আফগানিস্তানের সবচেয়ে সাহসী নারী – জয়া
ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর ডেস্ক ।। ২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির বার্ষিক তালিকায় স্থান দেয়। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন তাকে শীর্ষ ১০০ বিশ্ব চিন্তাবিদদের তালিকায় তালিকাভুক্ত করেছিল। ২০১১ সালের ৮ মার্চ দ্য গার্ডিয়ান তাকে “শীর্ষ ১০০ জন নারী: কর্মী এবং প্রচারক”-এর তালিকাভুক্ত করে। আর বিবিসি তাকে “আফগানিস্তানের সবচেয়ে সাহসী মহিলা” বলে অভিহিত করেছিল।
হ্যাঁ, বলছিলাম আফগানিস্তানের মেয়ে মালালাই জয়ার কথা। ২০২১ সালে তালেবান শাসনের হুমকি জয়াকে আফগানিস্তান ছেড়ে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করেছিল। ৪৬ বছর বয়সী জয়া আফগানিস্তানের একজন অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক এবং রাজনীতিবিদ। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৭ অব্দি আফগানিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে একজন পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, আফগান সংসদে যুদ্ধবাজ এবং যুদ্ধাপরাধীদের উপস্থিতির প্রকাশ্যে নিন্দা করার জন্য বরখাস্ত হন। তিনি কারজাই প্রশাসন এবং তার পশ্চিমা সমর্থকদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন স্পষ্ট সমালোচক।
আফগানিস্তানের মর্যাদা ও অধিকারহীন, অসহায়, নিপীড়িত নারীদের জন্য লড়াই জারি রেখেছিলেন জয়া। গ্রামে ও শহরে ঘুরে নারীদের কষ্টের কথা শুনেছেন। এরপর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে তাকে অপমানিত হতে হয়েছে বারবার। সমালোচিত হতে হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হতে হয়েছে। তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার। তবু তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তিনি হয়েছিলেন আফগানিস্তানের বয়োকনিষ্ঠ সাংসদ।
জয়ার যখন বয়স চার বছর, তার পরিবার আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে ইরানে শরনার্থী হিসেবে বসবাস শুরু করে। শৈশব থেকেই প্রতিবাদী, স্পষ্টবাদী মেয়ে ছিলেন তিনি। সেজন্য গ্রেড এইটে পড়ার সময় থেকেই অ্যাকটিভিজমে জড়িয়ে যান। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য কাজ করতেন।
তালেবানের শাসনামলে জয়া ১৯৯৮ সালে আফগানিস্তানে ফিরে আসেন এবং সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ২০০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বরে রাজনৈতিক নেতাদের বড়সড় একটা সমাবেশ হয় হয়। মজলিসে জড়ো হন আফগান রাজনীতিক, ধর্মীয় ও যুদ্ধবাজ নেতারা। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যে যার মতো আলাপ করছিলেন, এমন সময় মাইক্রোফোন হাতে উঠে দাঁড়ান জয়া। বলেন, ‘‘আমি আমার দেশবাসীর সমালোচনা করছি, যারা এই মহান সমাবেশে অপরাধীদের ডেকে এনেছে তাদেরও। এরাই অপরাধী, যারা এ দেশে আজ গৃহযুদ্ধ বা একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বাধিয়েছে। দেশে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচার হওয়া উচিত।”
মজলিসজুড়ে পিনপতন স্তব্ধতা নেমে এসেছিল কয়েক মুহুর্তের জন্য। কথা শেষ হতেই শুরু হয়ে গেল তুমুল গুঞ্জন। সবার চোখ খুঁজে ফিরছিল রূঢকণ্ঠী নারীকে। সবাই ঘুরে তাকালো তার দিকে। এক নারী প্রতিনিধি চেঁচিয়ে উঠলো- ‘‘ওই বেশ্যার প্যান্ট খুলে মাথায় বেঁধে দাও।” ততক্ষণে জয়ার মাইক্রোফোনের সংযোগ ছিন্ন করা হয়েছে। অন্য একজন মহিলা হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায় জয়াকে। ফিসফিস করে বলেন, ‘‘সরে এসো। এরা এতটাই বিকৃত যে এই কাজ করে দেখালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’’
এভাবেই মৌলবাদী, রক্ষণশীল ক্ষমতাবানদের চোখের কাঁটা হয়ে ওঠেন জয়া।
জয়া ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে ফারাহ প্রদেশের প্রতিনিধি হিসাবে ২৪৯টি আসনের জাতীয় পরিষদে বা ওয়ালেসি জিরগায় নির্বাচিত হন। তিনি ৭.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোটে জয়ী হন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর একটি সংবাদ সম্মেলনে জয়া বলেন, “আফগানিস্তানের জনগণ সম্প্রতি তালেবানের খাঁচা থেকে পালাতে পেরেছে কিন্তু তবুও তারা যুদ্ধবাজদের খাঁচায় আটকে আছে”।
বিবিসি জয়াকে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী বলে অভিহিত করে। ২০০৭ সালে বিবিসি’র সাথে একটি সাক্ষাত্কারে জয়া বলেন,
“তারা আমাকে মেরে ফেলবে কিন্তু আমার কণ্ঠকে মারতে পারবে না, কারণ এটা সমস্ত আফগান নারীর কণ্ঠস্বর। আপনি ফুল কাটতে পারেন, কিন্তু বসন্তের আগমনকে থামাতে পারবেন না।”
মালালাই জয়া ২০০৬ সালে কানাডার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) এর ফেডারেল কনভেনশনে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেখানে তিনি বলেন, কোনো জাতি অন্য জাতিকে মুক্তি দিতে পারে না। তিনি মন্ট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশে ভাষণ দেন, যেখানে তিনি আফগানিস্তানে মার্কিন কর্মকাণ্ডে তার হতাশা প্রকাশ করেন। তার বক্তব্যের পর অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিস র্যানকোর্ট জয়া সম্পর্কে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, “তার বক্তৃতাটি ছিল মার্কিন-কানাডা যুদ্ধের প্রচারের মোটা জালের মধ্যদিয়ে একটি ধারালো ব্লেড কাটা… সমস্ত এমপিদের এর থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার।”
জয়া ২০০৭ সালে সিডনিতে UNIFEM- এর অতিথি হিসাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সম্মানে আফগানিস্তানে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেছিলেন।
স্পেনের জনপ্রিয় টোয়েন্টি মিনিটোস পত্রিকা “বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা রাজনীতিবিদদের” তালিকায় মালালাই জয়াকে ৫৪তম স্থানে রেখেছিল পাঠকের ভোটে। অ২০০৯ সালে জয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় সফরে যান এবং অনেক যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
২০০৮ সালের নভেম্বরে মালালাই জয়া নরওয়ে সোশ্যাল ফোরামে যান এবং ১৯০০ মানুষের সামনে বক্তৃতা করেন। তিনি নরওয়েজিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে একটি বিতর্কেও অংশ নেন এবং নরওয়েকে আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করতে বলেন। ওবামা যখন ২০০৯ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন, তখন নোম চমস্কি একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি যদি সত্যিই যোগ্য পছন্দ করতে পারে, তবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আফগান কর্মী মালালাই জয়া।”
জয়া ২০১১ সালে বোস্টন থেকে তার মার্কিন সফর শুরু করেন অধ্যাপক নোয়াম চমস্কির সাথে, তিনি হার্ভার্ডের মেমোরিয়াল চার্চে ১২০০ মানুষের সামনে আফগান যুদ্ধের উপর একটি উপস্থাপনা দেন।
২০০৬ সালে মালালাই জয়াকে সংসদে তার সহকর্মী সদস্যরা শারীরিক ও মৌখিকভাবে আক্রমণ করেছিল। সেসময় জয়া গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, “আমি বলেছিলাম আফগানিস্তানে দুই ধরনের মুজাহেদিন আছে। এক ধরনের মুজাহেদিন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল, কে আমি সম্মান করি; কিন্তু অন্যরা দেশ ধ্বংস করেছে এবং ৬০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।” এই কথার পর ক্ষুব্ধ আইনপ্রণেতারা চিৎকার করে তাকে মৃত্যুর হুমকি দেয় এবং জয়ার দিকে খালি প্লাস্টিকের জলের বোতল ছুড়ে দেয়। এই ধরনের হুমকির জবাবে জয়া বলেন,
“আমি আর কখনও ভয়ের ছায়ায় ফিসফিস করব না। আমি শুধু আমার জনগণের সংগ্রামের প্রতীক এবং তাদের উদ্দেশ্যের একজন সেবক। এবং আমি যা বিশ্বাস করি তার জন্য যদি আমাকে হত্যা করা হয়, তবে আমার রক্তকে মুক্তির আলোকবর্তিকা হতে দিন। এবং আমার কথাগুলি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বিপ্লবী দৃষ্টান্ত।”
২১ মে ২০০৭-এ মালালাই জয়াকে তিন বছরের জন্য আইনসভা থেকে স্থগিত করার পক্ষে ভোট দেয়া হয়।
২০১০ সালে প্যারিসে তার স্মৃতিকথা “A Woman Among Warlords” এর ফরাসি প্রকাশনার অনুষ্ঠানে জয়া আফগান সংসদীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।