পুরুষের একদম না পারা আর নারীর সব পারার মধ্যে মাহাত্ম্য নেই
জবা ইয়াসমিন ।। সম্প্রতি নারীর ছবি দিয়ে “ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই” নামক শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন খুব প্রচার হচ্ছে। কিচ্ছুনা, প্লিজ শুধু একবার সব ঠিক রেখে এখানে নারীর বদলে একজন পুরুষের ছবি কল্পনা করুন। যদি স্বাভাবিক না লাগে, যদি একই রকম অনুভূতি না হয় তবেই লেখাটি পড়ুন।
আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও মূল্যবোধ অধ্যয়নের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে “ঘর সামলাই এবং ব্যবসাও সামলাই” এটা কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে হলে সমাজে গুজবাম্পস শুরু হয়ে যাবে। একটু ভাবুন, একজন নারী ঘর এবং ব্যবসা সামলানো যদি এত কৃতিত্বের বিষয় হয় তাহলে আমাদের পুরুষ সঙ্গীরা কেন পিছিয়ে থাকবে? সমাজের উচিত এগিয়ে এসে তাদেরকে সামনে নিয়ে যাওয়া যেন তারাও ঘর এবং ব্যবসা/চাকরি একসাথে সামলাতে পারে। তবেই তো বোঝা যাবে মানসিকতার উন্নয়ন হয়েছে!
আমি একইসাথে প্রগতিশীলতা এবং ইসলামী ফেমিনিজম দুটোকেই সাপোর্ট করি। দুটোই গ্রহণের মানসিকতা রাখি। তবে অনুশীলনের জন্য এই দুটোই বাদ দিয়ে আমি ভালবাসার পরাজয় মেনে নিতে আরো বেশি ভালবাসি। তবুও সমাজের বানানো পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম কখনোই স্বীকার করিনা।
ইসলামে বাইরে অর্থ-উপার্জন করা স্বামীর জন্য ফরয বা বাধ্যতামূলক। একইসাথে স্ত্রীর জন্য যাবতীয় সুবিধাদি ব্যবস্থা করাও তার জন্য বাধ্যতামূলক। ব্যপারটা এমন না যে স্বামী স্ত্রীকে বাজার করে এনে দিলে তার খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন হবে, বরং স্ত্রীকে প্রস্তুতকৃত রান্না খাবার দেওয়া স্বামীর দায়িত্ব। এমনকি স্ত্রীর কাপড় ধুয়ে দেওয়াও স্বামীরই কাজ। সোজা কথায় সব রকম সার্ভিস দিতে হবে। বিনিময়ে স্ত্রী স্বামীকে দিবে শারীরিক ও মানসিক সুখ। অবশ্যই স্বামীর এই প্রতিটি দায়িত্ব পালন খুবই কষ্টের, তবে অন্যদিকে স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক সুখ দিয়ে স্বামীর মনোরঞ্জনের বিষয়টাকেও এত হালকা কাজ ভাবার দরকার নেই। এর প্রকৃত উদাহরণ পাবেন একজন পাখিকে সব রকম সার্ভিস দিয়ে খাঁচায় আটকে রেখে তারপর একবার ছেড়ে দিয়েই দেখুন যে যাবতীয় সার্ভিসের বিনিময়েও সে তার স্বাধীনতাকে বিলিয়ে দিতে পারে কিনা। ঠিক তেমনই সব সার্ভিস নিয়ে বিনিময়ে কাউকে একনিষ্ঠভাবে মনোরঞ্জনের দায়িত্ব একজন স্বাধীন মানুষ নিতে পারেনা, স্বাধীনতা মানুষের সহজাত। এজন্যই মানুষকে বাঁধতে ভালবাসা লাগে। কিন্তু ভালবাসার কথা এখানে আমি বলব না, মার মার কাট কাট নিয়মের কথাই বলব শুধু। একজন যেকোনো মানুষকেও সব সার্ভিস দিয়ে তার ওপর শুধু মনোরঞ্জনের দায়িত্ব দিলে সেও স্বাধীন বোধ করবে না। যাহোক, অন্যদিকে ইসলামে ঘরের কাজ একজন নারীর জন্য বাধ্যতামূলক না। এটা স্বেচ্ছায় করলে তার জন্য নফল ইবাদতের সমান। কিন্তু ধর্মের এই সত্য আপনি কোথাও প্রচার হতে দেখবেন না, কোথাও না। কোনো ধার্মিকও এসব প্রচার করে ধর্মের মাহাত্ম্য দেখাতে যাবেনা,পাছে তার ঘাড়ে দায়িত্বের বোঝা আসে সেই ভয়ে। বরং কথিত ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজের তৈরি নিয়ম এটাই যে পুরুষ উপার্জন করে এনে দেবে, বউ রানবে, ঘরের সব কাজ করবে, বাচ্চা সামলাবে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করবে।
এখন যে সব ধার্মিক একটু কোণঠাসা হয়ে ধর্মের এই সত্য স্বীকার করে তারাও দেখবেন মা ফাতিমার যাতা পেষার উদাহরণ দেবে, তারা স্বামীর সীমাবদ্ধতার গল্প শুনিয়ে বউকে বাধ্যতামূলক ধৈর্য্য ধরে মহান হওয়ার উপদেশ দেবে। কিন্তু কেউই কখনো স্বামী বেটাকে বলবেনা “পুরুষ তোমার উপার্জন লিমিটেড হলে হবেনা, তোমাকে বেশি উপার্জন করে বউর জন্য দাসী রাখতে হবে, তার সকল প্রয়োজন পূরণের জন্য তোমার উপার্জন আরো বাড়াতে তোমাকে যেভাবে হোক বীরপুরুষ হতেই হবে,হবেই হবে।”
উহু, কেউ জামাই বেটাকে এই উপদেশ দেবেনা। কারণ সমাজ দুর্বল নারীর ধৈর্য্য ধরার ক্ষমতা দেখে ফেলেছে, ধৈর্য্য ধরা সহজ কিন্তু বীরপুরুষ হওয়া সহজ না। কেউ যদি বীরপুরুষ হয়ে কামাই করে সকল চাহিদা পুরণের সামর্থ্য নাও রাখে তবে তারা মাল্টিটাস্কিং শিখে একসাথে নিজের ঘরের দায়িত্ব ও বাইরের দায়িত্ব দুটোই সামলাক। নারীর তো এই দুটোর কোনোটাই পালন বাধ্যতামূলক না, পুরুষ তার জন্য বাধ্যতামূলক এই কাজগুলো পালন করলে এমন বিজ্ঞাপনে শহর ছেয়ে যাক৷ তার ঘরে-বাইরে দায়িত্ব পালনের জন্যই তাকে বাহবা দেওয়া হোক।
আর খুব প্রগতিশীল হলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ঘর ও বাহিরের সব কাজ ভাগ করে নিক সমান সমান অথবা সুবিধা-সমঝোতার ভিত্তিতে। এরপর ঘর ও বাহির সামলে বাহবা নিক, যে কাজ দুজনেরই সে কাজ নারী একা করে বাহবা নেবে আর আমাদের পুরুষ সমাজ কেন পিছিয়ে থাকবে?
এবার কঠিন হিসেব ও নিয়ম রেখে আসি ভালবাসার কথায়। দুজন সঙ্গীর মধ্যে ভালবাসা, বোঝাপড়ায় তারা ঘর ও বাইরের সব কিছুই তাদের মত করে ভাগ করে বা ঠিক করে নিক। কেউ সবটা করবে নাকি কেউ কিছুই করবেনা সে হিসেব একান্তই তাদের থাক। শুধু তারা ভাল থাকুক তাদের হিসেব নিয়ে। কিন্তু এমন ভালবাসা সহজে মেলেনা, তাই এমন ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসার চর্চাটাও হয়ে ওঠেনা।
শুদ্ধভাবে উপরের কোনোটাই কেউ চর্চা করে জীবনযাপন করেনা। করলেও সে সংখ্যাটা নিতান্ত হাতে গোনা। কিন্তু সমাজের সাধারণ চিত্র দিনশেষে এটাই যে কেবল বাইরের কাজ পুরুষের আর ঘরের সব কাজ নারীর এমনকি অভাবী স্বামীর সংসারে আর্থিক সাহায্য বা ধৈর্য্য ধরার কাজটাও নারীর। এবং নির্যাতন করে হলেও নারীকে দিয়ে তা করাতে হবে। খুব সূক্ষ্ণভাবে সেখানে এখন যেটা ঢুকেছে তা হল কিছুটা নির্যাতনের বদলে বাহবা দেওয়ার ভঙ্গিমায় নারীকে দিয়ে আরো কিছু কাজ করিয়ে ফায়দা নেওয়া। খুব গোপনে পুরুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ঢেকে দিতেই কি এই নোংরা খেলা?
যদি তাই হয়, তবে নারী উন্নয়নের নামে এই খেলা বন্ধ হোক। একটা পুরুষের জীবনের গল্প হল পরিবারের জন্য খেটে খেটে উপার্জন করে আর নারীর প্রতি আধিপত্য বিস্তার করেই জীবন পার করা। অন্যদিকে নারীর জীবন হল ঘরে পারিশ্রমিকবিহীন খেটে খেটে এবং নির্যাতিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে জীবন পার করা। সেই গল্পে সব ঠিক রেখে নতুন এক অধ্যায় যুক্ত হয়েছে যে, নারী এখনো ঘরে বিনা পয়সায় খাটে এরপর এখন কেউ কেউ বাড়ির পরিশ্রমের পর বাইরে শ্রম দিয়ে উপার্জন করে এবং এরপরেও নির্যাতিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এই গল্পে আমি কোথাও মানসিক উন্নয়ন বা মুক্তি দেখতে পাচ্ছিনা। বরং আধমরা অবস্থায় ভঙ্গুর দেয়ালে নিজের রক্তাক্ত পিঠ রেখে কী করে দেয়ালটাকেই সোজা রাখতে হয় সেই প্রচেষ্টাই দেখছি, যেন দেয়াল ভেঙে সংসারে প্রিয় স্বজনদের ওপরে না পড়ে।
জীবন এমন হওয়ার নয়। ঘরের কাজ বলতে রান্না, কাপড় ধোয়া, সব পরিস্কার পরিছন্ন রাখা সবই প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস। এজন্য এগুলো সবারই শেখা জরুরি। লাইফের বেসিক স্কিল এটি। কোনো পুরুষের এটা একদম না পারা আর নারীরই সব পারার মধ্যে মাহাত্ম্য নেই। তেমন খাবারের যোগান দেওয়ার জন্য অর্থ-উপার্জন এটাও টিকে থাকার জন্য বেসিক স্কিল হিসেবে সবার শেখা জরুরি। কে কোন পেশাকে বেছে নেবে বা কোনটা শিখবে সেটা ঐচ্ছিক ব্যপার তবে জানা থাকা আবশ্যক। শুধু পুরুষ একা করে বলে বা তার উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে বসে খাওয়ার মধ্যেও মাহাত্ম্য নেই। এই সকল স্কিল নিয়েই দুজন মানুষ সমঝোতার ভিত্তিতে সুন্দর জীবন-যাপন করতে পারে। কারো কোনো ব্যপারে অদক্ষতা থাকলে সেটাও ভালবাসা ও অন্য দক্ষতার ভিত্তিতে ভারসাম্য করে নিতে পারে। কিন্তু এসব কিছুই না করে একপেশে ভাবে যেকোনো এক গোষ্ঠীর ওপর এককভাবে কিছু চাপিয়ে দিয়ে সেটার চর্চা আর তার বিপরীতে বাহবা দেওয়াটা স্রেফ ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়।
নারী-পুরুষের যৌথ জীবন এমন একপেশে ভাবে অন্যায্যতা চর্চার, নির্যাতনের, নিপীড়নের বা ফেইক হাততালির না হোক। তাদের জীবন হোক বোঝাপড়া ও ভালবাসার যে জীবনের অর্জনে একজনের প্রতি বাহবা তার সাথে হওয়া অন্যায়/বৈষম্য আর তার পাশের মানুষটার দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে আঙ্গুল দিয়ে না দেখায়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]