প্রিয়ভাষিণী ও ভালুক : শর্তহীন প্রিয়তম বন্ধুতার গল্প
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।। “বন্ধুত্ব” একটি আপন, সুন্দর শব্দ। নারী-পুরুষের মাঝে কি বন্ধুত্ব হয়? – জবাবে বলবো, নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ভাবনা ইতিবাচক। বরাবরই আমার মনে হয়েছে, প্রেমিক বা জীবনসঙ্গী হিসেবে পুরুষের ভূমিকা ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বন্ধু হিসেবে পুরুষের গ্রহণযোগ্যতা খানিকটা হলেও বেশি। আসলে বন্ধুত্বের বেলায় নারী-পুরুষ বা বয়সের সীমারেখা বিচার হয় না। সম্পর্কটা খাঁটি কিনা সেটাই মূল কথা। আর যে কোনো সম্পর্ক তখনই ভিন্ন মাত্রা পায় যখন একজন অপরজনকে একজন মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শেখেন। মোদ্দা কথা, এখানেও ঘুরে ফিরে সেই সমতার কথাই চলে আসে।
আমার দেখা আজন্ম এক বন্ধুত্বের গল্প বলি। জাগতিক জীবনের দুর্গম অধ্যায় এবং নারী-পুরুষের সম্পর্কের দুর্বোধ্য সমীকরণ ছাপিয়ে দুইজন মানুষের চিরবন্ধুতার গল্প। গল্পের মূল চরিত্র আমার মা এবং বাবা। দুজনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তবু তাঁদের সম্পর্কের বিষয়ে এখনও অনেকে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁরা নিশ্চয়ই ত্রুটিহীন কোনো মহামানব ছিলেন না। নির্ভুল, নিষ্কন্টক জীবনও তাঁরা যাপন করে যাননি। ৪৭ বছরের সংসার জীবনের আগে প্রায় অর্ধযুগের পরিচয় পর্ব ছিল এই সম্পর্কে। এই দীর্ঘ সময়কাল জীবন সংগ্রামের সাতসমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে একে অন্যের পরম বন্ধু হয়ে ওঠা আমার কাছে অন্তত বিস্ময়কর হয়ে ধরা দেয়।
একদিন পুরনো চিঠিপত্রের বাক্সে দুটো চিঠি খুঁজে পাই। একটি প্রিয়ভাষিণী লিখেছে ভালুককে ১৯৮৮ সালে। অন্যটি ভালুক লিখেছে প্রিয়ভাষিণীকে। এই চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৯৯৪ সালের জুলাইয়ের ৮ তারিখে। ততদিনে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের তেল-নুন-কড়াইয়ের বয়স যুগ পেরিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। এমন পরিণত বয়সে চিঠি এবং চিঠির ভাষায় যে স্বর্গীয় অনুভব তা কি কোনো সাধারণ দম্পতির বেলায় সম্ভব? হয়তো সন্তান হিসেবে তাঁদেরকে কাছ থেকে দেখেছি বলে, আমার কাছে তা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি অন্য চোখে দেখি, তবে তা সত্যিই অসাধারণ!
“তোমাকে নিয়ে জাগতিক যে বিড়ম্বনা তা হলো – তুমি নন্দনের মানসপ্রতিম, এখানে কেন?”
