December 23, 2024
কলামফিচার ২

পুরুষের দুনিয়ায় নারীর জন্য শহর

আফরোজা নওশীন সেঁজুতি ।। কিছুদিন আগে, আমার পাশে বসা পুরুষ সহকর্মীকে দেখলাম হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছেন। এই শীতে ঢাকার মানুষও কাবুপ্রায়, আড়মোড়া ভাঙা খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু সামান্য এই বিষয়টাই আমাকে নিয়ে গেলো পঁচিশ বছর আগের একটা দিনে।

বনানী বিদ্যানিকেতন নামের একটা স্কুলে কোএড ছিল, সেখানে আমি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলাম। তখন সবে মাত্র ক্লাস ফোর কি ফাইভে উঠেছি। আমার মা আমাকে স্কুলে যাওয়ার আগে প্রতিদিন কিছু উপদেশ দিতেন, কিন্তু এই লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক উপদেশটা নিয়ে আমি আজ লিখছি অফিসে বসে। উপদেশটা ছিল, কখনোই যাতে ক্লাসে সবার সামনে আড়মোড়া না ভাঙ্গি, কারণ আমার বুক তাতে উঁচু (!) হয়ে দেখা যাবে ছেলেদের সামনে। ততদিনে আমি স্কার্ফ পরি স্কুল ড্রেসের উপর। এরপরে অতি সাবধানী থাকার জন্য ঐ উপদেশ।

পঁচিশ বছর পরেও, অবচেতনভাবেই আমি এই উপদেশ মাথা থেকে সরাতে পারিনি। আমি অবশ্য হাই তোলা, আড়মোড়া ভাঙা নিয়ে অতি সচেতন থাকি, কারণ আমি কাজের জন্য সজাগ থাকতে চেষ্টা করি। কিন্তু আজ আমার সেই পুরুষ সহকর্মীকে দেখে ভাবছি- “কোনো কিছুই না চিন্তা করে একজন পুরুষ হাত ছড়িয়ে হাঁটেন, বসেন, ফুটপাতে কোমরে হাত দিয়ে জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমার তাকে বলতে হয় সাইড দিন, সরুন। কিন্তু শহরটা তো আমারো।”

তাই কি?

মেট্রো রেলের নারী কম্পার্টমেন্টে জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও অসুবিধা লাগেনি কখনও, কারণ বাসের মত আমার গায়ে কেউ হাত দেবে সেই ভয় আমাদের মাথায় তখন আসে না। কিন্তু শহরের মধ্যে, মেয়েরা বা নারীরা ঠিক কতটা আপন বোধ করতে পারেন? এই যে এত বড় একটা ঢাকা শহর, এটা কি নারীদের?

নারীবাদ নিয়ে পড়ার জন্য আমি প্রায়শই বিদেশি নারীবাদী লেখকদের লেখা পড়ার চেষ্টা করি। এভাবে খুঁজে পাই লেসলি কার্নকে। তিনি একজন কানাডিয়ান নারীবাদী আরবানিস্ট বা নগরবাদী, বর্তমানে টরেন্টোর মাউন্ট আলিসন ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি তিনি নগর পরিকল্পনায় নারী ও নারীবাদের গুরুত্ব নিয়ে লেখালেখি করছেন। আমি একটু পরেই তাঁর কানাডা ও লন্ডন শহরের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা নারীর চোখে শহরের যে রূপ, সেটার সাথে আমার ঢাকা শহরের অভিজ্ঞতার সন্নিবেশ দেখাবো। শহর নিয়ে লেখা তাঁর বইগুলোর মধ্যে বহুল আলোচিত হল – “Feminist City: Claiming Space in the Man-Made World” যা বাংলা করলে এমন হতে পারে – “নারীবাদী শহর: পুরুষের বানানো পৃথিবীতে জায়গা দাবি করা”। নামের মধ্যেই আছে ভাবনার খোরাক। আমাদের চারপাশ বানানো হয়েছে পুরুষদের সুবিধার্থে, পিতৃতান্ত্রিকতার প্রসারে। সেখানে জন্মের পর থেকে মেয়েরা কেবল মানিয়েই চলছে। আমার আগে থেকে মানিয়ে যাচ্ছে আমার মা চাচী, তাদেরও আগে থেকে মানিয়ে চলতেন তাদের মায়েরা।

কিন্তু এই মানিয়ে চলার দায়ভার কেবল নারীদের উপর কেন?

