November 24, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’

শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে।  সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা  হয়েছে “গুহান্তরাল”। আজ থেকে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হবে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর পঞ্চম পর্ব।।

মাদারীপুর যৌনপল্লীর গলির মুখে ঢুকতেই যে মেয়েগুলোকে দেখা গেল তারা বেশির ভাগই ১৮ বছরের নিচের বয়সী। এত নতুন নতুন ছোট ছোট মেয়েরা আসছে! কমিটিগুলো ঠিকমত কাজ করছে না মনে হচ্ছে। পাচারকারীদের সিন্ডিকেটের টিকিটি ছুঁতে পারছে না কেউ। যে জেলাগুলোতে যৌনপল্লী আছে, সব জায়গায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, থানা ও হাইওয়ে পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, পল্লীর সরদার্নী, বাবু, এলাকার লোকজন এদেরকে নিয়ে কমিটি আছে যেন অল্প বয়সী মেয়েকে যৌনপল্লীতে ঢুকতে দেওয়া না হয়। এরা সাধারনত পাচার হয়ে আসে। বিয়ে অথবা গার্মেন্টস বা গৃহকর্মীর কাজ, বিদেশে চাকরি ইত্যাদির প্রলোভনে বাড়ি থেকে বের হয় তারপর বিক্রি হয়ে যায়, ঠাঁই হয় যৌনপল্লীতে। খবর পেলেই পুলিশ আসবে এমন বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া আছে।  কিন্তু খুব কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে না। এই মেয়েদের মধ্যে কয়েকজন আছে যাদের এখানেই জন্ম। মেয়েরা কিছুটা খোলামেলা টাইপের কাপড় পরে আছে, সেমিজ-পায়জামা, স্লিভলেস গেঞ্জি-জিন্স। কিছু নারী শুধু ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে আছে। তবে বেশির ভাগ মেয়েরাই কড়া পাউডার, লিপিস্টিক আর কাজল লাগিয়ে আছে, তাতে মোটেও সুন্দর লাগছে না। সুরমা জানে এই আলগা প্রসাধনীর প্রলেপ ধুয়ে ফেললে প্রত্যেকেরই একটি মিষ্টি চেহারা আছে। তাহলে কেন এমন সাজে এরা? প্রসাধনীর আড়ালে ওদের কষ্টগুলোকে ঢেকে ফেলতে চায়? কিংবা মুখমণ্ডলের কোন অত্যাচারের চিহ্ন, আগের কাস্টমারের কামড় কিংবা খামচির দাগ?
সুরমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যতই এদের সাথে কাজ করছে ততই অসংখ্য প্রেক্ষিত, অসংখ্য প্রশ্ন, অপরাধবোধ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজাল তাকে  ঘিরে ধরছে।

সুরমা আর টুটুল দেবযানীর সাথে যৌনপল্লীর ভিতরে প্রজেক্ট অফিসে গিয়ে বসলো। তারা দুদিনের মনিটরিং ভিজিটে এসেছে। প্রকল্পের কাজকর্ম দেখবে, ভিতরে আরো যে এনজিওগুলো কাজ করে তাদের সাথে কথা বলবে, মেয়েদের সাথেও কথা বলবে। ওরা দেবযানীর সাথে বসলো গত এক বছরের ডাটা আর রিপোর্ট নিয়ে, ফিডব্যাকগুলো  আলোচনা করছিল, এমন সময় একটি মেয়ে এলো, দেবযানীকে জিজ্ঞেস করে, “ঢাকার আফার লগে কথা কইতে চাই। অহন কি কথা কওন যাইবো?” সুরমা ইশারায় ভিতরে এসে বসতে বলে মেয়েটাকে। ২০/২১ বছর হবে, সালোয়ার-কামিজের সাথে ওড়না জড়ানো, মুখে আলগা অত পাউডার নাই। সুরমাই কথা বলে, “কেমন আছেন?” মেয়েটা বিষন্ন হাসে, উত্তর দেয় না। সুরমা আবার জানতে চায়, “কি নাম আপনার?”

– কৃষ্ণা। অহন আপনে আমারে জিগাইবেন আমি হিন্দু কিনা। হ আমি হিন্দু।

– এখানে কতদিন আছেন কৃষ্ণা?

সুরমা জানতে চায়

– জন্ম থাইক্যা, আমি ৫ নম্বর, কৃষ্ণার নির্লিপ্ত উত্তর

– ৫ নম্বর মানে কি?

– মানে আমি এইখানে জন্মাইছি, আমার মায় জন্মাইছে, আমার নানী জন্মাইছে, আমার মায়ের নানী জন্মাইছে আর আমার নানীর নানী আইছে। তার মানে এইখানে আমি ৫ নম্বর বংশ।

সুরমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে! কৃষ্ণা বলে, আপা, দুই রাত চক্ষের পাতা এক করতে পারি  নাই। কইতে পারেন আমি কই যাবো? আপনারা তো শিক্ষিত মানুষ, দুনিয়াদারী চিনেন, নিয়ম কানুন জানেন। একটা বুদ্ধি দেন গো আফা, আমার সাথে দুইডা ছুডো বোন আছে আর মায় আছে।

সুরমা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেন করে, কেন? কোথায় যাবেন?

– ক্যান, আপনে জানেন না, ঐ যে হুজুরগো দল যে পল্লী তুইলা দিতে কইছে?

দেবযানী মাঝখানে কথা বলে, সুরমা আপা কেবল এসেছে, আজ আমরা এইসব নিয়ে কথা বলবো।

কৃষ্ণা, আপনি কি জানেন খুলে বলেন, সুরমা বলে।

– আপা, হুজুরগো কি যেন একটা দল আছে তারা পল্লীটা তুইলা দিবে। তাগোর সাথে বড় বড় লোকজন আছে। কই যামু? কিছুই চিনি না, আর কোন কাম জানিনা! কই যামু আফা?  কৃষ্ণা কেঁদে ফেলে।

যৌনপল্লীতে উচ্ছেদ হুমকি সব সময়ের জন্যই আতংক। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গ্রুপের কারনে মাথাচাড়া দেয়। সুরমা দেবযানীকে বলে নেত্রীদের সাথে আর অন্যান্য এনজিও’র সাথে কথা বলবে বিষয়টি নিয়ে। সভানেত্রী মর্জিনা আপাকে ডাকতে বলে সুরমা, ভাবে ওনার কাছ থেকে আগে শোনা দরকার। মর্জিনার মেয়ে এসে বলে, “মায়তো মাজারে গেছে, আটরশি পীরের মাজারে। আসতে সন্ধ্যা হইতে পারে।”

সুরমা একটু অবাক হয়ে ভাবে যৌনকর্মীরাও মাজারে যায়! কেন যায়? মর্জিনার সাথে পরের দিন কথা বলবে ঠিক করে।

১৫০ বছরের পুরোনো মাদারীপুর যৌনপল্লী, বৃটিশ আমলে পাট ব্যাবসায়ীদের মনোরঞ্জনের জন্য এই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। একটা তিনতলা ইটের বাড়ি ছিল। রাজনৈতিক  পট পরিবর্তনেও এটি পাকিস্তান আমলে এবং এখন স্বাধীন বাংলাদেশে একইভাবে, আইনের আওতায় রয়ে গেছে। এখনো ৫০০ মেয়ে আছে, প্রায় ১৫০ শিশু আছে। এদের অনেকেই  স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করে। কৃষ্ণার মত অনেকেই আছে যারা কয়েক প্রজন্ম ধরেই এখানকার বাসিন্দা।

সারাদিনের কাজ শেষ করে প্রোজেক্ট অফিস থেকে বের  হবে এমন সময় দরজার বাইরে ছেলেদের একটা দল হৈচৈ করছে। অফিস সহকারি রহিম ভাই এসে বলে পল্লীর ছেলেরা সুরমা আপার সাথে কথা বলতে চায়। সুরমা বাইরে আসে, ৮-১০ জনের একটা গ্রুপ, এরা সবাই বিভিন্ন রকম তাজিয়া মিছিলের পোষাক পরা, হাতে মহররমের পতাকা। সে আরো খেয়াল করলো আশেপাশে গেট সাজানো, লাইটিংয়ের লোকজন কাজ করছে। কেমন একটা উৎসব উৎসব আমেজ। ছেলেদের মধ্যে নেতাগোছের একজন বলল, ‘‘আন্টি আমরা চান্দা নিতে আসছি, মহররমের অনুষ্ঠান করবো সেই জন্য। আমাদের এই পল্লীতে সবচেয়ে বড় উৎসব মহররম। ওইদিনই আমরা সব আনন্দ করি, ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দ হয়। আন্টি আপনে আমাদের কিছু দেন।”

দেবযানী, স্থানীয় সহযোগী সংস্থার কোর্ডিনেটর, ছেলেদেরকে তার সাথে যোগাযোগ রাখতে বলে। ছেলেরা চলে যেতেই সুরমা জানতে চায়, মহররমে ওরা কী করে? টুটুল বলে, তাজিয়া মিছিল বের করে, খিচুরি রান্না হয় বড় বড় ড্যাগে। যৌনকর্মী, সর্দারনী, বাবু, এলাকার গন্যমান্য লোকজন, খদ্দের সবাই মিলেই হৈচৈ করে, রঙ খেলে, তার আগে থেকে প্রতিদিন ছেলেপেলেরা আনন্দ করে।

প্রথম দিনের কাজ শেষ করে সুরমা আর টুটুল হোটেলে চলে যায়। এর মাঝে সে স্থানীয় লোকজন, সাংবাদিক ও অন্যান্য সংস্থার কয়েকজনকে ফোন করে জেনে নেয় আসলে উচ্ছেদের বিষয়টা কী, কারা করাচ্ছে , কতটা ভয়াবহ হতে পারে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে একটা মিছিল বের করবে বলে শোনা যাচ্ছে। এরা ধর্মের নাম ব্যবহার করা একটি গ্রুপ। কিন্তু সুরমা ভাবতে থাকে মর্জিনা পীরের মাজারে কেন যায়?

পরের দিন প্রজেক্ট অফিসে ঢুকেই দেখে মর্জিনা সাথে বিউটি নামে এক ছুকরিকে নিয়ে আগে থেকেই ওখানে বসে আছে।

সুরমা জিজ্ঞেস করে, কাল কোথায় গিয়েছিলেন মর্জিনা আপা?

– আটরশি পীরের মাজারে।

– কোথায় সেটা? কাছে কোথাও?

– আপা, আমাগো এখান থাইকা ফরিদপুরের দিকে যাইতে মাঝ রাস্তায় পড়ে।

– কেন গিয়েছিলেন?

– আপা, মানত করছিলাম। শুনছেন তো পল্লী উডাইয়া দেওনের পাঁয়তারা চলতেছে। তাই পীরের মাজারে গিয়া মোম আগরবাতি দিছি,  নফল নামাজ পড়ছি, আর ৫ হাজার টাকা দিছি দান বাক্সে যেন আমাগো থাকনের এই জায়গাডা রক্ষা হয়।

– আপনি নামাজ পড়েন?

– মাঝে মইধ্যে পড়ি। তয় রোজা রাখি সবগুলা।

– রোজা রাখলে কাস্টমার নেন কখন?

বিউটি এইবার বলে, রোজার দিন কাস্টমাররা ইফতার করে আসে। অনেক মাইয়ারা নামাজ রোজা করে কিছু কিছু।বিপদে পড়লে আল্লাহ-ঈশ্বররে ডাকে। বাচ্চাগোরে মাদ্রাসায় পড়ায়। আমরা তো খারাপ মানুষ, খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে।

– আল্লাহর কাছে কী চান? সুরমা জানতে চায়

সব চাই আফা, বিউটির ঝটপট জবাব। সে বলতেই থাকে, প্যাট চালানোর জন্যে টাকা চাই, টাকার জন্য কাস্টমার চাই, কাস্টমাররে যেন খুশি করতে পারি বকশিস পাওয়ার জন্য সেই দোয়াও চাই। সর্দারনী যেন না মারে, ভালা খাইতে দেয়, কনডম দিয়া কাজ করতে পারি সেই দোয়াও চাই। আল্লাহ তো একজনই, সেতো সবই জানে কন। তাইলে আপনারে আল্লাহ দ্যাখলে আমারেও দ্যাখবে। তাই তো তারেই ডাকি। ঠিক কইছি না আফা, কন? আফা, আমি গ্রামের মসজিদের হুজুরের কাছে কোরান শরীফ পড়তে যাইতাম। আমপাড়া শেষ করছি, কোরান হাতে নিবো- ঠিক সেই সময় আতকা আমারে বিয়ে দিয়া দিল সিনামার নায়কের মতন দ্যাখতে আমার চাচাতো ভাইয়ের বন্ধুর লগে। সে ঢাকাইয়া পোলা, বন্ধুর গেরামে বেড়াইতে গেছিল। আমারে দেইখ্যা পছন্দ করছে, আমার বাপ-মায়েও তারে ভালো পাইছে। দুই দিনের মইধ্যে তার লগে বিয়া দিয়া ঢাকার গাড়িতে তুইলা দিল।  আর সে আমারে এইখানে আইনা বেইচা দিল। আমার বাপমায়েরে যে বাড়ির ঠিকানা দিছিল সকলডি ভুয়া। আফা, আমি কিন্তু এখনো আয়তুল কুরছি মুখস্থ বলতে পারি। রাইতের বেলা ঘুমানোর সময় তিনবার পইড়া বুকে ফুঁ দেই। সারারাত ফেরেশতারা আমারে পাহাড়া দিয়া রাখে, মসজিদের হুজুরের কাছে শিখছি। আমি বোজতে পারি সেই রহমতেই অহনও বাঁইচা আছি। নইলে আমার সর্দারনী যে মাইর মারে, কবেই মইরা যাইতাম গো আফা!

বিঃদ্রঃ ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সালে ইসলাহে কওমী পরিষদ নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্বে, প্রসাশনের সহযোগিতায় যৌনপল্লীটি উচ্ছেদ হয়। পিছনের কারন হিসাবে জানা যায় একজন ক্ষমতাশালী মানুষের হাত ছিল, একটি বহুতল মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। ব্লাস্ট, আইন ও শালিস কেন্দ্র এবং সেক্সওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ মিলে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেছিল। শুনানি স্থগিত অবস্থায় আছে এখনো। কিছু কিছু সর্দারনীর নিজের নামে জমি ছিল সেখানে, তারা এখনো বসবাস করে। তবে কোন রকম ব্যাবসা হয় না।

(চলবে…)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?

পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না

পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’

পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’

পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’

পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’

পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’

পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”

পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”

পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’

পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”

পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”

পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন

পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে

শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?