November 24, 2024
সাহিত্যফিচার ৩বই নিয়ে আলাপ

পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর

শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর তৃতীয় পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।

[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন। 

শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র‌্যাচেল লামসডেন,  জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র‌্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]

মিরিয়াম শাপিরো (১৯২৩ – ২০১৫)

১৯৭২ সালে আটাশ জন শিল্পীর একটি দল – যে দলে সবাই ছিলেন নারী- হলিউডের একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে তাঁদের কিছু কাজ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে ‘উ্যম্যান হাউস’ বা ‘নারীবাড়ি’ প্রতিষ্ঠা করেন। আর সেটা ছিল নারীবাদী শিল্প ইতিহাসে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীগুলোর একটি।

এই প্রদর্শনীটির উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে লস এঞ্জেলেসের ক্যালআর্টস (CalArts, California Institute of the Arts)-এ মিরিয়াম শাপিরো, জুডি শিকাগো এবং পঅলা হারপার পরিচালিত আদি ‘ফেমিনিস্ট আর্ট প্রোগ্রাম’-এ।

শাপিরোর ভাষ্য অনুযায়ী, “শিল্পসৃষ্টির বিষয়বস্তু হিসেবে যথাযথ ব’লে বিবেচিত হওয়ার কিছু মজার অলিখিত বিধি রয়েছে। আমাদের ফার্স্ট ক্লাস প্রজেক্ট ‘উ্যম্যান হাউস’ এসব বিধি উল্টে দিয়েছিল। আগে যেসব জিনিস তুচ্ছ বা মামুলি ব’লে গণ্য করা হতো, সেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসৃষ্টির পরযায়ে উন্নীত করা হলো: পুতুল, বালিশ, প্রসাধনী, স্যানিটারি ন্যাপকিন, রেশমী মোজা, অন্তর্বাস, শিশুদের খেলনা, ওয়াশবেসিন, টোস্টার, কড়াই, ফ্রিজের দরজার হাতল, শাওয়ার ক্যাপ, লেপ এবং সাটিনের বিছানার-চাদর।”

‘উ্যম্যান হাউস’ প্রদর্শনীর জন্য শেরি ব্রডির সঙ্গে মিরিয়াম শাপিরো যৌথভাবে একটি পুতুল-বাড়ি তৈরি করেছিলেন। একজন নারী হওয়ার জটিলতার দিকে ইঙ্গিত করার জন্য সেখানে ছিল পরস্পর বৈসাদৃশ্যপূর্ণ কিছু কামরা: মা, প্রেমিক, শিশুপালনকারী আয়া, পরিচ্ছন্নকর্মী, শিল্পী। সেটার সামনের অংশটার ভাঁজ খুলে ধরলে গার্হস্থ্য জীবনের প্রাইভেট-পাবলিক-এর জটিল ভূমিকা নজরে আসে, যে-ভূমিকা আমাদের দৃষ্টির (এবং ইতিহাসের) আড়ালে থাকে, কিন্তু যা আবার একই সঙ্গে ঐতিহ্য আর প্রত্যাশার একটি স্থান যে ঐতিহ্য এবং প্রত্যাশা সাংকেতিকভাবে আমাদের সামনে বিদ্যমান।

 

চিত্র পরিচিতি 

ডলহাউস , ১৯৭২

কাঠ ও মিশ্র মাধ্যম

২০৮.৩ X ২০২.৬ সে. মি.

 

আনা মেনদিয়েতা (১৯৪৮-৮৫)

১৯৭০-এর দশকে অনেক নারী শিল্পীই তাঁদের দেহকে শিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু খুব কম শিল্পীই আনা মেনদিয়েতার মতো এমন মানসিক আবেগ-জাগানো প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রীর জন্য পড়ার সময়ে তিনি একটি বিচিত্র উপায়ে তাঁর একজন সহপাঠীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন: তিনি জনসমক্ষে সেই অপরাধমূলক ঘটনার পুনর্দৃশ্যায়ন করেছিলেন। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে তিনি তৈজসপত্র ভাংচুর ক’রে তাঁর লিভিং রুমটাকে মঞ্চের মতো আলোকিত করেন। লোকজন তাঁর পারফর্মেন্স দেখতে এসে তাঁকে একটা টেবিলের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করল। দেখা গেল তাঁর শরীর কোমরের নীচ থেকে নগ্ন এবং রক্তরঞ্জিত। পরে স্মৃতিচারণ ক’রে তিনি বলেছেন, “সবাই ব’সে প’ড়ে এটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। আমি একটুও নড়িনি। সেখানেই প্রায় একঘণ্টা সেই অবস্থাতে ছিলাম। তারা আসলেই একটা ধাক্কা খেয়েছিল।”

মেনদিয়েতা ফ্লাক্সাস (Fluxus) এবং ভিয়েনার অ্যাকশনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ভিয়েনার অ্যাকশনিস্টদের মত তিনি প্রত্যেক দর্শকের ভাবাবেগের একেবারে কেন্দ্রস্থলের সঙ্গে যোগাযোগের একটি পদ্ধতি হিসেবে রক্ত আর রিচুয়াল ব্যবহারের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটিকে শারীরিকভাবে পুনঃর্নিমাণের মধ্যে দিয়ে তিনি খুব শক্তিশালীভাবে সেই আক্রমণটির পাশবিকতা তথা বিচার-বুদ্ধিহীনতাকে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।

 

চিত্র পরিচিতি 

আনটাইটেলড (রেইপ সিন) ১৯৭৩

রঙীন আলোকচিত্র

২৫.৪ X ২০.৩ সে. মি.

 

(চলবে)

আরও পড়ুন-

পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা

পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা