September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে রুদ্ধ সহনশীলতা

লিহান লিমা।। স্লিভলেস পোশাক দেখলে আপনার গা গুলিয়ে ওঠে? টাইট জিন্স আর টি শার্ট পরা মেয়ে দেখলে মনের অজান্তে আপনি বলে ওঠেন, ‘তোরা যৌন নিপীড়নের শিকার হবি না তো কে হবে?’ কোনো মেয়ের গায়ে ওড়না না থাকলে আপনি পাশের বন্ধুটির সঙ্গে চোখ টেপাটেপি করেন? শর্টস পরা দেখলে আপনার ছোটখাট কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের র‌্যাগ ডে’র বর্ণিল উৎসব দেখে আপনার মুখ ফসকে বের হয়, ‘যতসব হিন্দুয়ানি কাজ-কারবার’। রমজান মাসে আপনি রোজা রাখছেন, আপনার সহকর্মী কিংবা বন্ধুকে দিনের বেলা কিছু খেতে দেখে আপনি বলেন, ‘এই রোজা-রমজানের দিন, লজ্জা শরম কিছু আছে?’ বৈশাখি মেলা আপনার কাছে শুধুই হিন্দুদের উৎসব। আপনার কাছে ঐতিহ্য মানে সৌদি আরব, আপনি বাংলাদেশে থেকে সৌদিতে ঘুমান, আরব আমিরাতে অজু করেন। আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই আপনি শ্রেষ্ঠ, যারা সংখ্যালঘু তারা সব অজাত?

আপনি যা করেন না, যাতে আপনার বিশ্বাস নেই, যা আপনি ভালোবাসেন না, যা আপনার মত নয় তা দেখলে আপনার রাগ হয়, আপনি কখনো তার নিন্দা করেন আবার কখনো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। আপনি ধরেই নিয়েছেন, এই বিশ্বের বাকি ৭শ ৪৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯শত মানুষ আপনার প্রতিবিম্বই হবে।

আপনি কি বর্ণবাদ, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ, বয়সবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদের কথা শুনেছেন? অন্যের মত, আচরণ, আদর্শ ও ব্যক্তিসত্ত্বাকে শ্রদ্ধা না করা এই আপনি এই সকল বিভাজনবাদই লালন করেন! আপনি সহনশীল নন। কিংবা সমাজে বিদ্যমান ঘৃণা, বিদ্বেষ, লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্ম-আর জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব আপনাকে সহনশীলতার শিক্ষা দিতে পারে নি। আপনি জানেন না কীভাবে অন্যকে সম্মান করতে হয়, অপরের কাছ থেকে শিখতে হয়, কীভাবে ভিন্নমতকে মূল্য দিতে হয়। কীভাবে সাংস্কৃতিক অভিন্নতার সেতু তৈরি করে সকল কুসংস্কারকে প্রত্যাখ্যান করতে হয়।

প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালে আমার এলাকায় এক খ্রিষ্টান পরিবার এসেছিলো। মুসলিম অধ্যুষিত প্রত্যন্ত অজপাড়া গাঁ হওয়াতে বরাবরের মতো তাদের নিয়ে এলাকার বড়দের উৎসাহের কমতি ছিলো না। সেই পরিবারের এক আপু ছিলেন ভীষণ সুন্দর। কমনীয় আর স্নিগ্ধ তার মুখ। আমি শ্রেণিকক্ষের বারান্দায় এক সহপাঠী কে বলছি, ‘আল্লা, আপুটা কি সুন্দর।’ অমনি পেছন থেকে এক শিক্ষক আমাকে ধমক দিয়ে বললেন ‘এই, ইহুদি খ্রিষ্টানদের সুন্দর বলতে হয় না।’ স্যারের এই মন্তব্যের পর আমি আর কখনোই তাকে মুখ ফুটে সুন্দর বলি নি। তবে তার সামনাসামনি পড়ার পর একবার বলেই ফেললাম, ‘আপনি অনেক সুন্দর।’ এরপর স্যারের কথা মনে হওয়াতে সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ে নিলাম।

বাল্যকালের সেই স্মৃতি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে বাংলাদেশের শতশত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় অজান্তেই বপন করা হচ্ছে ঘৃণার বীজ। এখনো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় বৈশাখি মেলা হারাম, মেলায় যায় হিন্দুরা কিংবা শহীদ মিনারে ফুল দেয়া মানে মূর্তিপূজা করা। মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা-ভাষা সৈনিক-ভাষা শহীদ বলে গলা ফাটানো নেতারা কি বলতে পারেন, বাংলাদেশের শতশত মাদ্রাসায় কেন শহীদ মিনার নেই? অসাম্প্রদায়িকতা, সমতা আর বৈচিত্রের গর্ব করা আমাদের নীতি নির্ধারকরা শিশুদের পাঠ্যপুস্তক কি একবার পড়ে দেখেছেন? তারা বলতে পারবেন কেনো প্রাইমারি স্কুলের ইংরেজি বইয়ের লেসনে ‘মাই মাদার ইজ অ্যা হাউজওয়াইফ, মাই ফাদার ইজ অ্যা টিচার’ লেখা হয়েছে? কেনো বইয়ের পাতার চিত্রে গৃহস্থালি কাজে শুধুই নারীর ছবি দিয়ে রাখা? আপনারা শিশুদের অসাম্প্রদায়িতকার শিক্ষা দিতে চান? তবে বাধ্যতামূলক করে দিন ‘নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ’ বই। যেখানে বাংলাদেশে বিদ্যমান সকল ধর্মের মানুষের জীবনাচরণ উল্লেখ করা থাকবে, শিশুরা সকল ধর্মের সম্পর্কে জানবে, অন্য ধর্মের, অন্য জাতের মানুষকে এলিয়েন কল্পনা করা থেকে বিরত থাকবে।

আর যারা বিভাজন, ঘৃণা, মূর্খতা আর বিদ্বেষের শিকার, যারা অপরের অসহিঞ্চুতার বলি হয়েছেন? সহনশীলতার অর্থ কি সব আচরণ গ্রহণ করা? অবশ্যই না। অপরকে অসম্মান করা, হেয় করা, বিদ্বেষ ও কুসংস্কার ছড়ানোর মতো আচরণ সহ্য করা উচিত নয়। সহনশীলতা মানে ব্যক্তি মানুষটাকে গ্রহণ করতে শেখা, তার খারাপ গুণাবলি নয়। সহনশীলতা মানে আপনি অন্যের কাছে যে ব্যবহার চান অন্যের সঙ্গেও আপনি তেমনই আচরণ করুন। শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে রুদ্ধ সহনশীলতাকে দ্বার মুক্ত করার দায়ভারও যে আপনারই।

ধর্মকে যেদিন রাজনীতির অন্যতম মূল অস্ত্র বানানো হয়েছিল, সেদিন থেকেই আমাদের নীতি নির্ধারকরা অত্যন্ত সংগোপনে এই শ্রেষ্ঠত্বের গর্ব, ঘৃণা আর বর্ণবাদের বীজ বাংলাদেশে বপন করে ফেলেছেন। এই বৃক্ষ তারা সহজে উপড়াতে পারবেন না। উপরন্তু এর ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে ভোটবাক্সের সন্তোষের হিসেব কষবেন। তাই বৃক্ষের ডাল-পালা কর্তনের ভার সমাজের সংখ্যালঘু কিছু মানুষের, যারা চিন্তা চেতনায় প্রগতিশীল, আধুনিক, উদার। মনে রাখবেন, যে দাসত্ব স্বীকারই করে না তাকে জোর করে কেউ খাটাতে পারে না। ব্যক্তির চিন্তার পরিবর্তন হয়ত পুরো দেশের পরিবর্তন আনবে না তবে নিজের পরিবারে পরিবর্তন অবশ্যই আনতে সক্ষম। আর পরিবার সমাজ বা দেশের বাইরে নয়।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]