উৎসবের এদেশ-ওদেশ একাল-সেকাল
অপর্ণা হাওলাদার ।। দেশের বাইরে আছি ১২ বছরের উপর হয়ে গেলো। দেশের ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো তাই পালন করা হয় না। আসলে ছুটিও থাকে না। অন্যদিকে এদেশের উৎসবগুলো দেখা হয় – কিছু পালনও করা হয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে সময়ের কারণেই এখন বেশিরভাগই অন্য দেশের মানুষ, মূলত কাজের সূত্রে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। তাদের আমন্ত্রণেই তাদের সাথে এদেশের উৎসবগুলো পালন করা হয় ইদানিং। দেশের এবং বাইরের সামাজিকতার উপর, উৎসব পালনের ধরনের উপর কিছু লিখতে চাই আজকে।
থ্যাংকসগিভিং, ক্রিসমাসে বন্ধুরা দাওয়াত দেয় এখানে। উৎসবের আমেজ তো প্রতি সমাজেই, প্রতি দেশেই একইরকম। তার মাঝেও চোখে পড়ে, পড়ে না বলে চোখে বেঁধে বলাই ভালো – একটা তুলনা। শুরুটা একালের অভিজ্ঞতা থেকেই করা যাক।
আমি এখন থাকি পীটসবার্গে, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। এই বছর উৎসবের দিনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েরই কলিগদের বাড়িতে কাটানো হয়। ওদের বাড়ির কিছু আচার খুব ইন্টারেস্টিং, আমার নিজের ক্ষমতা থাকলে আমিও এভাবে পালনের হয়তো চেষ্টা করতাম। প্রথমত, ওরা কোনো একজনের বাড়িতে সব উৎসবের চাপ দেয় না। কারো ওপর যেন আলাদা চাপ বারবার না পড়ে তাই একেকজনের বাসায় পালন করে একেকটা দিন। এর মধ্যেও কেউ কেউ নিজেও দুই একটা আইটেম রান্না করে নিয়ে আসে। ক্রিসমাসের উৎসবের একটা বড় অংশ উপহার সংক্রান্ত। তবে সেটাও মূলত ছোটদের জন্য। কিন্তু যে ব্যাপারটা ভালো লাগে – এতে দেখানেপনা প্রায় নেই। মূলত বই, কার্ড, ছোটোখাটো কোনো পড়াশোনা বা খেলা সংক্রান্ত কিছু গিফট। দামের দেখানেপনা নেই। ছোটরাও তাদের মতো করে বড়দের জন্য গিফট বানায় – ছবি, কার্ড।
এরপর খাওয়া – সবাই একত্রেই এক টেবিলে বসে। নিজেরটা নিজে নিয়ে খাওয়ার চল থাকায় কোনো এক নারীর উপর “আরেকটু নেন” সামাজিকতার বালাই নেই। যার যা পছন্দ, যতটুকু পছন্দ নিচ্ছে। খাবার আনা-নেওয়া নারী পুরুষ মিলেই করছে। রান্নাও ভাগ করে করা – নারী বলেই রান্নাঘরে দিন কাটাচ্ছে এটা চিন্তারও বাইরে, এখানে যে বাড়িগুলোতে আমি গিয়েছি। একটা মজার জেন্ডার পার্থক্য একটা জায়গায় আছে অবশ্য – বাইরে গ্রিল জ্বালিয়ে মাংস বার্বিকিউর লাইনে বেশিটাই ছেলে, কেক বেকিং – কেক সাজানো এর মধ্যে বেশিটাই মেয়ে।
নিজের খাবার প্লেট পরিষ্কার করে নিজেই ডিশ ওয়াসার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নিয়ম। আর নারী পুরুষ সবাই মিলেই আড্ডা। তাতে কাজ, অকাজ, মুভি, বই, পলিটিক্স সবই আছে। বয়সের মধ্যে পার্থক্য ধরে আড্ডা দেওয়া নেহায়েতই নেই। কেবল নারী বলে বা পুরুষ বলে, বয়সের খাতিরে কাউকে ছোটো বড় করে দেখার আচার নেই। “টিটকারি” বাদ দিয়ে যে কেবল আনন্দের জন্য মজা করা যায়, সেটা আমি এদের বাড়িগুলোর আগে প্রায় দেখিনি। তাই, আমার কাছে এর সবই অনেকটাই নতুন।
বিদেশের মাটিতে দেশের লোকজনের কথা বলি এবার। ছাত্র থাকাকালীন প্রথম দুই বছর বিদেশে দেশি পার্টি অ্যাটেন্ড করা হতো। সেগুলোর অবস্থা সত্য বলতে দেশের চেয়েও কাহিল। দুই – তিনজন নারী একা হাতে কোনো সাহায্য ছাড়া সব ব্যবস্থা করেন। পুরুষরা মূলত আসেন খেতে এবং অন্যদের ছোট করে কথা বলতে। কত বেতন তোমার? বুয়েটে না পড়ে কেমনে দেশের বাইরে আসছো? আচ্ছা, তোমাদের তো ল্যাব নাই – তাইলে আবার রিসার্চ কীভাবে করো?
পারসোনাল প্রশ্নে কিন্তু নারীরাও কম যান না। কিন্তু তাদের পারসোনাল প্রশ্ন মূলত বিবাহ কিংবা বাচ্চাকেন্দ্রিক। দেশি পার্টিতে আমি অন্যের কাজ নিয়ে আগ্রহ দেখিনি, আলোচনা দেখিনি – দেখেছি দেশ থেকে বয়ে নিয়ে আসা একটা নোংরা কম্পিটিশন। মজা করার নামে বুলিয়িং, অন্যকে নিচে নামিয়ে যতটা পারা যায় আনন্দ নেওয়া। আমি এতে আসলে দোষও দিতে পারিনা, ঢাকাতেই কাটিয়েছি জীবনের টানা ১৫ বছর। আমি জানি যে এই “আনলার্নিং” বেশিরভাগ মানুষের জন্যই চুড়ান্ত কঠিন।
শেষ করি আমার নিজের বেড়ে ওঠার দিনগুলো নিয়ে।
আমার দাদু-দিদিমা (নানা-নানী) মারা যান আমার ১২ বছর বয়সে। ওই পর্যন্ত পূজা-পার্বণ মানে ছিল তাদের কাছে বরিশালে ঘুরতে যাওয়া। বরিশাল ছটো শহর হওয়ার কারণে অন্তত নব্বই এর দশকে তুমুল কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। উৎসব মূলত নতুন জামা, খাওয়া, ঘোরা – এসবই ছিল। নারী-পুরুষ বিভেদ তো অবশ্যই ছিল – উৎসবের দিন মানে মা-মাসি-মামীরা সারাদিন রান্নাঘরে থাকবেন, এটা জেনেই বড় হয়েছি। বাড়ির পুরুষরা বাইরের ঘরে বসে আড্ডা দেবেন এবং “আরেক কাপ চা” হুকুম করবেন। এসব এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে প্রশ্নও মাথায় আসেনি।
এরপর ঢাকায় এসে শুরু হলো আমার উৎসবকেন্দ্রিক ট্রমা। দাদু-দিদিমা মারা যাওয়ার পর থেকে শুরু করে দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত উৎসব আসলে আমি ভয়ে লুকিয়ে থাকতাম। কারণ? এখন এই কয়দিন আমাদের আত্মীয়রা বা বাবা’র কলিগেরা বাসায় আসবেন। এসে মূলত এই চাচা/কাকা/আংকেল – তারা টিটকারি মারবেন। উৎসব আর টিটকারি – স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে আমার কাছে সমান ছিল। তারা প্রথম প্রশ্ন করবেন যে আমার রেজাল্ট কেমন। রেজাল্ট জেনে সেইমত টিটকারি শুরু করবেন। মেট্রিকের পর যেহেতু পত্রিকাতেই আমার নাম এসেছিল, তাই এর এক পরত উপরে উঠে হিংসাত্মক টিটকারি শুরু করবেন। একবার এমনই উৎসবের দিনে কলিং বেল শুনে আমি দরজা খুলে দিলাম। ভদ্রলোক আমার পরিচিত নন। উনি বাসায় ঢোকার আগেই “এইবারের রেজাল্টে কি পইড়া গেছ নাকি?” – এই প্রশ্ন করলেন। অর্থ হচ্ছে আগের বছরের চেয়ে রেজাল্ট খারাপ হয়েছে কিনা – এই প্রশ্নের কী উত্তর হয়, আমি আজও জানি না।
রেজাল্ট থেকে এই মন্তব্যবাণ বিয়েতে ঢোকার আগেই আমি বাক্স গুছিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলাম।