বহু যুগের পুরনো এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে আমি এই বইয়ের পাঁচটা অধ্যায়কেই কাঁটাছেড়া করেছি। তথাকথিত উন্নত বিশ্বের দুইটি শহরে বাস করে লেখক দেখেছেন কীভাবে গর্ভধারনের সময়গুলোতে তাঁর নিজস্বতা বলে কিছু নেই। কৌতূহলী লোকজন তাঁকে না জিজ্ঞেস করেই তাঁর পেটে হাত রাখছে। সন্তান জন্মের পরে তার স্ট্রলার ঠেলে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার মত উপযুক্ত ডিজাইন নেই রাস্তার। প্রেগ্নেন্সি পরবর্তী সময়ে জরুরি মুহূর্তে শিশুর ডায়পার চেঞ্জ করার মত জায়গা খুঁজতে খুঁজতে শহর চষে বেড়িয়েছেন।

লেসলি কার্নের ভাষায়, শহরের যে জায়গাগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত সেগুলো আসলে “Boys Appendage” বা “মেয়েদের জন্য, ছেলেদের তৈরি করা স্থানের একটা উপশিষ্ট”। এই শহর, শহরের মধ্যে উন্নয়ন বলতে আজ পর্যন্ত যা হয়েছে সেগুলার উদ্দেশ্য মূলত পুরুষদের “কষ্ট” কমানো, সেখানে নারীরা প্রতিনিয়ত মানিয়ে যাচ্ছেন। এখান থেকে আপনারা বুঝতেই পারছেন, বাংলাদেশের মত গ্লোবাল সাউথের একটা দেশের শহরগুলোতে লৈঙ্গিক বৈষম্য অনেক প্রকট। ভালোভাবে তাকালে, এশিয়ার বেশিরভাগ দেশের শহরের চিত্র এরকম।

১. নারীদের পথ হারানো মানা

হিমুর মত শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে হেঁটে বেড়ানোর বিলাসিতা নারীদের নেই, থাকলে সেটা দিনের আলো থাকা অবস্থায় সেরে ফেলতে হয়। এখানেও ‘কিন্তু’ আছে। আপনি চাইলেই আপনার ফোন অফ করে উদ্দ্যেশ্যহীন হয়ে যেতে পারেন না। কোথাও যাওয়ার আগে আপনাকে জেনে নিতে হবে সেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আছে কিনা, পরিবারের কাউকে বা বান্ধবীকে জানিয়ে রাখা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ফোনে কথা বলতে থাকার অভিনয় করা যাতে একলা পেয়ে চালক ভুল পথে নিয়ে না যায়।

একটা নৈব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে শহরে চষে বেড়ানো “পুরুষ”কে চার্লস বডেলিয়ার নাম দিয়েছেন Flâneur। লেসলি বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন এই Flâneur কি নারী হতে পারেন (Flâneuse)? এই একটু আগেই আমি যা বললাম তার আলোকে এই উত্তরটা স্পষ্ট, নারীদের জন্য এটা বিলাসিতা। আমাদের লৈঙ্গিক পরিচয় আমাদের অযাচিত দৃষ্টির কেন্দ্র বানায়। লেসলি তাঁর শ্বেতাঙ্গ পরিচয়ের ফলে প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধার কথা স্বীকার করেছেন, তবে নগরায়নের ফসল ভোগ করবে কেবল শ্বেতাঙ্গ সিস পুরুষেরা।

২.  বান্ধবী, বন্ধুত্ব ও শহর

আমার শৈশবে, খুব সম্ভব ২০০৫-০৬ এর দিকে, একুশে টিভিতে একটা ধারাবাহিক প্রচারিত হত – “সপ্তর্ষি”। এই নামটা  আসলে কয়েকজন শহুরে বান্ধবীদের দলের নাম, যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় এসে একে অপরের জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ভাড়া বাসায় রুমমেটের জ্বালাতন বা সব কিছুর চড়া দামের মধ্যে কোনমতে বেঁচে থাকার লড়াই, এরই মাঝে কয়েক জন নারীর বন্ধুত্বের ভাঙ্গা গড়ার গল্প ছিল এই নাটকটি।

লেসলি বইতে এই রকম নারী ও শহরকেন্দ্রিক কিছু ধারাবাহিকের কথা তুলে ধরেছেন, যেমন সেক্স এন্ড দ্য সিটি। আমি এই ধারাবাহিকটা দেখেছি, এজন্য “চার জন নারী ও নিউ ইয়র্ক সিটি মিলে বন্ধুত্ব” এমন ক্লিশে দিয়ে কীভাবে পপ কালচারে এই সিরিজের প্রভাব ছড়িয়েছে সেই নিয়ে আমি অবগত। এই প্রভাব এতটাই প্রবল যে ২০০২ তে শেষ হওয়ার পরে এই নামের দুইটা ফলোআপ সিনেমা ও তার পরের কাহিনী থেকে আরেকটা ধারাবাহিক শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। মোটা দাগে এই সিনেমা আর ধারাবাহিকগুলোতে নিউ ইয়র্কের মত কসমোপলিটোন শহরে নারীদের কেরিয়ার, ফ্যাশন, ডেটিং লাইফ, অর্জন ইত্যাদি নিয়ে প্রতি সপ্তাহে বাইশ মিনিট ধরে কাহিনী বুনে দেখানো হত। আমার জানা মতে, “সপ্তর্ষি” নাটকটা ঢাকা শহরের ব্যাকড্রপে আমাদের কালচার অনুযায়ী সেই জিনিসটার কাজ করেছিল, যদিও শহর যে তুলনামূলকভাবে নারীদের প্রতি কঠোর হয়ে থাকে সেটা প্রতীয়মান হয়েছে এই নাটক থেকে।

লেসলি বর্তমান শহুরে জীবনে নারী বন্ধুত্ব, বান্ধবীদের মধ্যে বন্ধনের উপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। এই বন্ধন থেকে আমরা এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীকে এগিয়ে দেই, বাসায় ফিরলে টেক্সট করে জানাই, অফিসের বস কতটা প্যারা দিয়েছে সেই নিয়ে গল্প করতে পারি। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার আর টেকনোলজির বিস্ফোরণের ফলে আমরা এখন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ  পেয়েছি। জীবন হয়ত সহজ হয়েছে কর্মজীবী নারীদের জন্য, তবে আমি আর  আমার পরিচিত নারীরা উবার বা পাঠাও বাইক বা গাড়িতে উঠলে বান্ধবীকে গাড়ির নম্বর অ্যার লোকেশন শেয়ার করতে থাকি। বলা হয়ে থাকে, মেয়েরা সাবালিকা হয়ে উঠে ছেলেদের চেয়ে দ্রুত, এখন মেয়েরা বাড়ির বাইরে যাচ্ছে আগের তুলনায় বেশি। কিন্তু খুব সামান্যই আলাপ হয় কেন, আমরা নারীরা সব জায়গাকে বিপদের সংকেত হিসেব দেখতে অভ্যস্ত। এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি, অবাক না হয়ে পারিনি যে লন্ডন অ্যার টরেন্টো শহরে থেকে লেখিকা কোনো জায়গাকে প্রথম দর্শনে বিপদমুক্ত ভাবতে পারেন নি। শহরে অনেক সুযোগ সুবিধা ভোগের পাশাপাশি নারীরা ধরেই নেন, বিপদ তাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে প্রতিনিয়ত।

