September 20, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

কলি-কাহন

মেহেরুন নূর রহমান।। কোলে জড়ো করে রাখা কলির হাতের উপর হাত রাখেন রোকেয়া বেগম। নরম গলায় জিজ্ঞেস করেন, ভয় লাগছে গো মেয়ে?

কলি চুপ করে থাকে। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে কলি। বাতাসে সামনের কুচো চুলগুলি উড়ছে। একপাশ থেকে কলির দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয় রোকেয়া বেগমের। মিষ্টি মায়াকাড়া মুখ, শ্যামলা ছিপছিপে গড়ন। একঢাল চুল হালকা বিনুনীতে বাঁধা।

রোকেয়া বেগম এবং কলির মা শাহানা বন্ধু ছিলেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে সমবয়েসী চাচাতো ননদ শাহানার সাথে রোকেয়া বেগমের দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো। শাহানার বিয়ের পরও তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। বিয়ের পর শাহানা বেশ ক’বছর ভালোই ছিল। কলির বয়স যখন বছর তিন তখন শাহানার স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে স্ত্রী কন্যাকে ফেলে চলে যায়। কান্নাকাটি, পায়ে ধরা কিছুই আর তাকে ফেরাতে পারেনি। পিতৃমাতৃহীন শাহানা মেয়ে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে ফিরে এসেছিল। তার মাসখানেক পর গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছিল। এখনো সে দৃশ্যের কথা ভাবলে রোকেয়া বেগম শিউরে ওঠেন। একবারও মেয়ের কথা ভাবলি না?

কলি মামার বাড়িতেই বড় হয়েছে। রোকেয়া বেগম যতটা পেরেছেন ভালোবেসেছেন মেয়েটিকে। ভালো কিছু রান্না করলে ডেকে খাইয়েছেন। পিঠা পায়েস রাঁধলে ওর জন্য এক বাটি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর বেশি করার সামর্থ্য তার ছিল না।

কলি একমাত্র মামার বাড়িতে আরো চার মামাতো ভাইবোনের সাথে সুখে দুঃখে বড় হয়েছে। মামা ওকে খুব স্নেহ করেন। মামীও ওর প্রতি সদয়। তারা চেষ্টা করেছে মৃত বোনের  কন্যাকে যতটা সম্ভব যত্ন নিতে। কলিও বুঝদার মেয়ে। একটু বড় হবার পর সাধ্যমত ঘরের কাজে মামীকে সাহায্য করতো। ছোটবেলা থেকেই কলি লেখাপড়ায় ভালো। কোনরকম কোচিং ছাড়া এসএসসি’তে গোল্ডেন এ+  পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কলির এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে সপ্তাহ দুই আগে। ও জানে এবারো সে ভালো রেজাল্ট করবে।

কথায় বলে অভাগা যেদিকে চায় সাগরো শুকায়ে যায়। কলি এবং তার মামার পরিবারের সামনে এখন ভয়াবহ দুর্দিন। কলির মামার প্রোস্টেট ক্যান্সার। গত ছয় মাস ধরে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে করতে তারা প্রায় সর্বস্বান্ত। এই কঠিন সময়ের মধ্যে কলি এইচএসসি পরীক্ষা কষ্ট করে দিয়েছে কিন্তু  ভবিষ্যতে কোন ভার্সিটিতে পড়ার কথা সে আর ভাবতে পারে না। বরং কোন কাজ করে মামাকে যদি সাহায্য করা যায়, তাই ভাবে।

ঠিক এমন সময় রোকেয়া বেগম এই প্রস্তাবটি  নিয়ে আসেন। রোকেয়া বেগমের এক দূরস্পম্পর্কের অবস্থাপন্ন, সজ্জন আত্মীয় আছে। বিপদে আপদে আত্মীয়স্বজনদের সাহায্য করেন। ভদ্রলোকটির নাম রেজাউল করিম। তার স্ত্রী বছর তিনেক হলো স্ট্রোক করে ব্রেইন ডেমেজড হয়ে শয্যাশায়ী। দুটি সন্তান। ১০ বছরের পুত্র আর ৮  বছরের কন্যা। নার্স আছে স্ত্রীকে দেখাশোনার জন্য। ভদ্রলোকের মা থাকেন সাথে, কাজের সহকারী আছে তারপরও বাচ্চা দেখাশোনা নিয়ে ভদ্রলোক পেরেশানিতে থাকেন। অনেকে তাকে আবার বিয়ে করার কথা বলেছে। কিন্তু ভদ্রলোক কখনোই রাজি হন নাই। এসব মিলিয়ে আত্মীয়মহলে ভদ্রলোকের অনেক সুনাম।

সেই রেজাউল করিমের কাছে ফোন করে রোকেয়া বেগম কলির কথা পারলেন। এত ভালো একটা ছাত্রী তার লেখাপড়া হবে না? রেজা ভাই যদি তাঁর ঘরে কলিকে দয়া করে ঠাঁই দেন। বিনিময়ে কলি না হয় বাচ্চাদের পড়াবে। সব শুনে রেজাউল করিম কলিকে নিয়ে তাঁর ঢাকার বাসায় আসতে বললেন। আজ সেই রেজাউল করিমের বাসায় যাচ্ছে তারা। আসার সময় জড়িয়ে ধরে মামা ভাগ্নির সেকি কান্না! রোকেয়া বেগম শেষ ক’দিন কলিকে পইপই করে বলেছেন – ভালো কইরা বাচ্চাগুলাকে পড়াবি মা। পারবি না? তুই কত ভালো ছাত্রী!

কলি ভয় পাচ্ছিলো, শহরের বাচ্চা, কথা শুনবে তো? রোকেয়া বেগম বলেছেন, শোন এরা রেজা ভাইয়ের বাচ্চা। গাছ ভালো তো ফল ভালো। তুই সাহস রাখিস।

রেজাউল করিমের বাড়ি উত্তরায়। বছর দশেক আগে এই অ্যাপার্টমেন্টটা  কিনেছিলেন। তার স্ত্রী মনি কত যত্ন করে বাড়িটি সাজিয়েছিলেন আর আজ জড়ভরত হয়ে এক কোনায় পরে আছেন। রোকেয়া বেগম আর কলিকে রেজাউল করিম সাদরে বিশাল ড্রয়িং রুমে বসিয়েছেন। মধ্য চল্লিশের সৌম্য ভদ্রলোক। শিক্ষা রুচির ছাপ চেহারায়, কথাবার্তায়, পোশাকে। উনার ষাটোর্ধ্ব মা আর দুই বাচ্চার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মিশুকে আর মিষ্টি  বাচ্চা দুটাকে দেখে কলির ভয় খানিকটা কমলো। রেজাউল করিম ওদের তার স্ত্রীর রুমে নিয়ে গেলেন। বিছানায় ঘুমন্ত ভদ্রমহিলাকে দেখে রোকেয়া বেগম আর কলির কি যে খারাপ লাগলো! রোগা ,সাদাচুল, ফ্যাকাশে চামড়া অথচ বয়েস চল্লিশ হবে কিনা কে জানে। বের হবার আগে রেজা সাহেব মায়াভরে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

দুজন নার্স পালা করে সারা সপ্তাহ রেজাউল করিমের স্ত্রীকে দেখেন। বাসার কাজের জন্য সহকারী আছে দু’জন। সুতরাং বাচ্চাদের পড়ানো এবং খানিক দেখভাল ছাড়া কলির কোন কাজ নেই। রেজাউল করিম বললেন উনি কয়েক সপ্তাহ দেখবেন কলি বাচ্চাদের সাথে অ্যাডজাস্ট করতে পারছে কিনা, তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। পরদিন সকালে রোকেয়া বেগম বাড়ি ফিরে গেলেন। যাবার আগে জড়িয়ে ধরে কলিকে সাহস রাখতে বললেন আর রেজা সাহেবকে কলির খেয়াল রাখার অনুরোধ করলেন। রেজাউল করিমও বোনের হাত ধরে কথা দিলেন।

আজ দশদিন কলি রেজাউল করিমের বাসায়। বেশ মানিয়ে নিয়েছে। বাচ্চা দুটার সাথে ওর এখন অনেক ভাব। ওদের নাম রায়া আর রনো। বুদ্ধিমান দুটা বাচ্চা। মা অসুস্থ বলেই বুঝি ওরা এত লক্ষী। ওদের পড়াতে বেশি বেগ পেতে হয় না। খানিক দুষ্টুমি করলেও কথা শোনে। বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথেও কলির ভাব হয়ে গেছে। দাদির হাত গা টিপে, গল্প করে , কাজের খালাদের এবং নার্সদের নানাভাবে সাহায্য করে বেশ সুসম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে।

বাচ্চাদের পড়ানো , খাওয়া গোসলে সাহায্য করা, বিকেলে ছাদে যাওয়া, বই পড়া এবং টিভি দেখে কলির দিন ভালোই কাটছিলো। কলির নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না নিজের সৌভাগ্যে। প্রতিদিন যখনই ভালো ভালো খাবার পাতে নেয়, মামা আর মামাতো ভাইবোনদের কথা মনে হয়। ইশ কোন ভাবে যদি মামাকে সাহায্য করা যেত! কলি ভাবে রেজা মামা তাকে পার্মানেন্টলি রাখতে রাজি হলে ও আসেপাশে কোন টিউশনি নিবে। ঢাকা শহরে একটা টিউশনিতে বেশ ভালো টাকা পাওয়া যায়। রায়া রনোকে দেখাশোনার পাশাপাশি একটা টিউশনি ও ঠিক ম্যানেজ করতে পারবে।

রেজাউল করিমের সাথে কলির খুব বেশি দেখা হয় না। সপ্তাহে পাঁচদিন তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা বাড়ির বাইরে থাকেন এবং বাসায় এসে স্ত্রীর ঘরে ঢোকেন। প্রতিরাতে নিয়ম করে সবার সাথে ডিনার করেন। দ্বিতীয়  দিনেই রেজাউল করিম কলিকে ওনাদের সাথে ডিনারে যোগ দিতে বললেন। প্রথমে আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল কলি। রেজাউল করিম কথা ব’লে, গল্প ক’রে সেই আড়ষ্টতা ভেঙ্গে দিলেন। এখন রাতে সবার সাথে বসে খাওয়াটা কলির কাছে একটা আনন্দের মূহুর্ত। ছুটির দিনে উনি নিজের স্টাডি রুমে বা বাচ্চাদের সাথে সময় কাটান। কখনো বাচ্চাদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যান। তবে অসুস্থ স্ত্রীর কথা ভোলেন না। ছুটির দিনের একটা বেশ লম্বা সময় স্ত্রীর ঘরে কাটান।

কলির দিন কাটছিল তরতর, তবে মনে মনে একটু অস্থির হয়ে উঠছিল। কবে রেজা মামা তাকে পার্মানেন্টলি থাকতে বলবেন? কবে ওর পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলবেন? কলি আসার ঠিক ২৪ দিনের মাথায় উনি এই ব্যাপারে কথা বললেন কলির সাথে। বললেন কলির কাজে, ব্যবহারে উনি খুব খুশি। সবার সাথে কলি এত তাড়াতড়ি মিশে যেতে পারবে ভাবতে পারেন নাই।  তিনি চান কলি যেন পার্মানেন্টলি এই বাসায় থাকে। আরো বললেন রেজাল্ট বেরোলেই ঢাকার কোন ইউনিভার্সিটি কিংবা কলেজে অনার্স পড়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন। টাকাপয়সা  নিয়ে যেন ও না ভাবে। তবে সময় করে বাচ্চাদের নিয়মিত পড়াতে হবে। কৃতজ্ঞ কলি কান্না চেপে কোন রকমে বললো, আপনি চিন্তা করবেন না। বাচ্চাদের পড়াশুনার ব্যাপারে কোন গাফিলতি হবে না, দরকার হলে আমি ক্লাস মিস দেবো।