বাংলাদেশের মানুষ খুব তীব্র একটা ঘৃণা লালন করেন অন্যের ছেলেমেয়েদের রেজাল্ট নিয়ে। উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত মানুষের মধ্যে এই ঘৃণা অনেক বেশি। তাদের দৈনন্দিন বুলিয়িং, মিথ্যা নালিশ ইত্যাদি মধ্যবিত্ত পরিবারে উৎসবের অঙ্গ। আজকাল ভেবে দেখলে মনে হয় বাংলাদেশে মানুষ অন্যের ব্যর্থতাকে নিজের সফলতা মনে করে। তাদের নিজেদের নিরানন্দ জীবনের চাপ তারা অন্যের উপর চাপিয়ে দেন উৎসবকে কেন্দ্র করে।
“বউদি’র হাতের রান্না” – উৎসবে এরপর আসে রান্না থেকে শুরু করে আপ্যায়নের অন্য সব ব্যবস্থা। আমাদের বাড়িতে উৎসবের দিন পুরুষদের নিজের গ্লাসে নিজে জল নিয়ে খাওয়ার চল নেই তেমন। আমার বাবার তরফের এক আত্মীয় যাকে আমি কাকা ডাকতাম আমার মায়ের হাতের রান্না চেটেপুটে খেয়ে “ও আর কী পারে রান্না ছাড়া?” – এই কথা বলতেন আমার মা সম্বন্ধে। আমার মা এদের জন্য বছরের পর বছর রান্না করে যেতেন। আমি দেখতাম। আমি বড় হলে মা’র মতো বা আমার মাসির মত মোটা হবো – এটা আমার সামনে অন্য পুরুষদের সাথে উনি আলোচনা করতেন, আমার চেহারা খারাপ, আমার চেহারা নিয়ে উনি ওনাদের বাসায় আলোচনা করেন – এইগুলো বসে বসে বলতেন। আমি শুনতাম।
বয়সে ‘বড়’দের কথা প্রতিবাদ ছাড়া, বিনাবাক্যে চুপচাপ না শুনলে বাবামা’র মুখ উজ্জ্বল করা যেত না। এইসব কথার পরেও প্রতিবার ড্রয়িং রুমে গিয়ে ওনাদের পা ধরে প্রণাম না করলে বাবা-মা’র মুখ সমাজে দেখানোর উপায় থাকতো না। আমি “তথাকথিত” ভালো মেয়ে হওয়ার পরীক্ষায় পাশের জন্য তাই চুপ করে শুনে গেছি এসব বুলিয়িং। এরপর আরও ছিল উপহারের দেখানেপনা। কোনো উপহার কেনার পেছনে চিন্তাভাবনা নেই, কেবল কত টাকার উপহার – সেটাই ব্যাপার।
আজকে যখন আমার চেয়ে বিশ বছরের ছোটো স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের সাথে কথা হয়, আমি ভাবি কেন এমন ইচ্ছা হবে যে এদের আমি ছোট করে টিটকারি মেরে কথা বলবো? বরং কাল ওরা বড় হয়ে আমার সাথে কাটানো সময়টুকু মনে রাখুক, ওদের বেড়ে ওঠায় আমারও কিছু অবদান থাকুক – সেটাই তো আমার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। মাত্র এক দশকে বাচ্চারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট নারী-পুরুষে পরিণত হয়। সামাজিকতার খাতিরে, বাবা-মায়ের ভয়ে মুখ বুঁজে সয়ে যাওয়া কুৎসিত বুলিয়িং তারা ভোলে না, আমিও ভুলিনি। এই সারসত্যটুকু বুঝতে কয় প্রজন্ম লাগবে আমাদের, কে জানে!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]