September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

“তোর কেরিয়ার নিয়ে কীসের চিন্তা, বিয়ে তো হয়েই গেছে!”

বিথী রায়।। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নারী শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি নারী শিক্ষাগ্রহণের সাথে সাথে সাফল্যও প্রদশর্ন করেছে। বোর্ডের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, মেডিকেল ভর্তি, এমনকি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পুরুষ শিক্ষার্থীর তুলনায় নারী শিক্ষার্থী অনেক এগিয়ে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষের রেজাল্টেও নারী শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে। এমনকি গবেষণা ক্ষেত্রে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অনেক নারী শিক্ষার্থী বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সাফল্য দেখিয়েছে।

পেশাক্ষেত্রেও বাংলাদেশের নারী পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের সামাজিক নানা প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে প্রায় প্রতিটি পেশায় নারীরা তাদের সাফল্য দেখিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নারীরা প্রমাণ করছে “নারীদের জন্ম শুধু স্বামী-সন্তান পালন নয়”। নারী অর্থই ঘরবন্দী, ঘর সংসার আর পুরুষের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকবে- এসব কনসেপ্টকে মিথ্যা প্রমাণ করছে নারী। নারী তার অবদান ঘর-সংসারে সীমাবদ্ধ না রেখে বিশ্বসংসারে রাখা শুরু করেছে। নিজেদের নারী না ভেবে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, অপরের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে  নিজেকে মানুষ বলে দাবি করতে শিখেছে।

আর নারীর এমন সাফল্য দেখেও না দেখার ভান করে আজও কিছু কীট আছে যারা কৌশলে নারীকে ঘরে আটকানোর ফন্দী আঁকে। ধর্মের দোহাই দিয়ে, নারীকে অবলা আখ্যায়িত করে, নারীর জন্য পরিবেশ অনুকূল না- এই কথা বলে তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে পিছিয়ে আনার চেষ্টা করছে। নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার দীক্ষা না দিয়ে পরের উপর নির্ভরশীল হওয়ার দীক্ষা দেয়। এখনো বলা হয় যে “মেয়েদের আলাদা করে কোন কিচ্ছু (চাকরি) করতে হয়না, তাদের জন্য আছে তাদের প্রভু বা স্বামী”। এখানে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি।

উত্তরবঙ্গের উচ্চবিদ্যাপীঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া মাঠে বসে কয়েক জন বন্ধু-বান্ধবী গল্প করছি। আড্ডার এক পর্যায়ে সবার কেরিয়ার নিয়ে কথা উঠলে আমার এক বন্ধু আমাকে বলে উঠলো “বিথী, তোর আর কেরিয়ার নিয়ে কীসের চিন্তা! তোর তো বিয়ে হয়েই গেছে। অনার্স-মাস্টার্সটা কমপ্লিট করে পুরোদমে সংসার শুরু করবি। আর ভাইয়া তো আছেই”। এই একটি কথাই আমার জীবনে অনেকবার শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক মানুষের মুখে অনেকভাবে শুনেছি। এই কথার মূল কথা হল- বিয়ে হয়ে গেছে, পড়াশোনার কোন দরকার নেই, পড়লেও ব্যক্তিজীবনে কিছু করার নেই, আমার ভরন-পোষনের দায়িত্ব তো আমার বর নিয়েছে, তাই আমার দায়িত্ব মন দিয়ে সংসার করা।

এই মন্তব্য আমায় ভাবিয়ে তোলে। এই সময়ে এসেও একজন ভার্সিটি পড়ুয়া বন্ধু আমায় এমন কথা বলতে পারে, কলেজ পড়ুয়া বন্ধু বলতে পারে, পাশের বাড়ির শিক্ষিত আংকেল আমায় এই কথা বলে বুঝাতে পারে যে মেয়েদের কাজ করার জন্য পরিবেশ অনুকূল নয়, আত্মীয় আমায় ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে পারে- মেয়েদের এত পড়াশোনার দরকার কী, মেয়েদের ধর্মই সংসারধর্ম পালন।

এনারা আসলে কেমন মানসিকতা ধারণ করে! এনারা কি নারীর এই সাফল্যের জোয়ার দেখছেন না, নাকি দেখেও না দেখার ভান করে নারীদের ঘরে বন্দী করার কৌশল করছে। বিবাহিত বলে কি পড়াশোনা শেষ করে  ব্যক্তিজীবনে কোন ক্যারিয়ারের দরকার নেই? তাহলে এই যে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে স্নাতক পর্যন্ত পড়ালেখা- এটা কি শুধু বিয়ের উদ্দেশ্য, আর বিয়ে হলে কি মেয়েদের বাবা-মা’র প্রতি কোন দায়িত্ব, সংসারে কোন দায়িত্ব থাকবে না? নারীরা নারী হওয়ার কারনে কি সব সময় সব রকম অবস্থায় পরের ওপর নির্ভরশীল থাকবে?

যেসব বন্ধু বলতে পারে “তোদের মেয়েদের কেরিয়ার নিয়ে কোন চিন্তা নেই”- এই বন্ধুরাই তাদের বিবাহিত জীবনে স্ত্রীকে ক্যারিয়ার গড়তে দেবে না, ঘরে আবদ্ধ রাখবে শুধু সন্তান পালনের জন্য। যেসব আংকেলরা বলেন মেয়েদের বাইরে কাজ করার মতো পরিবেশ নাই , উনারাই বাইরে গিয়ে নারীদের কাজ করার পরিবেশ নষ্ট করে। যেসব আত্মীয়স্বজন বোঝানোর চেষ্টা করবে মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করার দরকার নাই, বিয়ের পর আরো দরকার নাই- উনারাই নিজেদের স্ত্রী-সন্তানকে নিজের দাপটে দামিয়ে রাখতে চান। উনারাই নিজেদের মেয়ের স্কুলে-কলেজে পাঠায় শিক্ষিত করার জন্য নয়, শুধু বিয়ে দেওয়ার জন্য যোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টায়।

এ কারণেই নারীদের এসব কীটকে চিনে নিতে হবে। এসব শিক্ষিত কীট আমাদের চারপাশে ঘুরছে আর নারীদের ঘরবন্দী করার কৌশল করছে। নারীদের মানসিকভাবে পিছিয়ে ফেলছে। সমাজের এসব কীটকে দমিয়ে রাখতে নারীদেরই কাজ করতে হবে। এসব কীট নারীদের মানুষ ভাবতে পারে না, যেভাবেই হোক নারীদের দমন-পীড়ন করে সব সময় পায়ের নীচে রাখতে চায়। নারীদেরই এসব কীটদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, প্রমান করতে হবে নারীর জন্ম শুধু স্বামী-সন্তান পালন, ঘরসংসার করতে নয়। সমাজে, দেশে, সর্বোপরি সারা বিশ্বে নিজেদের অবদান রাখতে হবে। নিজেদের দায়িত্ব ছাড়াও সমাজের কিছু মানুষেরও দায়িত্ব নারীদেরই নিতে হবে, নিজেকে শুধু মানুষ করে তুলতে হবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]