হেসে রেজাউল করিম বললেন, এসব কিছু করতে হবে না, সব ম্যানেজড হয়ে যাবে।

কলি টিউশনি করার কথাটা বলবে কিনা ভাবছিলো ঠিক তখুনি আসল কথাটা বললেন রেজাউল করিম। বললেন আমি জানি তোমার মামা খুব অসুস্থ। আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাই। এখন থেকে তোমার মামার চিকিৎসার সব খরচ আমার। দরকার হলে ইন্ডিয়া নিয়ে চিকিৎসা করানো হবে। বললেন আজকের মধ্যেই মামাকে ফোনে সব জানাবেন। কলি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলো। ও কি সত্যি শুনছে! মাঝে মাঝে ধন্যবাদ শব্দটা খুব অপ্রতুল মনে হয়। কলি কিছু বলতে পারলো না, মাথা নিচু করে কাঁদতে শুরু করলো। রেজাউল করিম উঠে এসে কলির মাথায় হাত রাখলেন।

সেই রাতে ভয়ঙ্কর আনন্দ নিয়ে কলি ঘুমাতে গেলো। ও ভার্সিটিতে পড়তে পারবে? ওর মামার চিকিৎসা হবে? রেজাউল করিমের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা নিয়ে কলি প্রতিজ্ঞা করলো একদিন না একদিন সে এই ঋণ শোধ করবেই।

ঋণ শোধের জন্য কলিকে বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। সেদিনই মাঝরাতে কারো স্পর্শে কলির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘরের বন্ধ দরজা খুলে কেউ ওর ঘরে ঢুকে ওর গায়ে হাত রেখেছে। সেই হাতের মালিক এক সময় ওর গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। হাত ঘুরতে লাগলো সারা শরীরে। ১৮ বছরের কলির জীবনে প্রথম পুরুষের স্পর্শ। এত কদর্য! চুমু এত গা ঘিনঘিনে হয়! অথচ এ নিয়ে ওর কত সলজ্জ মিষ্টি ভাবনা ছিল। এই হাতের মালিককে কলি চেনে।

না, কলি কোন প্রতিবাদ করেনি। শুধু মামার অসুস্থ অসহায় চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছিল। যন্ত্রনাময় রক্তাক্ত কুৎসিত এক রাতের ভোর হয়। হাতের মালিক চলে গেছে আরো আগে।

নিজেকে টেনে হিঁচড়ে লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে যায় কলি। গা ঘষে ঘষে নিজেকে পরিষ্কার করতে থাকে। কতক্ষন পানিতে ভিজলে শরীর থেকে এই গ্লানি ধুয়ে যাবে কলি জানে না। বাথরুমের দরজায় কাজের খালার দুম্দুম্ শব্দে ঘোর কাটে । খালা চিৎকার করে, তাড়াতাড়ি বাইরে আসেন,  দেখেন কে আসছে।

কাপড় পরে বাইরে আসে কলি। ড্রয়িং রুমে সোফায় আনন্দিত মুখে বসে রোকেয়া খালা আর মামী। সামনে বসে রেজাউল করিম ওর দিকেই তাকিয়ে আছে হাসিমুখে।

কলির ইচ্ছা করে দৌড়ে গিয়ে রোকেয়া খালাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে, বলতে, খালা আমাকে এখন থেকে নিয়ে চলো।

কিছুই বলা হয় না। শান্ত পায়ে মামী খালার পাশে গিয়ে বসে। মামী হড়বড় করে বলতে শুরু করেন, দেখ্ দেখ্ কলি, রেজা ভাই তোর মামার চিকিৎসার জন্য এক লক্ষ টাকার চেক দিছেন, বলছেন পুরো চিকিৎসার খরচ দিবেন।

বলতে বলে মামী কাঁদতে শুরু করলেন। কলির চোখও জলে ভরে উঠলো। রোকেয়া খালা উঠে এসে কলিকে জড়িয়ে ধরে বললেন তোর আরো পড়ার স্বপ্ন পূরণ হবেরে মা। তুই খুশি তো?

জলভরা চোখ নিয়ে মাথা নাড়লো কলি। পাশে মায়াময় চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রেজাউল করিম।

অজস্র কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দুপুরের মধ্যেই মামী, খালা বাড়ি চলে গেলেন। যাবার আগে রোকেয়া খালা কলিকে কাছে ডেকে বললেন, বলছিলাম না রেজা ভাই খুব ভালো মানুষ? দেখলি তো ?

খানিক চুপ থেকে কলি নিঃস্ব স্বরে বলল, ঠিক বলছেন খালা, উনি ভালোমানুষ।