৩. নারীর একার শহর

মানুষ মাত্রই স্থান ধারণ করবে, তবে নারীদের ক্ষেত্রে একটা পাবলিক প্লেসে তাঁর অস্তিত্ব প্রায়শ বিভিন্নভাবে বিঘ্নিত হয়। বইতে লেসলি বেশ কিছু গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন যে অনেক নারী ইয়ারফোন কানে দিয়ে পাবলিক প্লেসে যাতায়াত করেন যাতে তাকে “বিরক্ত” করা না হয়। এটাকে দেখা যেতে পারে একধরনের কোপিং মেকানিজম হিসেবে- আমাকে আমার মত থাকতে দাও। তারপরেও নারীদের ডেকে বিরক্ত করা ও অযাচিত আচরণ করেন অনেক অপরিচিত পুরুষই। নারী হয়ে আপনি কোথাও একা বসে থাকুন বা খেতে যান, আপনার দিকে লোকজন তাকিয়ে থাকবে এমনভাবে যার মানে হল, তোমার তো এখানে থাকার কথা নয়। বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে লেখিকা আরো দেখিয়েছেন, সবার জন্য উন্মুক্ত পাবলিক প্লেসেও নারীরা অবাঞ্ছিত বোধ করেন কারণ নারীদের ছোট থেকে শেখানো হয় জায়গা “দখল” না করতে। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, বাসে উঠে আমি জবুথবু হয়ে থেকেছি কারণ মহিলা সিটে  আমার পাশে বসা পুরুষটি হাত পা ছড়িয়ে বসেছেন।

এই অভিজ্ঞতার আলোকে আজকের আলোচনার প্রথম পয়েন্টে ফিরে যাই, যেখানে শহর আমার একান্ত হয়নি সেখানে আমি কী করে একটা নৈব্যক্তিক দৃষ্টির পথচারী হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি ?

৪. ঢেঁকি কেন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে?

কোনো একটি জায়গার সাথে সেখানে একজন মানুষের আচরণ কী রকম হবে সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে প্রকাশিত হয়। লেসলি তাঁর বিবিধ অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর একটা ইউনিয়ন আন্দোলনের সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। সেখানে আন্দোলনের  অংশ হিসাবে পুরো ইউনিভার্সিটি এলাকাকে অবরোধ করেন তারা। কিছুদিন এই আন্দোলনের মধ্যেই দেখা গেল তাদের নিভৃতচারী পুরুষ সহকর্মীটি আগুনের প্রয়োজনে গাছ কেটে ফেলছেন বা উত্তপ্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন, আর নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আন্দোলনকারীদের জন্য মানসিক শ্রমে। এরকম একটা পরিসরে, নারী ও পুরুষগণ যার যার স্বর্গে ধান ভানছেন। এটার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আপনি দেখবেন বিভিন্ন আন্দোলন ও সামষ্টিক বিপ্লবের সময়। লেসলি উদাহরণ হিসেবে এলকাতরাজ জেল ভেঙ্গে পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের মধ্যে নারীদের যে ভূমিকা ছিল সেটা প্রায় সকল ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা। জনগুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, প্রতিবাদ সমাবেশ কিংবা যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস পুরোটাই বিজয়ী পুরুষের লেখা, পুরুষের বীরত্বের গাঁথা।

আমাদের নারীদের মধ্যে সেবা করার প্রচেষ্টা স্বভাবগত, কিন্তু আমি নিজেও বিভিন্ন পরিসরে দলনেত্রী দেখেছি যারা এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নিজের দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমাদের সামনে মমতাময়ী, সেবাময়ী নারীর রূপ যতটা প্রচার করা হয়, ততটা উদাহরণ কোনো নেত্রীকে নিয়ে করা হয় না। আপনি কি জানেন, ১৯৬৯ সালের চন্দ্র অবতরণ মিশনে নারী বৈজ্ঞানিকদের অনেক অবদান থাকা সত্ত্বেও ইতিহাস কেবল পুরুষ নভোচারীদের কথা বেশি বলে। ঢেঁকিকে ধান বাদে অন্য কিছু না দিলে ঢেঁকি যা করার তাই করবে। দোষ এক্ষেত্রে ঢেঁকির হয়।

নারীবাদের আলোকে নগর পরিকল্পনা করতে গেলে আমাদের ভেবে দেখতে হবে, সেই নগর প্রতিবাদের দিনগুলোতে একমাত্রিক জেন্ডার নর্মের জায়গা হয়ে যাচ্ছে কিনা।

৫. নারীর ভয় আর অপরাধবোধ

বেশ কয়েক বছর আগে, অফিসে যাওয়ার জন্য রাস্তা পার হচ্ছিলাম। আমি একটা কোটি পরেছিলাম লম্বা ফতুয়ার উপরে। আমাকে একটা রিকশাওয়ালা ধাক্কা মারার চেষ্টা করে একটু সামনে গিয়ে বাজে ইঙ্গিত করে বলেছিল, ওড়না না পরলে এরকম আচরণ আমার প্রাপ্য। এটা আমার প্রথম হেনস্থার ঘটনা না। এবং আমি প্রথম নারী নই যাকে এরকম আচরণ পেতে হয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমি সেদিন নিজেকে দোষারোপ করেছিলাম। অবচেতনভাবে আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমি কিছু একটা করেছি বলেই বেছে বেছে আমাকে লোকটা বাজে ইঙ্গিত করেছে। কই ওই মহিলাকে তো করলো না? নিশ্চয় আমার পোশাক, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে এমন কিছু পেয়েই একটা রিকশাওয়ালা এমন করল।

বাসায়, বাসার বাইরে, শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে নারীদের সর্বদা একটা ভয় নিয়ে চলতে হয়, নিজের নিরাপত্তার। ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের স্থানের অধিকার নিয়ে লড়াই করতে হয় টিকে থাকার জন্য। আমি সেদিন রিকশাওয়ালাকে থামিয়ে বলিনি কিছু, উল্টা নিজেকে দোষ দিয়েছি। লেসলি বইতে অনেক গবেষণার তথ্য থেকে দেখিয়েছেন, নারীরা কখনো যদি তাদের উপরে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এবং এর বিনিময়ে আবার হেনস্থা (!) না হন, তবুও তিনি মনে করেন হেনস্থা তার প্রাপ্য ছিল। এই বিষয়টা আরো সূক্ষ্মভাবে দেখা যায় ধর্ষণের ভিক্টিম ব্লেমিং কালচার থেকে।

পরিশেষে, একজন শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী ও নগরবাদী লেখকের ব্যক্তিগত চোখে যা যা ধরা পড়েছে, সেসব পড়ে আমি ভাবছি ঢাকা শহরে নারীদের অবস্থার কথা। নারীদের সংগ্রাম চলেছে শিক্ষার অধিকার, জীবিকার অধিকার, ভোটদানের অধিকার আদায় করতে। নারীরা বের হয়েছেন বাইরে, কিন্তু শহর তাকে শুধুই বলেছে, মানিয়ে নাও। আমি নারীবাদের একজন অনুসারী ও ভক্ত হিসেবে বিশ্বাস করি, নারীবাদ জেন্ডার ইনক্লুসিভ জায়গা ও শহর নিশ্চিত করতে পারে যদি আমরা নারীদের কথা শুনি নগর পরিকল্পনার সময়। শৈশবে আমার মা আমাকে যেভাবে শিখিয়েছেন আমি স্থান ধারণ করছি সেভাবে। কেন আমি স্থান ও নকশার সাথে মানিয়ে নেব, যেটা একমাত্রিকভাবে তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে?

আমি যেমন প্রশ্ন করছি এই শহরকে, আপনারা করছেন তো?

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *