November 1, 2024
কলামফিচার ২

হিন্দু আইনে নারীর উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আমাদের দেশে একজন মানুষের মৃত্যুতে তার সম্পত্তি অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য বিত্ত কার অধিকারে যাবে বা কার কার মধ্যে বিভক্ত হবে সেটা নির্ভর করে মৃত ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর। মনে করেন, আমার যদি আগামীকাল মৃত্যু হয়, তাইলে সরকারের রেকর্ডে আমার যে ধর্মীয় বিশ্বাস লিপিবদ্ধ আছে, অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম, সেই ধর্মের যেসব উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন আছে সেই অনুযায়ী আমার সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করা হবে। আবার আমার ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে আমি যদি হিন্দু হতাম তাইলে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী ভাগ বাটোয়ারা হতো। ইসলাম ধর্ম এবং হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানের দিক দিয়ে যতই ভিন্ন হোক না কেন, একটা বিষয়ে ওদের মধ্যে অনেক মিল – সেটা হচ্ছে নারীকে উত্তরাধিকার থেকে যতটুকু সম্ভব বঞ্চিত রাখার চেষ্টা। অন্যভাবে বললে দুই ধর্মেই নারীকে বিবেচনা করা হয় মানুষ হিসাবে পুরুষের তুলনায় অধম এবং পুরুষের অধিনস্ত হিসাবে। ফলে দুই ধর্মেই কম বেশি নারীকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন যেহেতু হিন্দু আইন সংস্কার নিয়ে আলোচনাটা চলছে, এখনকার আলোচনাটা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি।

হিন্দু আইনের কয়েকটা আলাদা মতবাদ বা ভাগ রয়েছে এর মধ্যে মুখ্য দুইটা ভাগ হচ্ছে মিতাক্ষরা আর দায়ভাগ। এছাড়াও আরও দুই তিনটা ভাগ রয়েছে। বাংলায় দায়ভাগ মতবাদের হিন্দু আইন প্রচলিত আর ভারতবর্ষের বেশিরভাগ জায়গায় মিতাক্ষরা বিধান প্রচলিত। মিতাক্ষরা বলেন বা দায়ভাগ বলেন, আইনের এইসব বিধানের উৎস হচ্ছে ধর্মগ্রন্থসমূহ – বেদ শ্রুতি স্মৃতি ইত্যাদি। পারিবারিক আইনের কিছু কিছু বিধান আবার রাষ্ট্রের আইন প্রণেতারা প্রচলিত আইন আকারে তৈরি করেছেন, যেমন ধরেন ১৮৫৬ সনের বিধবা বিবাহ আইন বা ১৯৩৭ সনের হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার আইন ইত্যাদি। যেসব বিষয়ে এইভাবে আনুষ্ঠানিক আইন করা হয়েছে সেইসব বিষয়ে শাস্ত্র স্মৃতি শ্রুতি এইসবের আর কোন প্রয়োগ নাই। হিন্দু আইনের দায়ভাগ বিধানাবলি দিয়ে আমাদের দেশের হিন্দুদের বিবাহ, উত্তরাধিকার, উইল, দান, দত্তক এইসব নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়।

আমাদের দেশে হিন্দু আইন অনুযায়ী পিতা বা স্বামীর মৃত্যুর পর নারী উত্তরাধিকারীদের অর্থাৎ কন্যা বা বিধবা স্ত্রী বা মা – ওরা সাধারণত মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে কোনো ভাগ পায় না। আইনে উত্তরাধিকারীদের তালিকা আছে যাদের উপরের দিকে আছে পুত্র, পুত্রের ঘরের পুত্র বা তার ঘরের পুত্র এরা। এদের কেউ থাকলে কন্যা বা বিধবা সম্পত্তিতে কোনো অংশ পাবে না – অর্থাৎ সাধারণ পরিস্থিতিতে কন্যা বা স্ত্রীর উত্তরাধিকার একদম শূন্য। ব্যতিক্রমী কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে, যেমন যদি কোনো পুত্র বা তার পুত্র বা তার পুত্র এইভাবে যদি কেউ না থাকে তবে বিধবা সম্পত্তি পাবে। তবে নারী যখন এইভাবে সম্পত্তি পায় সেটা আবার ঠিক পুরোপুরি পাওয়া হয় না। এই ক্ষেত্রে নারীর অধিকার থাকে কেবল সম্পত্তি দেখাশুনা করা এবং নিজের জীবদ্দশায় সেটা ভোগ করা। খুবই সীমিত ব্যতিক্রমী কোন পরিস্থিতি না হলে নারীটি এই সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে না। যেমন মনে করেন সরকারি রাজস্ব বাকি পড়েছে, সেটা পরিশোধ না করলে জমি নিলাম হয়ে যাবে, সেই ক্ষেত্রে নারীটি জমির একটা অংশ বিক্রি করতে পারবে। এছাড়া সেই সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার থাকে না এবং নারীটির মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি তার নিজের উত্তরাধিকারীদের কাছে যাবে না, যাবে মৃত ব্যক্তির অন্য পুরুষ উত্তরাধিকারীর কাছে। অর্থাৎ সাধারণভাবে বললে, নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো সম্পত্তি পায় না।

