November 23, 2024
নারীবাদ আলোচনাসাহিত্যফিচার ৩

লিবারাল ফেমিনিজম: নিজের পছন্দে জীবন বেছে নেবার অধিকার

নারীবাদ: বোঝা ও বোঝাপড়া (পর্ব-০৬)

শারমিন শামস্।।

আঠারো ও উনিশ শতকে পশ্চিমে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, জন স্টুয়ার্ড মিল, হেরিওট টেইলর, সুসান বি অ্যান্থনি, এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটনরা যে নারীবাদের চর্চা করেছিলেন, সেটিই উদার নারীবাদ (Liberal Feminism)। বিশ শতকে এর ধারা বহন করেছেন বেটি ফ্রিডান, রেবেকা ওয়াকার, নাউমি ওলফ প্রমুখ।

লিবারাল ফেমিনিজম বা উদার নারীবাদের মূল দর্শন হল, নিজের পছন্দমত জীবন বেছে নেবার অধিকার নারীর আছে এবং নিজের কাজের মধ্য দিয়েই নারীকে লৈঙ্গিক সমতার জায়গাটি আদায় করে নিতে হবে। কারণ নারী একজন পূর্ণ মানুষ এবং লিঙ্গগত কারণে কোনভাবেই পুরুষের চেয়ে কম নয়। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ভাষায়- “the mind has no gender”।

শুরুর দিকে উদার নারীবাদের মূল লক্ষ্য ছিল নারীর ভোটাধিকার, কেননা তারা মনে করতেন, এটি ঘটলেই নারী ব্যক্তিজীবনেও স্বাধীনতার স্বাদ পাবে। সব ক্ষেত্রে সমতা, নারীর প্রতি পুরুষের নিষ্ঠুর আচরণের অবসান এবং একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকবার জন্য প্রতিটি নারীকে সব ধরণের অধিকার ও সুবিধা দিতে হবে- এটিই ছিল উদার নারীবাদীদের দাবি।

উদার নারীবাদ ব্যাক্তিগতভাবে স্বাধীনতা অর্জনে বিশ্বাসী, সমষ্ঠিগতভাবে নয়। এই সমষ্ঠিগত এবং ব্যাক্তিগত অর্জনের ধারণার জায়গাটিতে এসেই উদার ও মার্ক্সীয় নারীবাদ পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। এমনকি র‌্যাডিকেল ফেমিনিজম বা আমূল সংস্কারবাদী নারীবাদের সাথেও এর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। মুক্তি বা স্বাধীনতার সংজ্ঞার মধ্যে চিন্তাগত পার্থক্যের কারণেই এই মতদ্বৈততা।

উদার নারীবাদীরা মনে করেন, সমতা আদায়ের ক্ষমতা নারীরই আছে। তাই সমাজের কাঠামো পুরোপুরি না পাল্টেও নিজের ব্যক্তিগত সক্ষমতা দিয়েই নারী পুরুষের সমান অধিকার অর্জন করে নিতে পারে। নারী পুরুষের চেয়ে শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কম, এই ধারণাটির বিরুদ্ধে সোচ্চার উদার নারীবাদীরা। তারা মনে করেন, এই মান্ধাত্ত্বা চিন্তাভাবনাগুলোই নারী পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আইনগত ও রাজনৈতিক সংশোধন আনার কথাও বলেন তারা, বিশেষ করে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে।

উদার নারীবাদ  সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে নারীর নিজের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার দাবি করে। এর সাথে গর্ভপাতের অধিকারও সম্পৃক্ত। এসবের পাশাপশি উদার নারীবাদ নারীর ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার, সমান কাজের জন্য সমান মজুরি, সন্তান লালন পালন, স্বাস্থ্যসেবার অধিকার এবং যৌন হয়রানি ইত্যাদির ওপর গুরত্ব দেবার কথা বলে। উদার নারীবাদীরা মনে করেন, ঘরের ভেতরে প্রতিনিয়ত যে নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি হয়, তা প্রকাশ্যে নিয়ে আসা জরুরি।

উদার নারীবাদ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে, যার শুরুটা ছিল classical liberal thought দিয়ে, যার মূল কথাই ছিল সেই ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র ও নিজের পছন্দনুযায়ী জীবন কাটানোর ইচ্ছা। বিশ শতকে এসে classical liberal tradition নানামুখী চিন্তায় বিভক্ত হয়েছে। সমসাময়িক নারীবাদের উত্থান হয় আমেরিকায়, ১৯৬০ সালে, যখন বেটি ফ্রিডান লেখেন তার বিখ্যাত নারীবাদি গ্রন্থ “the feminine mystique। ১৯৬৬ সালে National Organization for Women গঠন করা হয় বেটি ফ্রিডানকে সভাপতি করে, এটি উদার নারীবাদের প্রধান সংগঠনে পরিনত হয়। শুরুতে এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল সমান অধিকার আদায়ে সংশোধনী (Equal Rights Amendment-ERA)  আনতে বাধ্য করা। গোঁড়ার দিকে তাদের মধ্যে নারীর সন্তান জন্মদান, গর্ভপাত এবং সমকামিতা নিয়ে আওয়াজ তুলতে কিছুটা ইতস্তত ভাব ছিল।  তারা ভাবছিলেন, যদি তখনই তারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন তাহলে হয়তো সমান অধিকার সংক্রান্ত সংশোধনীর বিষয়গুলো হয়তো গুরুত্ব হারাবে। নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট তর্ক বিতর্ক চলতে থাকে। অবশেষে নারীর গর্ভধারণ ও সমকামিতা নিয়ে আওয়াজ তুলতে চাওয়া দলটিই তর্কে জেতেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সমঅধিকার সংক্রান্ত সংশোধনী নিয়ে দীর্ঘ লড়াই ব্যর্থ হয়, অর্থাৎ আমেরিকায় সে সময়ের উদার নারীবাদের সংগ্রাম তার মূল লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারেনি।

১৯৭২ সালে গ্লোরিয়া স্টিনেমের নেতৃত্বে বের হয় Ms. নামে একটি পত্রিকা, যা দ্বিতীয় তরঙ্গে উদার নারীবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

উদার নারীবাদীদের নিজেদের মধ্যেও চিন্তাগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন কেউ কেউ বলেন ব্যক্তিগত স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা। মানে নারী নিজের জীবনের মালিক নিজেই হবে। নিজের পছন্দমত জীবনাচরণ বেছে নেবে।  আবার কেউ চান রাজনৈতিক স্বায়ত্ত্বশাসন। এদের মধ্যে আবার কেউ বলছেন, রাষ্ট্র এমন একটি সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করবে যেন প্রতিটি নারীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়, যাতে পুরুষও সমর্থণ দেবে। আরেক দল মনে করেন, নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে জনগনের আস্থা, অংশগ্রহণ এবং নারীর সমান হারে অন্তর্ভূক্তি থাকলেই গনতন্ত্র বৈধতা পায়।

নারীবাদের একেবারে গোঁড়ার দিকের বলেই হয়তো উদার নারীবাদকে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। বলা যায়, বাকি সব নারীবাদ তত্ত্বই শুরু হয়েছে উদার নারীবাদের সমালোচনা করে। অস্পষ্টতা, লক্ষ্যহীনতা, অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি নানা সমালোচনা সইতে হয়েছে। অনেকে বলছেন, উদার নারীবাদই যথেষ্ঠ উদার নয়। এর ভেতরের জটিলতার কথাও উল্লেখ করেন কেউ কেউ। সবচেয়ে বড় যে সমালোচনা সেটি হল, উদার নারীবাদ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যাক্তিগতভাবে সমতা অর্জনের কথা বলে, যার ফলে সামাজিক যেসব রীতি, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নারীর জীবনকে দূর্বিসহ করে তোলে, তা চিহ্নিত করা কঠিন হয় এবং এসব দূর না করে আসলে ব্যাক্তি পর্যায়ে অধিকার আদায়ও অসম্ভব। এমনকি কোন নারী যদি কোন পুরুষের ওপর নির্ভরশীল নাও হন, তবু তাকে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হয়।

দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদি বেল হুকস লিবারাল ফেমিনিজমের সমালোচনা করেছেন যে, উদার নারীবাদীরা নিজেদের শ্রেণির ভেতরেই পুরুষের সাথে সমতা আদায়ে অতিরিক্ত মনোযোগী থাকেন। তিনি আরো বলেন, এক একটি গোত্র বা দলের নিজস্ব সাংস্কৃতিক যে ভিত্তি থাকে, সেটিই নারীর বঞ্চনার মূল কারণ। সেটাকেও অবহেলা করে গেছেন উদার নারীবাদীরা।

আবার ব্ল্যাক ফেমিনিস্ট ও পোস্ট কলোনিয়াল ফেমিনিস্টরা উদার নারীবাদের সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, উদার নারীবাদ কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণির মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং হিটারোসেক্সুয়াল ও শ্বেতাঙ্গ নারীদের অবস্থার দিকেই নজর রেখেছে। তাদের দৃষ্টি পড়েনি অন্য শ্রেণি, গোত্র ও সংস্কৃতির নারীদের প্রতি। সমসাময়িক নারীবাদীদের অনেকেই এসব সমালোচনার জবাব দেবার চেষ্টা করেছেন।