কথাগুলো আমার মা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর লেখা, আমার বাবা আহসানউল্লাহ আহমেদকে যাঁর ডাক নাম ভালুক বা বীয়ার। তারিখ নভেম্বর ৩, ১৯৮৮। সেদিন ছিল ভালুকের জন্মদিন।
ভালুকের লেখা কয়েকটি লাইন ছিল এরকম– “তুমি এখন আর শুধু আমাদের নও, সারা জগৎ পরিমণ্ডলের হয়ে গেছ। তোমার পরিচয়ে, তোমার ছায়ায় আমরা পরিচিত হচ্ছি – এটা যে কত বড় গর্বের তা তুমি বুঝতেও পারবে না।”
চিঠি দুটো আমাকে জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শেখায়। বিশেষত এই লাইন কয়টি। কতটা ঐশ্বরিক অনুভবে এভাবে লেখা যায়? ছকে বাঁধা সমাজ-সন্তান-বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে একপাশে রেখে যাঁরা সম্পর্কে এমন মধুরতার বোধ সৃষ্টি করতে পারেন, তাঁদের আর যাই হোক নিছক দম্পতি বলা চলে না। কেবল ভালোবাসাতেও এমন বন্ধুতা স্থাপন সম্ভব নয়। এমন বন্ধুতার জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ক্ষমাশীলতা আর স্বাধীন-উদার হৃদয়ের প্রয়োজন। সে হৃদয়ে থাকে “অকাতরে বিষয়বাসনা বিসর্জন” দেবার মতো সাহস ও উদ্যম। যেকোনো সম্পর্কে জটিলতা আর টানাপোড়েন যে অনিবার্য, অনস্বীকার্য! তাহলে কীভাবে সম্ভব তা অতিক্রম করে বন্ধুত্বের মতো ঐশ্বরিক অনুভবের উচ্চতা স্পর্শ করা? সে প্রশ্নের উত্তরের সামান্য আভাস পাওয়া যায় প্রিয়ভাষিণীর চিঠিতে লেখা আরেকটি লাইনে – “আমাদের সম্পর্কে একটা শর্তহীনতা আছে, নিঃস্বার্থ নীলিমায় তা অন্তহীন আনন্দ, যা শুধুই অনুভূতিতে একাকার।” আহা! এমনি করে ভাবা যায় বলেই বুঝি সম্পর্কের বোঝা নয় বরং বন্ধুত্ব বয়ে চলে নিরবধি! ভালুক লিখে যায়, ‘‘তোমাকে অনুভব করি, প্রতিটি গল্পে কথায় চিত্রিত করি।”
কেউ ভাবতেই পারেন, প্রেম আর বন্ধুত্বকে মিলিয়ে গোলমেলে করে ফেলছি কিনা! এ যে প্রেমের পত্রলিপি বলা বাহুল্য। তবে পত্র লেখার সময়কাল, সম্পর্কের বয়স খেয়াল করলে প্রেমের অন্তরালে এ যেন প্রাণখোলা বন্ধুত্বের বারতা, যে বারতায় জীবন জুড়ে পরস্পরকে আশ্বস্ত করা যায় – “আমি আছি!”
বন্ধু তো সেই যার কাছে হওয়া যায় সহজ, অকপট! যার কাছে কোনো ভূমিকা বা ভণিতার প্রয়োজন পড়ে না! যার কাছে হৃদয়টা মেলে ধরা যায় দ্ব্যর্থহীন, ব্যাখাতীতভাবে! সেখানে নারী-পুরুষ কোনো অন্তরায় হতে পারে না। আবারো ফিরে আসি প্রিয়ভাষিণীর লেখায় যেখানে ভালুককে লেখা হয়েছে, “তুমি একখানি পূর্ণ গীতবিতান!”
প্রিয়ভাষিণী আর ভালুক সব সম্পর্কের লৌকিকতা ভেঙে জীবনকে ভালোবেসে গিয়েছেন একে অন্যের প্রিয়তম বন্ধু হয়ে। তাই সময় গড়িয়ে গেলেও, সে বন্ধুত্বের পলেস্তরা খসে পড়েনি। বরং নব নব রূপে ধরা দিয়েছে প্রতিদিন। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতানের মতো তাঁদের সম্পর্ক জুড়ে বিরাজ করেছে প্রেম, পূজা, প্রকৃতির বিচিত্রতা। সেখানে বন্ধুত্বের আবাহনে কেবল নারী-পুরুষ কেন, “সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব।”