ধর্ম ও নারীবাদ
মাহমুদুল হাসান উৎস।। আমার বয়স তখন ১৪ বা ১৫ হবে। প্রচন্ড ধর্মভীরু ছিলাম। একটা ওয়াজে শুনলাম এক মোল্লা বলছে, ব্যবসায়ী নারীর স্বামী জাহান্নামী।
আমি কথাটা শুনে আঁতকে উঠলাম। কারণ আমার মা একজন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। যদি এখন আমি সেখানে থাকতাম তাহলে ওয়াজকারী হুজুরকে বলতাম ব্যবসায়ী নারীর স্বামী যদি জাহান্নামী হয়, তাহলে মহানবীর স্ত্রী খাদিজাও তো ব্যবসায়ী ছিলেন। তাহলে?
সংখ্যাগরিষ্ঠ ধার্মিক মাত্রই উগ্র এবং নারীর অধিকারে অসচেতন। হোক সে মুসলমান, হোক সে হিন্দু। কোনো ধর্ম নারীবাদকে সমর্থন করে বলে মনে হয় না। কারণ ধর্মগুলোর সৃষ্টিই হয়েছে নারীকে দমন করতে। একজন ধার্মিক ব্যক্তিও নারীবাদী হতে পারে, এমনটা অনেক শুনেছি। তবে এটা কীভাবে সম্ভব তা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে চক্রাকার যুক্তি আর অপযুক্তির সৃষ্টি হয়। নারীবাদী তত্ত্বের আলোচ্য বিষয়গুলো হচ্ছে – লৈঙ্গিক বৈষম্যের অবসান, ব্যবসা, শিক্ষা, রাজনীতি, নারী পুরুষের সমান মজুরি ইত্যাদি। নারীর ব্যবসা, রাজনীতি, শিক্ষাকে প্রচলিত ধর্মগুলো স্বাভাবিক হিসেবে মনে করে না অথবা মনে করতে চায় না। আবার অধার্মিক বা নাস্তিক মাত্রই যে নারীবাদী এবং নারীর অধিকারে সচেতন, এমনটাও নয়। একজন নাস্তিকও নারীবাদবিরোধী হতে পারে। নাস্তিক হলেই যে নারীবাদকে সাপোর্ট করবে এমনটাও নয়৷
আমি ব্যাক্তিগতভাবে নারীবাদ ছাড়া মানবতাবাদকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করি। নারীবাদ মূলত মানবতাবাদের বৃহৎ একটি জায়গা। নারীবাদের সংজ্ঞা মানবতাবাদের সাথে জড়িত। নারীবাদকে ঠেলে দিয়ে অন্তত মানবতাবাদকে কায়েম করা যায় না। নারীবাদী তত্ত্ব যেমনটা নারীবাদকে বর্ধিত করছে, তেমনটা মানবতাবাদকেও বর্ধিত করছে৷
একটি বিষয় না বললেই নয়, আমার প্রাক্তন আমাকে বেশ কিছুদিন আগে বলেছে তোমরা সব পুরুষেরাই এক। এই বিষয়টি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নারীবাদ পিতৃতন্ত্র, লিঙ্গ বৈষম্য, নিপীড়নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শুধু নারীদের কল্যাণে নয়। আমরা পুরুষরাও সহযোদ্ধা। অনুভূতিহীন মানসিকতার নিকৃষ্ট যুক্তি দিয়ে অন্তত নারীবাদকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। যুক্তি তর্কেও মাঝে মধ্যে আবেগের প্রয়োজন আছে। ধার্মিকদের মতো ধর্মহীনরাও মাঝেমধ্যে লজিক্যাল ফ্যালাসি করে বসে। সনাতনী নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নারীদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। তারাও পুরুষদের সমান এবং অনেকক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়েও বেশি। একজন নারী মা হয়, পুরুষদের অনূভুতি একজন মায়ের মতো তীক্ষ্ণ হতে পারে না। একজন পুরুষ যা পারে, নারীও তা পারে। কিন্তু একজন নারী যা পারে, একজন পুরুষ তা পারে না। প্রকৃতি যখন নারীদের আলাদা করে সন্মানিত করেছে সেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অধিকার নেই নারীকে ঘরে বস্তাবন্দি করার, নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক মতামত চাপিয়ে দেবার।
বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলো। প্রাণের বিকাশের নানান ধাপের পর নিয়ান্ডারথাল থেকে যখন হোমোস্যাপিয়েন্স সৃষ্টি হলো, তখন জ্ঞান বিজ্ঞান এগিয়ে যেতে থাকলো। মানুষ আগুন জ্বালতে শিখলো। গাছের খোলস পর্বের পর বিজ্ঞান আরও উন্নত হয়ে তৈরি হলো পোশাক। এরপর একসময় ধর্মগুলো আসতে লাগলো। পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নারী সবার কাছে ভোগপ্রবণতার বস্তু হলো। পোশাকে বস্তাবন্দি করে দেয়া হলো নারীকে। পুরুষের সামনে দূরে থাক, নারীর সামনেও নারী যেতে পারলো না। বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী গ্রন্থে এমন অনেক ব্যাঙ্গাত্মক গল্প আছে। একজন নারী পরনারীর সামনে যেতেও কুণ্ঠা বোধ করতো।
অবরোধবাসিনী গ্রন্থের একটা গল্প মূলত এরকম – পাটনায় এক বড় বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে মহিলারা আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। সবাই উপস্থিত হলেও হাশমত বেগমকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অনেকেই ভাবলেন তিনি হয়ত আসেননি। পরে দেখা গেলো ভিড়ের মধ্যে পাল্কির সওয়ারী ভেবেছিল হাশমত বেগম নেমে গিয়েছেন। তাই পাল্কি অন্যত্র রাখা হল এবং হাশমত বেগম সারারাত পাল্কিতে বসে রইলেন একটু শব্দ করা ছাড়াও। কেননা পুরুষেরা তার গলার আওয়াজ শুনতে পাবে!
যাই হোক, মূলত ধর্ম এবং পুরুষতান্ত্রিক প্রকোপ থেকে নারীকে স্বাধীন হতে হবে। নারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, লেখক সব হবে। এমন কি পুরুষেরাও যেটি পারবে না, নারী সেটিও করবে।
নারী শুধু নারী নয়, নারী মানুষ হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]