নারীবাদের একেবারে উত্থানের মুহুর্তে উদার নারীবাদের জন্ম হলেও এখনো এই নারীবাদের চর্চা প্রাসঙ্গিক এবং নানা সমালোচনার পরেও উদার নারীবাদের মূল দর্শনটির যথাযথ প্রয়োগের কার্যকারিতা নানাভাবে প্রমাণিত। উদাহরণ হিসেবে আমরা বাংলাদেশের কথাই বলতে পারি। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো, অধিকাংশ জনগনের মানসিকতা, আইনের প্রয়োগ ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দিলে দেখতে পাই, পুরো পরিস্থিতিই নারীর জন্য কঠিন এবং মাথা তুলে দাঁড়ানোর পথ জটিল ও দুর্বিসহ। তবুও মেয়েরা পড়ালেখা করছে, কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছে, পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস বা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রধান উৎসে পরিনত হচ্ছে। বলা যায় কুসংস্কারচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ ও অনেকার্থে নারীবিদ্বেষী এক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নারী নিজের অস্তিত্বের লড়াই  চালিয়ে যাচ্ছে। এই লড়াই আসলে যতটা না সমষ্ঠিগতভাবে হচ্ছে, তার চেয়ে বরং বলা ভাল ব্যক্তিগত লড়াইগুলো একত্রিত হয়ে একটি সামগ্রিক চিত্র দাঁড় করাচ্ছে।

উদার নারীবাদ যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের কথা বলে, সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বা নিজের পছন্দানুযায়ী জীবনযাপনের প্রতি নারীর ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের যে লড়াই, তা এই দেশে এখনো অসম্পূর্ণ বা বলা যায় সেই লড়াই আদতে শুরুই হয়নি সে অর্থে। হ্যাঁ, নারী এগিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন, যৌনজীবন কিংবা গর্ভধারণের ইচ্ছা অনিচ্ছা এখনো পরিবার ও সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখনো নিজস্ব সিদ্ধান্তের জন্য নারীকে চরম মূল্য দিতে হয়। আবার রাজনৈতিক যে স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা উল্লেখ আছে, সেটির দিকে নজর ফেরালে দেখবো, একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ভেতর নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, ক্ষমতাকাঠামোর ভেতর প্রবেশ করতে ও স্থায়ী হতে এবং সেটির বৈধতা ধরে রাখতে, জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ এই নারীর প্রতি মনোযোগ দিতেই হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন আসছে, নারীর চলার উপযোগী পরিবেশ কিছুটা হলেও তৈরি হচ্ছে।

আবার সেই আঠারো ও উনিশ শতকে উদার নারীবাদীরা বলেছিলেন, নারীর প্রতি শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। আজ চতুর্থ তরঙ্গে নারীবাদ যে হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে চাইছে, সেটির সাথে এর চমৎকার সম্পৃক্ততা আছে।

প্রকৃত অর্থে নারীর স্বাধীনতা, সমতা ও ক্ষমতায়ন হবে তখন, যখন সমাজের সেক্সিষ্ট (sexist) মানসিকতাকে দূর করা সম্ভব হবে এবং উৎপাদনে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। উদার নারীবাদের যে লক্ষ্য- নারীর কর্মসংস্থান ও গর্ভধারণ বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আদায়- রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া সেটি অর্জন সম্ভব নয়। তাই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনের কথা বললেও প্রকৃত অর্থে উদার নারীবাদও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও সমষ্ঠিগত পরিবর্তনের কথাই বলে। আসলে যে তত্ত্বীয় চর্চার মধ্য দিয়েই আসুক না কেন, নারীবাদ মানেই বদলে দেবার যাত্রা। সেই বদলটা বহুমুখী ও প্রতিটি বদল একে অপরের পরিপূরক।

(চলবে)

পর্ব-১: নারীবাদ ও পিতৃতন্ত্র: বোঝাপড়ার শুরু

পর্ব ২: নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ, ভোটের অধিকার ও স্বপ্নদ্রষ্টা মেরি

পর্ব ৩: সাহসী মেরি, পুরুষতান্ত্রিক গোঁয়ার রুশো ও ফেমিনিন ফিলোসফার মিল

পর্ব-৪: ‘পুরুষের মতই পেশি আমার আছে, তাদের সমান কাজ করতে পারি’

পর্ব-৫: শ্রমিকের লড়াই, মার্ক্সীয় নারীবাদ ও অন্যান্য