November 14, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কেউ কি ভালো থাকে?

তৌকির ইসলাম ।। আজকের এই লেখার শুরুতে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই শারমিন শামস্-কে, যিনি সবসময় খোঁজ নিয়ে লেখার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা কম বেশি সবাই নারীরা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কেমন আছেন বা কি অবস্থান তা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি একটু মুদ্রার অন্য পিঠটা আজকের এই লেখায় তুলে ধরব। পুরুষরা কেমন আছেন এই সমাজ ব্যবস্থায়! শুনতে অবাক হলেও এটিই আমার লেখার বিষয় আজকে। ব্যাপারটার গভীরে যাওয়ার আগে আমাদের আরেকবার একটু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণাটা ঝালিয়ে নিতে হবে।

মানব সমাজে অসহায় দুর্বল হিসেবে সবসময়ই দেখা হয়েছে নারী এবং শিশুকে। আর পুরুষকে দেখানো হয়েছে সবল শক্তিশালী হিসেবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আদর্শিক ব্যাপারটা হচ্ছে পুরুষরাই হচ্ছেন ক্ষমতার আধার। পুরুষের সব কিছু করার অধিকার রয়েছে। আর নারী শুধু পুরুষের কথা শুনে যাবে। তার কোনো মতামত থাকবে না। অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকবে না। সে থাকবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল। এই পুরো ব্যাপারটাকে আমরা বলতে পারি যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা যেখানে তথাকথিত দুর্বল শাসিত হবে নিজ ঘোষিত সবলের মাধ্যমে। অন্যভাবে বলতে গেলে এটা এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে তথাকথিত দুর্বলের কোন কিছুর অধিকার থাকবে না। এরূপ সমাজ ব্যবস্থা নারী শিশুর জন্য ভয়াবহ তা সর্বজন বিদিত। কিন্তু পুরুষের জন্যও এটি কোনো সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা নয়। এরকম একটা সমাজ ব্যবস্থায় কখনো সামাজিক ভারসাম্য থাকে না। বরং একটা অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়। একটা ছেলে যখন এই সমাজ ব্যবস্থায় জন্ম নেয়, তাকে বড় করা হয় এভাবে যে তুমি ছেলে, তোমার শক্তি মেয়েদের থেকে বেশি। তুমি আবেগী নও। তুমি কোমল নও। তুমি কাঁদলে সবাই হাসবে। তুমি হলে রক্ষাকর্তা। এভাবে যখন একটা ছেলে বড় হয় তখন সে হয়তো তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষ হয়ে ওঠে কিন্তু মানুষ হয়ে ওঠে না। সমাজের এই মানদণ্ড কে ঠিক করল যে ছেলে মাত্রই আবেগ থাকবে না, মায়া থাকবে না! শক্ত হতে হবে! আর মেয়ে হলেই সে হবে আবেগী মায়াবী? এর উত্তর আসলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

কোমলতা, নমনীয়তা, আবেগ – এসব কিছু যে একজন মানুষের সহজাত গুণাবলী তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় জন্মের সাথে সাথে নারী-পুরুষ ভিত্তিক হয়ে গিয়েছে। আমরা তো ভুলেই গিয়েছি যে নারী পুরুষ সবারই আবেগ আছে; শক্তিশালী হওয়ায় সাথে পুষ্টির একটা সম্পর্ক আছে এই সমাজের যাঁতাকলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী পায় না সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ তাই সে উপাধি পায় অসহায় কিংবা অবলা। আর পুরুষ পারে না নিজের আবেগ, নমনীয়তা প্রকাশ করতে তথাকথিত পুরুষত্ব জাহির করতে গিয়ে।

এরকম একটা সমাজে একজন পুরুষের ভালো থাকাও সম্ভব নয়, নারী কিংবা শিশু তো অনেকটা পরের বিষয়। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে মানুষকে মানুষের মত বেড়ে ওঠতে না দেওয়া। এমন সমাজে কারো পক্ষেই ভালো থাকা সম্ভব নয়। অনেক ছেলেকেই আমি জানি যারা বলতে পারে না তাদের মনের কথা কারণ সে পুরুষ। কাঁদতে পারে না যদি কেউ হাসে। আমি নিজেও মাঝে মাঝে ফিল করি এরকম। আসলে সমাজ একটা ভারসাম্যের বিষয়। একজন নারী শক্তিশালী হতে পারে, একজন পুরুষের অনেক আবেগ থাকতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। শারীরিকভাবে নারী পুরুষের হাড়ের ডেনসিটি কম বেশি, সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু সমাজ যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছে নারী ও পুরুষ এর জন্য – আমি তার পক্ষে নই। আমি এমন পুরুষকে জানি যখন তথ্যগত কারণে তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে আপনার পেশা কী, তিনি আনন্দের সাথে বললেন হাউজ হাজব্যান্ড। বাচ্চার দেখভাল তিনি করেন আর তার ওয়াইফ ওয়ার্ক ফ্রম হোম। আমার এটা বলার উদ্দেশ্য এমন নয় যে আমি হাউজ হাজব্যান্ডকে প্রোমোট করতে চাচ্ছি। আমি বুঝাতে চাচ্ছি এই যে ভদ্রলোক অতি আনন্দের সাথে কথাটা বলতে পারল এরকম একটা সমাজে, সেই সমাজের কথা – যেখানে নারী বা পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবে মানুষ গন্য হবে।

যখন সমাজে মানুষের চেয়ে ব্যাপারটা নারী পুরুষে আটকে যায়, তখনই ঘটে সমস্যা। এরকম সমাজে শুধু মানুষ না, পরিবেশও ভালো থাকতে পারে না। দেখবেন যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সবারই  নিজের ক্ষমতা দেখানোর ইচ্ছা প্রবল। যখন সে এটা পারে না অন্যের সাথে, তখন সে ক্ষমতা দেখায় পরিবেশের সাথে, প্রাণীর সাথে, গাছপালার সাথে। ব্যাপারটা ইকোফেমিনিজম-এর সাথে জড়িত। সেটা নিয়ে আরেকদিন না হয় লিখব। নারী পুরুষকে সর্বোপরি মানুষ ও পরিবেশকে ভালো রাখতে চাই মানুষের সমাজ।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *