ওষুধ যেখানে দরকার, সেখানে দিন
কানিজ ফাতেমা তনিমা ।। “শিরে দিয়ে বাঁকা তাজ/ ঢেকে রাখে টাক”। এই তথাকথিত সভ্য সমাজে শিক্ষাটা নারীর জন্য ঠিক বাঁকা তাজের ভূমিকা রাখছে বলে আমার ধারণা।
নারীর অধিকার শিক্ষা আর কিছু সংরক্ষিত আসনের মাঝেই সীমাবদ্ধ। সব ধরনের স্বাধীনতাও যে তার অধিকার সেই কথা মানতে নারাজ পুরুষাধিপত্যবাদীরা। নারীর অধিকার বলতে আসলে যা বোঝায় তার একশ ভাগের দশভাগও পূরণ হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ।
ক’জন নারী তার অধিকারের কথা বলে? ক’জন নারী নিজের মতো করে বাঁচে; নিজের জন্য বাঁচে? ক’জন নারী স্বাধীনতার স্বাদ পেতে লড়াই করে? ক’জন নারী স্বাধীন?
অবশ্যই এই সংখ্যাটা নিতান্তই কম কিন্তু শিক্ষিত নারীর সংখ্যার দিকে যদি নজর দেই তা কিন্তু সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ওই যে “শিরে দিয়ে বাঁকা তাজ; ঢেকে রাখে টাক।” নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে তবুও মনে হচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে শিক্ষিত করছে ঠিকই কিন্তু নিয়ন্ত্রণ রাখছে নিজের হাতে। মানে সবকিছু বেঁধে দিচ্ছে এই পুরুষাধিপত্যবাদীরা। কতটুকু নারীর স্বাধীনতা,কতটুকু নারীবাদ, কতটুকু নারী জাগরণ, কতটুকু তার সহীহ সফলতা তাও ঠিক করে দিতে চায় তারা। মনে হচ্ছে নারীর স্বাধীনতা একটা বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। মানে যেখান থেকে শুরু হচ্ছে, ঘুরে ফিরে সেখানেই এসে শেষ হচ্ছে। দিনশেষে ফলাফল শূন্য। আর যারা নিজের মতো করে বাঁচতে চায়, তাদের প্রতিই বা এই সমাজ কতটা সহনশীল? ব্যক্তিস্বাধীনতা মতপ্রকাশের অধিকার এই বিষয়গুলোকে এক রকম তামাশা বানিয়ে রেখেছে।
নারীমুক্তি এবং নারীশিক্ষা দুটো ভিন্ন প্রসঙ্গ। নারী শিক্ষা নারীমুক্তির পথে একটা ধাপ মাত্র। কিন্তু কেবল নারীশিক্ষা মানেই নারীমুক্তি না। সমাজ দুটোকে মিলিয়ে এক করে ফেলে কোনোরকমে নারীকে বুঝ দিচ্ছে “অনেক অধিকার পাওয়া হয়েছে।”
তাইতো শিক্ষা থাকার পরও, উপার্জন করার পরও নারীর থাকে না অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, থাকে না চলাফেরার স্বাধীনতা। পোশাকের স্বাধীনতা চাওয়াটাকে নগ্নতা, অসভ্যতা নামে অপ্রচার করা নারীকে বন্দী করারই মধ্যযুগীয় কায়দা। হয়তো ঘরবন্দি, নয়তো বস্তাবন্দি; কিন্তু বন্দি নারীকে রাখতেই হবে। আর পোশাকের স্বাধীনতাকে নগ্নতার ট্যাগ লাগানোকে আমার কাছে বড়ই হাস্যকর মনে হয়। তাদের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে প্রশ্ন জাগে। তারা নিজেরা নিজেদের পছন্দমতো পোশাক পরবে আবার অন্যদের ওপরও নিজের পছন্দ চাপিয়ে দেবে এবং অন্যরা তা মেনেও নেবে নীরবে – এই ধারনা তাদের।
নিজের পছন্দের পোশাক পরা প্রতিটা মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। আর বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে এমনিতেই দু’একটা কাপড় বেশি পরা লাগে সেখানে স্বাধীন পোশাক পরার অধিকারকে নগ্নতার ট্যাগ দেওয়া সত্যি হাস্যকর।
এই ট্যাগ দিয়ে আর কদ্দিন দমিয়ে রাখা হবে? আপনার কারো পোশাক ভালো না-ই লাগতে পারে। আবার আপনার পোশাকও যেয়ে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হবে তেমনটিও না। কিন্তু তা-ই বলে তার ইচ্ছে অনুযায়ী পোশাক পরায় বাধা দেওয়ার বিন্দুমাত্র অধিকার আপনি রাখেন না। “আপনাদের মতে অশ্লীল পোশাক” এর উপরে এক টুকরো হিজাব পরে টিকটকে নাচাগানা করতে পারেন, আপনার অধিকার বলে, তেমনই আরেকজন তার ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরতে পারবে তার অধিকার বলে। হোক সেটা জিন্স, শার্ট, ফতুয়া, শাড়ী, কামিজ, বিকিনি কিংবা বোরকা। নারী কী পরবে এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয় ও স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার বিন্দুমাত্র অধিকার নাই আপনার। এটা আপনাকে মানতে হবে।
পোশাককে ধর্ষণের জন্য দায়ী করা পিতৃতান্ত্রিক অনেকগুলো অপপ্রচারের মধ্যে একটি। সেই শুরু থেকে পুরুষতন্ত্রের বড় হাতিয়ার পোশাক। পোশাক একটি নারীকে নিষিদ্ধ করতে পারে এই শক্তি পুরুষতন্ত্র পোশাককে দিয়ে আসছে। পোশাককে ধর্ষণের জন্য দায়ী করা মানে আলতো করে পুরুষকে ধর্ষণের লাইসেন্স দিয়ে দেয়া। পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী না, তা সে নারী যেই পোশাকেই হোক। যারা ধর্ষক তারা তো বোরকার ওপর দিয়েও চোখ বুলিয়েই নারীর শরীর স্ক্যান করে ফেলে। তাদের চোখ বোরকা পরা নারীকেও নগ্ন দেখে।
সুতরাং সমস্যাটা আসলে কাপড়ের টুকরোতে না, সমস্যাটা হচ্ছে মস্তিষ্কের গঠনে। এটা মানতে হবে এই সমাজকে এবং পোশাকের জন্য নারীকে বারবার হেনস্থা বন্ধ করতে হবে। ওষুধ যখন দিতেই হবে, তবে যেখানে দরকার সেখানে দিন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]