এমন যে, বছর জুড়ে যদি দেখা-কথা নাও হয়, তাতে দোলন বা রিমি কারো কিছু যায় আসে না।
ব্যস্ত থাকলেও নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। ফোন না ধরতে পারলে, মেসেজ না দিতে পারলে জবাবদিহিতার ব্যাপার নেই। এই ধরনের বন্ধুত্ব এখন নির্ভার লাগে৷
বল! দম ফেলার সময় পাইনি এই কয়দিন। এখন সময় আছে, বল!– দোলন আশ্বস্ত করে।
ওপাশ থেকে সাড়াশব্দ নেই।
: অ্যাই রিমি! কী হয়েছে?
: নতুন করে কিছু হয়নি রে! হাঁপিয়ে উঠি আজকাল।
: জ্বর কমেনি?
: জ্বর বলে শুয়ে থাকার জো আছে আমার?
: ছুটি নে কয়টা দিন! তোর বিশ্রাম দরকার।
: ছুটি নিলে আরো কাজ বাড়ে। অফিস থেকে ফিরে দুনিয়ার কাজ। ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাকলেও ছুটি তো আর কাটানো হয় না রে! ছুটি কী আর এই জন্মে কপালে আছে? আমি যে মেশিন না, আমারো যে ব্রেক লাগে– এইটা কেউ বুঝলে তো!
: তোরটা তোরই বুঝতে হবে রিমি! আর এই “কপাল” আর “মেয়ে হয়ে জন্মানো”র দোষ – এইসব টিপিক্যাল কথা তোর মুখে মানায় না।
বিরক্ত হয় দোলন।
: তা নাহয় বললাম না। বুকে হাত দিয়ে বল তো, তুই পেরেছিস সংসার থেকে ছুটি নিতে?
: শোন, আমি রাস্তায়। রাখছি এখন। পরে কল দিচ্ছি।
রিমির এইসব হতাশার কথা দোলনের ভালো লাগে না। দিনের পর দিন অশান্তি করে সুজনের সাথে সংসার টিকাতে মরিয়া রিমি। কিছুতেই পারছে না বলয় থেকে বের হতে। জীবনের হিসেব সহজ হলে হয়তো অস্থিরমতি শিশুটির মতো বলে দিতে পারতো– এ সংসারের মানে তুমি আর আমি কেউই যখন বুঝতে পারছি না, চলো যে যার পথ খুঁজে নেই।
রিকশা নেবার জন্য হেঁটে সামনে এগোয় দোলন।
রিমির প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতে থাকে– আসলেই কী সংসার থেকে ছুটি নিতে পেরেছে সে?
[চলবে]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।