ডিভোর্স-পুরুষের পৌষমাস, নারীর সর্বনাশ!
আফরোজ ন্যান্সি।। কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ার সময় এক ক্লাশমেটের বাপ তারে জোর করে বিয়ে করায়া দিলো। যেহেতু সে পুরুষ আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার বিয়ের জন্য একেবারেই আর্লি ভাবা হয়, তাই সেই ক্লাশমেট খুবই আপসেট থাকতো এবং বিয়ের সম্ভবত মাস ছয়/সাত পরেই সে তার বৌ’রে ডিভোর্স দিলো এবং ডিভোর্সের কারন হিসেবে শক্ত কোনো যুক্তিও তার দরকার পড়ে নাই। তখন দেখছি, তার ফ্যামিলি, বন্ধু- বান্ধবী এমনকি কলেজের সব থেকে জনপ্রিয় জনদরদী শিক্ষকও সেই ছেলেরে সাপোর্ট দিছে। আসলেই তো, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ুয়া একটা ছেলে কোথায় লাইফ এনজয় করবে, দশটা-পাঁচটা প্রেম করবে তা না, তার ঘাড়ে কিনা চাপায়ে দেওয়া হইছে “বৌ”! এই বৌ’কে ডিভোর্স দেওয়াই যায়। শুধু আমার ক্লাশমেট কেন, আমার দেখা বা জানাশোনার জগতের কোথাও কোনো পুরুষকে ডিভোর্সের আগে পরে কোনোরকম সামাজিক বা পারিবারিক বিপত্তি পোহাতে আমি দেখি নাই। ডিভোর্সের প্রসেস শুরু হওয়া থেকে শেষ হওয়া অব্দি এবং ডিভোর্স পরবর্তী পারিবারিক কিংবা সামাজিক কোনো ক্ষেত্রেই পুরুষটিকে কোন রকম বিব্রতকর প্রশ্ন কিংবা অস্বাস্থ্যকর মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয় না। যদি বা কারো ক্ষেত্রে হয়ও তা একজন ডিভোর্সড নারীর তুলনায় হাজার গুন কম।
এই একই ডিভোর্স পুরুষের জন্য শাপে বর হইলেও নারীর জন্যে তা অভিশাপ স্বরূপ। হোক নারীটি স্বেচ্ছায় তার পুরুষ সঙ্গীটিকে ডিভোর্স দিছে অথবা পুরুষটিই ডিভোর্স দিছে নারীটিকে- সকল ঝক্কি, সকল বিদ্রুপ, সকল বিরূপ মন্তব্য কিন্তু বরাদ্দ থাকে নারীর জন্যেই। একজন নারী যতই লজিক্যাল কারনে ডিভোর্স দিন না কেন, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ইঙ্গিতে তারে চরিত্রহীন নারী বইলাই আখ্যা দেয়। আমাদের সমাজে ভালো নারীর মানদণ্ড নির্ভর করে সে কতটা ভালো স্ত্রী তার উপর, আর ভালো স্ত্রী মানে হইলো সে তার পুরুষ সঙ্গীর সকল রকম দোষ, অন্যায়, অবহেলা, অত্যাচার সহ্য করবে, প্রয়োজনে ঝগড়া করবে, তিক্ত একটা সম্পর্ককে বয়া নিয়া বেড়াবে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই “স্বামী” নামক লোকটিকে ত্যাগ সে করবে না। আর ত্যাগের প্রশ্ন যদিবা আসে, তবে তা করবে পতিধনটিই।
আইন এবং ধর্ম যতই নারীকে ডিভোর্স দেওয়ার লিখিত অধিকার দিক না কেন, সমাজ তাকে তা দিতে নারাজ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ডিভোর্সের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য তো আছেই তার উপর পুরুষ পক্ষের আইনজীবীর চাইতে নারী পক্ষের আইনজীবীকেই তুলনামূলক বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নারীর ঠাঁই নাই তার পরিবারেও। যে নারী অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয়, সবার আগে তাকে নিজ পরিবারেই লাঞ্চনার মুখোমুখি হতে হয়। তার বাবা মা ভাই বোনই তাকে পরামর্শ দেয় এই বলে যে স্বামীরা একটু অমন হয়! মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব থাকে কেবল স্ত্রীর। তবু যদি নারীটি সবার বেহুদা পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকে তখন সবার আগে এই পরিবারের কাছেই সে তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার তাকে সরাসরি নিগৃহীত করে, আবার অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি কিছু না বললেও “লোকে কি বলবে” মার্কা কথাবার্তা বলে তাকে মানসিকভাবে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগায়া ছাড়ে। অন্যদিকে ঘরের ছেলের ডিভোর্সের পরে চৌদ্দগুষ্টির মনোভাব থাকে এমন যে, “এক বৌ গেলে দশ বৌ পাওয়া যাবে, সে যেন অযথা মন খারাপ না করে।”
যখন পরিবারেই এই বৈষম্য তখন সমাজের প্রতিক্রিয়ার কথা বলাই বাহুল্য। এখানে পুরুষের বেলায় বলা হয় “মিঃ অমুক তো ডিভোর্সড” কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে ই-প্রত্যয় যুক্ত কইরা আরেকটু রসালো কইরা বলা হয় “মিসেস তমুক তো ডিভোর্সী”। পুরুষের ক্ষেত্রে ডিভোর্স একটা সিচুয়েশান কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে তা বিশেষণ হইয়া দাঁড়ায়। “ডিভোর্সী” যেন একটা উপাধি আর তা লোকের মুখে মুখে রসালোভাবে উপস্থাপিত হয় একমাত্র এবং একমাত্র নারীর জন্যেই। যদিও ডিভোর্সী শব্দটা তালাকপ্রাপ্ত নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই প্রযোজ্য।
কোনো নারীর ডিভোর্সের পরে তার সকল পরিচয় ছাপায়ে যায় এক “ডিভোর্সী” বিশেষনের আড়ালে। আমার পরিচিত এক ব্যাংকার নারী, যিনি একটা মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকে উচুপদে চাকুরি করেন এবং নিজ যোগ্যতাবলে প্রমোশান পেয়ে মাইগ্রেশান করে সিঙ্গাপুর গেছেন কিন্তু সেই নারীর ব্যাপারে কথা বলার সময় লোকে শুরুতেই এইটা বলতে পছন্দ করে যে তিনি ডিভোর্সি এবং এরপরে ধারাবাহিকভাবে আসে তিনি কতটা শিক্ষিত এবং কতটা যোগ্যতাসম্পন্ন। এবং পরিশিষ্টে তারা বলেন, “মহিলারা বেশি শিক্ষিত, বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হইলে এমনই হয়” অথবা “এতো যোগ্যতা থাইকা কী লাভ হইলো, জামাইর ঘরই তো করতে পারলো না”।
এই সমাজে পুরুষবিহীন একজন নারী যার ডিভোর্স হইছে কিংবা সেপারেশানে আছেন কিংবা বিধবা তিনি যেন জাতীয় সম্পত্তি। তাকে নিয়া যে কেউ যে কোন জায়গায় যে কোন রকমের কুমন্তব্য করার অধিকার রাখেন। একজন ডিভোর্সড নারীর প্রতি শুধু পুরুষ না, অনেক নারীও এমনভাবে আড়চোখে তাকান যেন ডিভোর্সড নারী মানেই সারাক্ষণ পুরুষ ধরার জন্য আকুল হয়া আছেন। আমি আমার এক বয়স্কা আত্মীয়ারে দেখছি কীভাবে সে তার পঞ্চাশোর্ধ জামাইরে এক ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের ডিভোর্সড নারীর কাছ থেকে আগলায়া রাখতেন। যেন তার জামাই এক মহাপুরুষ আর ওই নারীর তালাক হইছেই তার জামাই ধনটিরে প্রলুব্ধ করার উদ্দেশ্যে। আর এত কিছুর পরে যদি কোনভাবে কোন নারী ডিভোর্সের পরে নতুন করে প্রেমে পড়ে কিংবা বিয়ে করে তাইলে তো লোকের চুলকানি একটা দেখার মতো বস্তু হয়া দাঁড়ায়! এইবার তারা কাছা বাইধা বলতে নামেন যে, তারা এইটা আগেই জানতেন এই নারী চরিত্রহীন, তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আছে আর তাই সে অত ভালো স্বামীটির ঘর করতে পারলো না! লোকের চোখে তার স্বামী তখন সপ্তম আসমানের নূরের তৈরি কোন ফেরেশতা আর ওই নারী হইলো পাতালবাসী শাপগ্রস্ত দেবী মনসা!
এইসব দেইখা খুবই অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটা প্রবাদ আমার মনে পইড়া যায় “একই অঙ্গে কত রূপ” ঠিক যেমন “এক ডিভোর্স শব্দের কত রকম অর্থ- পুরুষের ডিভোর্স হইলে ইটস ওকে আর নারীর ডিভোর্স হইলে ছি ছি মাগীর চরিত্র খারাপ!”
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]