নারীদের সম্পত্তি হতে পারে কেবল স্ত্রীধন। স্ত্রীধন কী? একটি মেয়েকে তার পিতা বা ভাই বিবাহের সময় বা পরবর্তীতে যদি কোনো উপহার দিয়ে থাকে, সেটা হতে পারে জামা কাপড়, তৈজসপত্র, অন্য কোনো মূল্যবান বস্তু বা জমি বা নগদ অর্থ এইসব। অর্থাৎ নিতান্ত দান বা উপহার হিসাবে যে যা দেয় মেয়েক সেটাই স্ত্রীধন, অধিকার সূত্রে পাওয়া কোনো সম্পদ বা অর্থ নয়। পিতা বা ভাইয়ের কোনো দায় নাই কন্যাকে বিবাহের সময় বা এমনিতে উপহার দেওয়ার। সুতরাং স্ত্রীধন জিনিসটা মোটেই উত্তরাধিকারের বিকল্প নয়। তবে স্ত্রীধন নারীর নিজের সম্পত্তি। তবে নারীটির মৃত্যু হলে স্ত্রীধন যাবে তার পুত্রদের কাছে, কন্যারা সেখানে কিছু পাবে না।

পিতার মৃত্যুতে তার কন্যা পিতার অর্থবিত্তে কোনো ভাগ পাবে না, উত্তরাধিকারের খাতায় কন্যার ভাগ শূন্য, এটা তো ন্যায় নয়। একই পিতার ঔরসে একই মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছে ধরেন একটি পুত্র ও একটি কন্যা, পিতার মৃত্যুতে কন্যাটি পাবে গোল্লা আর পুত্র পাবে পিতার সকল সম্পত্তি এটা যে অন্যায় সেকথা তো তর্ক করে বুঝানোর দরকার নাই। ভারতে ওরা এই বিধানটি পরিবর্তন করেছে এবং ১৯৫৬ সনে মোটামুটি বিস্তারিত একটা আইন করে নিশ্চিত করেছে যাতে করে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণে নারী পুরুষ সমান গুরুত্ব পায়। ১৯৫৬ সনের এই আইনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি পুরুষের চেয়ে নারীকে একটু অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর যদি স্ত্রী, পুত্র বা কন্যা কেউই না থাকে তাইলে তার সম্পত্তি পাবে পিতা বা মাতা। পিতামাতার মধ্যে আবার মা অগ্রাধিকার পাবে, অর্থাৎ মা যদি জীবিত থাকে তাইলে পিতা আর কোনো ভাগ পাবে না। এখানে মৃত ব্যক্তির মাকে পিতার তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আইনের ভাষ্যকারদের কেউ কেউ বলেছেন যে হাজার বছর ধরে নারীর প্রতি যে অন্যায় চলে আসছে সেটার তুলনায় এই অগ্রাধিকার উল্লেখযোগ্য কিছু না।

ভারতে সংশোধন হলেও হিন্দু উত্তরাধিকার আইন আমাদের দেশে সেই পুরনোটাই রয়ে গেছে – কন্যারা এখনও এখানে বঞ্চিতই থেকে যায়। ২০১০-১১ সনে আমাদের দেশের আইন কমিশন এটা নিয়ে কাজ শুরু করে এবং ২০১২ সনের আগস্ট মাসে আইন কমিশন হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের সুপারিশ করে একটা রিপোর্ট দাখিল করে। সেই রিপোর্টের সপ্তম অংশে কমিশন স্পষ্ট করে মতামত দেয় যে, উত্তরাধিকার সূত্রে নারী সম্পত্তির অধিকারী হবে এবং জীবনসত্ত্বের পরিবর্তে নারীর পূর্ণ অধিকার দিয়ে আইন পাশ করতে হবে। জীবনস্বত্ব হচ্ছে ঐ যে পূর্বের উদাহরণটাতে বলেছি, নারীটি কেবলমাত্র তার জীবদ্দশায় সম্পত্তির অধিকার পাবে, সেটা। আইন কমিশন এই রিপোর্ট তৈরির সময় বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে একটা বিস্তারিত জরিপও করেছিল, সেই জরিপে দেখা গেছে যে ৮৬% মানুষ নারীর উত্তরাধিকারের পক্ষে মতামত দিয়েছে আর মাত্র ১০% মানুষ এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, ৪% মানুষ কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে।

সরকারের কাছে এই রিপোর্ট দাখিল করার পর সরকার আবার এটা হিন্দু সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে দিয়েছে ওদের মতামতের জন্যে। এই পর্যায়ে এসে দেখা গেল যে বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের পেট্রিয়ার্ক ধরণের কিছু ব্যক্তি এই আইন সংশোধনী প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছে। এটা বিস্ময়ের কথা, নারীকে উত্তরাধিকার দেওয়ার জন্যে আইন সংশোধনের বিরোধিতা মানুষ কেন করবে? এটা তো ন্যায় প্রস্তাব! কেন ওরা বিরোধিতা করছেন? ওদের মূল যুক্তি দুইটা। প্রথমটা হচ্ছে যে, নারীরা সম্পত্তি রক্ষার লায়েক না, সমাজে প্রভাবশালী লোকজন ওদেরকে ভুলভাল বুঝিয়ে সামান্য মূল্যে সম্পত্তি হাতিয়ে নিবে। দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে যে, সম্পত্তির লোভে অন্য ধর্মের লোকেরা হিন্দু কন্যাদেরকে ভুল্কি ভাল্কি দিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করবে আর ধর্মান্তরিত করে ফেলবে, ফলে হিন্দু সমাজ ও হিন্দুদের সম্পত্তি হুমকির মুখে পড়বে।

আইন কমিশন কিন্তু এইসব যুক্তিও বিবেচনা করেছে। বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য এইসব যুক্তির বিপরীতে বলেছেন যে, এইরকম ঘটনা তো খুবই ব্যতিক্রমী এবং সংখ্যায় নগণ্য। তাছাড়া একইরকম ঘটনা পুত্রদের ক্ষেত্রেও ঘটে। জাস্টিস ভট্টাচার্যের মতে, এইসব ভঙ্গুর যুক্তির সাহায্যে কন্যাদের স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অমানবিক।

লক্ষ্য করবেন, যে যুক্তিগুলি সংস্কারের বিরোধীরা দিচ্ছে সেগুলির মূল ভিত্তিটা কি? ওদের সকল তর্কের মূল ভিত্তি একটা প্রত্যয় যে, নারীরা হচ্ছে বেওকুফ, ওদের বিষয়বুদ্ধি নাই, ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না  অর্থাৎ নারীরা হচ্ছে পুরুষের তুলনায় অধম সুতরাং ওদেরকে সম্পদে উত্তরাধিকার দেওয়া যাবে না। নাইলে নারীদেরকে বোকা বানিয়ে প্রভাবশালীরা সম্পদ নিয়ে নেবে কম দামে, পুরুষদেরকে বোকা বানাতে পারবে না! নারীরা ভিন্নধর্মের ছেলেদের বিয়ে করতে পারে, পুরুষরা ভিন্ন ধর্মের নারীদের বিয়ে করতে পারে না?

এইটাই হচ্ছে মূল লড়াইটা আর এইখানেই হিন্দু নারীর উত্তরাধিকারের সংগ্রাম সকল নারীর জন্যে অধিকারের সংগ্রামেরই একটা অংশ মাত্র। নারী ও পুরুষ সমান এবং নারী কোনো ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় অধম নয় বা ঊন নয়। হিন্দু নারীর এই সংগ্রাম পৃথিবীর সকল নারীর অধিকারের সংগ্রামের অংশ এবং বিশ্বব্যাপী নারীঅধিকার সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *