September 20, 2024
কলামফিচার ২

বঙ্গবন্ধু: নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সমতার অন্য নাম

শাওন মাহমুদ।। আশ্রয়। আমার কাছে এক টুকরো জায়গা বা মাথা গোঁজার ঠাঁই থেকেও বড় শব্দ। যে পরিবারে মাকে শ্রদ্ধা করা হয়, তাঁর মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়, সে পরিবারের সন্তানেরা ভালো মানুষ হয়ে বড় হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে পরিবারের পুরুষকে এই মানসিক আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি সবসময়ে গুরুত্ব পেয়ে থাকে। মানসিক আশ্রয় বা আস্থায় হারানোর কিছু নেই, আছে সহজ স্বাভাবিক ও সুস্থ পরিবেশে সন্তানকে বড় করবার অনিন্দ্য সুন্দর প্রয়াস। নিজ মতকে গঠনমূলক করবার তাগিদ।

আসছে মুজিব বর্ষ। আমরা জাতির পিতাকে স্মরণ করছি, তাঁর নানা কাজের মধ্য দিয়ে। আজ আমি স্মরণ করছি, তাঁর সবচেয়ে সুন্দর গুণগুলোকে। যেমন নারীর প্রতি, মানুষের প্রতি মানসিক আস্থা, মানবিক মর্যাদা আর ভালোবাসার আশ্রয় দিয়ে, তিনি কেমন করে একটা জাতির পিতা হয়ে বুকে গেঁথে রয়েছেন, তাই নিয়ে।

শেখ মুজিবর রহমানের জাতির পিতা হওয়ার পেছনে শুধুই রাজনৈতিক সুদৃঢ় নেতৃত্ব নয়, একই সাথে সাধারণ মানুষকে কাছে টেনে আনবার এবং মানসিক আশ্রয় দেয়ার যে প্রবল ক্ষমতা তাঁর ছিল, সেটা কাজ করেছিল বলে আমি মনে করি। তিনি জানতেন আমরা কী হারিয়েছি আর কারা তার ডাকে এগিয়ে এসেছে। এমনকি তিনি তাও জানতেন কার জন্য আমরা মেনে নিয়েছি সব হারানোর বেদনা। সেই প্রথম আমার মায়ের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন আর সারাজীবন দেখে রাখবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কঠিন গলার স্বর ভেদ করা তাঁর উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ ছিল বেদনাময়। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে আমাদের মতো কিছু উদ্ভ্রান্ত শহীদ পরিবার টিকে গিয়েছিল বাংলাদেশে, নাহলে খড়কুটো হয়ে ভেসে যেতাম কোথায় কে জানে! এভাবেই তিনি আমার মাঝে পরিবারের থেকেও বৃহৎ জাতির পিতার আসনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন।

আশ্রয় মানুষ কার কাছে খোঁজে? যার ওপরে ভরসা করা যায়। বঙ্গবন্ধুর ওপরে এমনই ভরসা ছিল আমার বাবা আলতাফ মাহমুদের। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর আলাপ সম্ভবত ১৯৫৪ সালের গোড়ায়। আলতাফের বয়স তখন একুশ পেরোয়নি আর বঙ্গবন্ধু তেত্রিশ। বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। জিল্লুর রহমানের মাধ্যমে আলতাফের আলাপ হল বঙ্গবন্ধুর সাথে। বঙ্গবন্ধুর নিয়মিত জেলযাত্রা ও আলতাফের ক্রমে সঙ্গীত জগতের সাথে সংপৃক্ততা চলতে থাকল। তার মধ্যেও বাড়তে থাকল সখ্যতা ও পারস্পরিক ভরসা। ভাষা শহীদদের স্মরণে আলতাফের সুরারোপিত ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বঙ্গবন্ধুর এতই পছন্দ হয়েছিল যে ভাষা শহীদদের স্মরণে একুশের প্রভাতফেরীতে বঙ্গবন্ধু সকলের সামনে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝোলানো আলতাফকে পাশে নিয়ে হেঁটে যেতেন। আলতাফ গাইতেন ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’, আর দৃপ্ত পায়ে মুজিব এগিয়ে যেতেন শহীদ মিনারের দিকে। সে ছবি এখন আবার যখন দেখি আমার চোখ পানিতে ভরে ওঠে।

যে মানুষটির আহ্বানে বাবার মতো লাখো বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলো, নিজেদের উৎসর্গ করেছিল, সেই মানুষটিও অসহায়, অভিবাবকহীন পরিবারগুলোকে কখনও ‘না’ বলেননি, খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ সম্ভব ছিল না, হয়ওনি, তাই কাউকে জানানোও হয়নি আমাদের কষ্টের কথা। মা আজও বারবার উচ্চারন করেন, এই তো সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার বাড়ির দরজা তোর জন্য সবসময় খোলা থাকবে।

কি বিশাল আস্থা, কত বড় মানসিক আশ্রয় তিনি দিতে পারতেন! ভাবতেও অবাক হয়ে যাই। মায়ের কাছে শুনেছি – ৭১ এর অগাস্টের ৩০ তারিখ ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধাদের সাথে পাক হানাদার বাহিনী তুলে নিয়ে গেল আলতাফকে। নাহ, তার লাশ অবধি আমরা পাইনি। তারপরে স্বাধীনতা এল।

বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। কিন্তু আলতাফ হারিয়ে গেলেন। আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। ১৯৭২ এ বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পরে এক অনুষ্ঠানে আমার সাথে বঙ্গবন্ধুর দেখা। প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে তিনি তার দীর্ঘ দু’হাতে বুকে টেনে নিলেন। বললেন – তোর জন্যে আমার দরোজা সবসময় খোলা, তুই কি চাস?

অনেকেই তখন তার কাছে চাকরি বা অর্থ চাইত। আমি বললাম – আমি পড়তে চাই। উনি বললেন – ঠিক আছে, আগে তুই পড়াশোনা শেষ কর। আমি ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে কলেজে গেলাম বিএ পড়তে। তখন অনেকবার গেছি তার বাড়িতে। বঙ্গমাতার স্নেহে ও প্রশ্রয়ে ক্রমে সামলে নিতে শুরু করলাম নিজেকে। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় দিক যা আমাকে আপ্লুত করত তা হল, তিনি শহীদদের পরিবার সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ নিতেন। ক্রমাগত আমাকে উৎসাহ দিতেন আমার পড়াশোনায়। বলতেন – একদিন এই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সকল দেশের সেরা। আমরাও সেই স্বপ্নে বিভোর হতাম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন স্বামীর কর্মস্থল বিদেশে গেলেন, তাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানিয়ে ফিরে এসে শোকে মুহ্যমান ছিলেন। আমরা দেখলাম এক স্নেহময় পিতাকে। কন্যাবিচ্ছেদে যার চোখ অশ্রুসজল।

তিনি ছিলেন জাতির পিতা। স্বাধীনতার পরে পরেই আমাদের বাসস্থানের সমস্যার কথা শুনে তিনি রাজধানীর ১নং মালিবাগ এলাকায় আমার পরিবারকে বাড়ি বরাদ্দ দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর পাল্টে যায় চিত্রপট। পরিবারের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। আমার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। এই দেশের মানুষের জন্যে তাঁর আবেগ যারা দেখেছেন তারা বুঝেছেন যে তার বুকে বাস করত এদেশের মানুষ।

আমি এমএ পাস করার আগে এল সেই তমসাবৃত অগাস্ট। পঁচাত্তরের। ঘাতকের হাতে শহীদ হলেন জাতির পিতা। পাক হানাদারদের উত্তরপুরুষদের বুলেটে নিশ্চিহ্ন হলেন তিনি। সপরিবারে। জানি না কি দোষ ছিল বঙ্গমাতার ! জামাল, কামাল বা ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেলের! দুই বৌয়ের!

মা আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু বাড়ি না থাকলেও কখনও মনে হতো না তিনি নেই। তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিতুলাতুন্নেসা পরম মমতায় আগলে রাখতেন সকলকে। দুপুর বা রাতের খাবার না খাইয়ে কাউকে যেতে দিতেন না। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ভাত বেড়ে দিতেন সবার থালায়। বিরক্ত হতেন না একটুও। পরিবার ছাড়িয়ে পুরো জাতির আশ্রয় গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্ত্রীকে সেই প্রবল মানসিক আশ্রয় দিয়েছিলেন, এমনকি তাঁর রাজনৈতিক মতামতের প্রাধান্য দিতেন সবসময়; যা শেখ ফজিতুলনেসাকে ঝঞ্ঝা ঝড়ের মাঝেও স্থির রাখতে সাহায্য করেছিল। জাতির পিতার মানসিক আশ্রয়, আস্থায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের জননী।

রাজনীতি, জেল, মিছিল, রায়ট শেষেও পরিবারই ছিল তাঁর কাছের স্থান। মা, স্ত্রী, সন্তানের মাঝে তৈরি করে নিয়েছিলেন ভালোবাসাময় স্বস্তির বসবাস। বাবা মায়ের সেঝ ছেলে খোকা, এক সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন পারিবারিক দৃঢ় বন্ধনের পথ ধরে। তাঁর পারিবারিক স্মৃতি জানবার পর মনে হয়েছে, বাবা মায়ের প্রবল মানসিক বিশ্বাসে তিনি তাঁর পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। ঠিক একই ধারা তিনি বাহিত করেছিলেন সবার মাঝে। বিশ্বাস, আস্থা, আশ্রয়, বন্ধন আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল তাঁর চলার পথ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সঙ্গীদের খেয়াল করলে দেখা যায়, তিনি ঠিক খুঁজে বের করতেন যোগ্য লোককে। তেমন মানুষকে দলে জায়গা করে দিতেন। নারী পুরুষে বিভেদ সৃষ্টি করেন নাই কখনও। সেই আমলে সাজেদা চৌধুরীর মতন রাজনীতি সচেতন তরুনীদের তিনি দলে যোগ্য পদে স্থান দিতেন, তাঁদের মতামতে গুরুত্ব দিতেন পুরুষের সমতায়। আস্থা ছড়িয়ে দিতেন দল, মত নির্বিশেষে। নারীর রাজনৈতিক মতামতের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন, মানসিক আশ্রয়ের ছায়া হয়ে। মিটিং মিছিল বা প্রতিবাদে নারীদের এগিয়ে রাখতেন সামনের সারিতে। এমন কি একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের পিতা হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, পূনর্বাসন করেছিলেন নিজ কন্যার মত করে।

আহা আশ্রয়! একজন সব হারানোর জন্য বিশাল প্রাপ্তি ছিল সেই মানসিক আশ্রয়।

শহীদের জন্য, বীরাঙ্গনার জন্য, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার জন্য, বিধবা শহীদ জায়ার জন্য, জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া বাংলার গ্রামগঞ্জের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতেন। তিনি জানতেন তাঁকে তাঁর দেশের মানুষ উপহার দিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম এক সোনার দেশ। ততধিক ভালবাসার হাত তিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, এদেশের মানুষের দিকে। বিশেষ করে নারীর প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যায় আরেক উচ্চধারার শীর্ষে। পরিবার তাঁকে সেই শিক্ষায় দীক্ষিত করেছিল বলেই তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, ভালোবাসলে ভালোবাসা আসে।