নারীর অর্গ্যাজম: লজ্জা বা মিথ্যে নয়, জানুন এর সবটুকু
রাজনীন ফারজানা।। জনপ্রিয় রোমান্টিক কমেডি দ্য আগলি ট্রুথের শেষ দৃশ্যে নায়িকা অ্যাবি যখন শারীরিক সম্পর্কের পর শীৎকারে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তখন নায়ক মাইক চ্যাডওয়ে প্রথমে খুশি হলেও পরে জিজ্ঞাসা করে তার অর্গ্যাজমটা অভিনয় ছিল কিনা। অ্যাবি রহস্য করে উত্তর দেয়, ইউ নেভার নো! অর্থাৎ তুমি কখনোই সত্যটা বুঝতে পারবে না। নারীর অর্গ্যাজম এমনই একটি রহস্যময় ব্যাপার।
এই যে নারীর অর্গ্যাজম- এটা কি এমনই ক্ষতিকর যে একে উচ্চারণ করা মানা! এর রহস্যই বা কী? আসুন জেনে নেই অর্গ্যাজম কী ও কীভাবে ঘটে।
অর্গ্যাজমের আভিধানিক বাংলা অর্থ চরম উত্তেজনা। যৌনমিলনের শেষ পর্বে চূড়ান্ত ভালোলাগার মুহুর্ত। ইংরেজিতে একে ক্লাইম্যাক্সও বলে। নারী-পুরুষ উভয়েই এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলেও দেখা যায় নারীর অর্গ্যাজমের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যায়। আলোচনা তো দূরের কথা, সঙ্গীর সামনেও নারী নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগার বিষয়টি প্রকাশ পর্যন্ত করে না। আর নারীর ফেইক অর্গ্যাজম অর্থাৎ মিথ্যা মিথ্যা অর্গ্যাজমের অভিনয় নিয়েও আছে নানা কথা।
আসলে অর্গ্যাজম বিষয়টি শুধু শারীরিক নয়, এটি মানসিকও। যৌনমিলনে সেক্সুয়াল স্টিমুলেশনের সময় এন্ডরফিনস নামক এক ধরণের হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। এটিই চরম সুখের অনুভূতি তৈরি করে যা অর্গ্যাজম নামে পরিচিত।
মজার বিষয় হল, অধিকাংশ মানুষ মনে করে যৌনতা থেকে সুখপ্রাপ্তি শুধুই পুরুষের আর নারীর কাজ শুধুই পুরুষের সুখের যোগান দেওয়া। কিন্তু আসলে তা নয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অর্গ্যাজম ঘটে। সাধারণভাবে আমরা মনে করি পুরুষের বীর্যপাত হয়ে যাওয়ার মানেই অর্গ্যাজম হয়ে যাওয়া। কিন্তু বিষয়টি তা না। অনেকের খুব দ্রুত বীর্যপাত হতে পারে। ফলে সে অর্গ্যাজম অর্থাৎ চূড়ান্ত আনন্দ নাও পেতে পারেন। আবার পুরুষের ক্ষেত্রে বীর্যপাতের ফলে গর্ভধারণের যোগসূত্র থাকায় বীর্যপাতের ফলেও অর্গ্যাজম লাভ করতে পারেন।
নারীর ক্ষেত্রে শারীরিক সুখের চেয়েও মানসিক পরিতৃপ্তি অনেক বেশি জরুরি। ফলে নারীর অর্গ্যাজমের সময়ও পুরুষের তুলনায় বেশি লাগে।
নারীর অর্গ্যাজম পুরষের চেয়ে আলাদা কারণ, এর সঙ্গে কোন পারপাজ বা লক্ষ্য জড়িত নয়। এর সঙ্গে ডিম্বস্ফোটন বা সন্তান জন্মধারণেরও কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু যেহেতু সুখলাভের বিষয়টি জড়িত তাই অনেক সমাজেই নারীর অর্গ্যাজমকে ‘খারাপ’ বিবেচনা করা হয়।
আর আমাদের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে নারীর যৌনসুখ যেন নিষিদ্ধ কামনা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা যেন যৌন সুখ লাভ না করতে পারে তাই তাদের যৌনাঙ্গের একটা অংশ (ক্লিটোরিস) কেটে ফেলে। একে নারীর খৎনা বলা হয়।
এদিকে নারীর অর্গ্যাজম নিয়ে তেমন কোন বিশদ গবেষণা বা জানাশোনাও নাই। এর কারণ হিসেবে অনেকে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত বিজ্ঞানকে দায়ী করেন। সঠিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার অভাবে এটি নিয়ে সারা বিশ্বেই নানারকম বিভ্রান্তি ও কুসংস্কার বিদ্যমান।
নারীর অর্গ্যাজম লাভ করতে একজন পুরুষ সঙ্গীই লাগবে তা না। নিজে নিজে মাস্টারবেশন অথবা সঙ্গির সঙ্গে যৌনমিলন- যে কোন ভাবেই নারী এই অনুভূতি পেতে পারে।
অর্গ্যাজম কীভাবে ঘটে
যৌন মিলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছালে নারী ও পুরুষ উভয়ের যৌনাঙ্গের চারপাশে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। ফলে এই অঙ্গগুলো সেই মুহুর্তে দারুণ অনুভূতিপ্রবণ হয়ে ওঠে। উত্তেজনা বাড়তে থাকলে মানুষের হৃদকম্পন, রক্তচাপ এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। অর্গ্যাজমের কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌঁছাতে জননাঙ্গের চারপাশের পেশিতে খিঁচুনি বা টান পড়ে। অনেক নারী আবার অর্গ্যাজমের সময় তাদের যোনিতে ছন্দোবদ্ধভাবে এই খিঁচুনি অনুভব করতে পারেন।
চলুন বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত অর্গ্যাজমের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে জেনে নেই-
– এক্সাইটমেন্ট (উত্তেজনা), অ্যারাউজাল বা শেষ মুহুর্তের উত্তেজনার পর্যায় তৈরি হওয়া
– প্ল্যাটু (মালভূমি), যেসময়ে অ্যারাউজাল বাড়তে বাড়তে সমতলে বা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে
– অর্গ্যাজম, চরম সুখানুভূতির মুহুর্ত
– রিজোল্যুশন, যখন অ্যারাউজাল হ্রাস পেয়ে স্থিতাবস্থা আসে
অনেক নারীই এই রেজোল্যুশন পর্যায়ে এসে আবারও একাধিক অর্গ্যাজমের স্বাদ লাভ করতে পারেন। অন্যদিকে পুরুষের সাধারণত আরও একটি অর্গ্যাজমের জন্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম প্রয়োজন হয়।
অর্গ্যাজমের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
ইন্টারনেটে অর্গ্যাজমের উপকারিতা নিয়ে নানারকম তথ্য পাওয়া যায়। যেমন এর ফলে নারীর চুল, ত্বক ও স্বাস্থ্য ভালো করার কথা বলা হলেও সেগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই খুব একটা। কিন্তু অর্গ্যাজম যে আনন্দ দেয় তা নিশ্চিত। আর আনন্দলাভই দারুণ উপকারি। এতে একজন ব্যক্তির মন ভালো থাকে, স্ট্রেস দূর হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে ও সঙ্গির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখে।
এমনকি যদিও বলা হয় সন্তান ধারণের সঙ্গে নারীর অর্গ্যাজমের সম্পর্ক নাই কিন্তু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে নারীদেহে অর্গ্যাজমের পর শুক্রাণু ধরে রাখার সক্ষমতা বাড়ে।
অর্গ্যাজম নিয়ে নানারকম ভ্রান্ত ধারণাও সমাজে বিদ্যমান। সেগুলো নিয়ে নিচে আলোচনা করা হল-
অর্গ্যাজম হয় না যে নারীর তার মানসিক সমস্যা আছে!
এটা সত্যি যে ট্রমা, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য অর্গ্যাজমের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু অনেক সুস্থ শরীর ও মনের অধিকারীরও অর্গ্যাজমে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অর্গ্যাজম শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া। তাই নানারকম অসুখবিসুখের ফলে এটি নাও হতে পারে।
কারও কারও ক্ষেত্রে শুকনো যোনিপথের কারণে অর্গ্যাজম ঘটে না। এর ফলে অনেক নারী যৌনমিলনের সময় ব্যাথাও পান।
পেনিট্রেটিভ সেক্স অর্থাৎ যোনিতে কিছু প্রবেশের মাধ্যমে অর্গ্যাজম লাভ হয়!
এটিও ভ্রান্ত ধারণা। এমনকি সিগমুন্ড ফ্রয়েড ভ্যাজাইনাল অর্গ্যাজমকে সুপিরিয়র বা উচ্চ মাত্রার দাবি করলেও এটি প্রমাণিত সত্য নয়। বরং সত্য এই যে, কিছু কিছু নারী বরং যোনি নয়, শুধুমাত্র ক্লিটোরিস বা ভগাঙ্কুরের মাধ্যমে যৌনসুখ লাভ করে থাকেন।
নারীরা যৌনাঙ্গের মাধ্যমে অর্গ্যাজম লাভ করতে পারেন না!
এটি কখনোই সব নারীর ক্ষেত্রে সত্য নয়। তবে অনেকের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। নারীদেহে যোনিপথ, ভগাঙ্কুর অথবা স্তনবৃন্তের মাধ্যমেও অর্গ্যাজম হতে পারে। সবার জন্য একই পদ্ধতি বা অঙ্গ কাজ করবে, তা না।
শুধুমাত্র ভালোবাসার মানুষের সঙ্গেই নারীদের অর্গ্যাজম লাভ হয়!
অর্গ্যাজম অত্যন্ত জটিল মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া। অনেক নারী ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে যৌনমিলনে তৃপ্তি পেলেও অনেকে তা নাও পেতে পারেন। অর্গ্যাজমের সঙ্গে নারী ও পুরুষের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে ৮৬ শতাংশ লেসবিয়ান (নারী সঙ্গী যার) নারী যৌনমিলনের সময় অর্গ্যাজমের স্বাদ পান। অন্যদিকে ৬৬ শতাংশ বাই সেক্সুয়াল (নারী ও পুরুষ উভয়ের সঙ্গী) নারী ও ৬৫ শতাংশ হেটেরুসেক্সুয়াল (পুরুষ সঙ্গী যার) এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
অর্গ্যাজম লাভ না করলে কী হয়?
অনেকেই যৌনমিলনের দ্বারা সঠিকভাবে উদ্দীপিত হলেও, অনেকের জন্যই যৌনমিলন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। কারও কারও এই বিষয়ে একদমই আগ্রহ নাও থাকতে পারে। অর্গ্যাজম অর্থাৎ যৌনসুখ অর্জন না হওয়ার কারণ-
সম্পর্কের সমস্যা, স্ট্রেস, মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা বা দুর্বল মানসিক অবস্থা, গর্ভপাতের ইতিহাস, নারীর খৎনা, যৌন নির্যাতনের ইতিহাস, যৌনতা বিষয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক চিন্তাভাবনা ও কুসংস্কার ইত্যাদি।
আবার সুস্থ যৌনতার বিকাশে সাহায্য করতে পারে যে অভ্যাসগুলো তা হল- নিয়মিত ব্যায়াম, সঙ্গীর প্রতি প্রতিনিয়ত ভালোবাসা প্রদর্শন, নিজের শরীর নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব, যৌনতা সম্বন্ধীয় জ্ঞান, সঙ্গীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ বা খোলামেলা আলোচনা।
আপনার সুখানুভূতি কীসে আসবে সেটা আপনার থেকে ভালো কেউ বলতে পারবে না। নিজের শরীরকে চিনতে ও বুঝতে হবে। এই চিন্তা কখনোই করবেন না যে আপনার সঙ্গী বুঝে নেবে কীসে আপনার সুখ। এতে লজ্জা বা ভয়ের কিছু নেই। নিজের শরীরকে জানুন, বুঝুন আপনার চাহিদা এবং সঙ্গীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন। সুস্থ যৌনতা সুন্দর ও সুখী জীবনের পাথেয়।