বক্ষবন্ধনী: নারীর পোশাক, পুরুষের যৌনতা
মো. মেহেদী হাসান।।
এক.
শারীরিক গড়নের কারণে নারীকে কিছু বিশেষ পোশাক পরতে হয়। এগুলোর একটি বক্ষ-বন্ধনী যা আমাদের দেশে ব্রা নামে বেশি পরিচিত। এ পোশাক পুরুষতন্ত্রের হাতে পড়ে কীভাবে নারীর শরীর আর পুরুষের যৌনতার অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে তার নজির তুলে ধরা এ আলোচনার উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশে নারীর পোশাক হিসেবে বক্ষ-বন্ধনীর ব্যবহার খুব বেশি দিনের কথা নয়। গোলাম মুরশিদের গবেষণায় উনিশ শতকের কলকাতার নাগরিক নারীদের পোশাক স্বল্পতার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে জানা যায়, বাঙালির অন্দর মহলে ইংরেজরা ঢুকতেও লজ্জা পেতো। নারীর পোশাকের স্বল্পতা এতোটা ছিলো! সে সময়ের এক নারী স্মৃতিচারণে বলেন, দিনের বেলা স্বামীদের সামনে যেতে তারা লজ্জা পেতেন। বাড়ির উঠোনে ঘোড়া ধান নষ্ট করছে, বাড়ির চাকর নেই কিন্তু তিনি ঘোড়া তাড়াতে পারছেন না লজ্জায়। স্বামীর ঘোড়ার সামনে কীভাবে যাবেন! এতোটা পোশাক স্বল্পতায় তাঁরা থাকতেন! বলাবাহুল্য, পরিবারের অর্থ কষ্টের কারণে নারীরা কম পরতেন বিষয়টা এমন নয়। আসলে এটা সেকালে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির এটা একটা নমুনা মাত্র। এ অবস্থায় বক্ষবন্ধনীর মতো বিলাসী পোশাক উনিশ শতকে চালুর কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। স্বামীর সঙ্গে ইউরোপে গিয়ে তিনি এসব পোশাক দেখে এসে বাঙাল মুলুকে চালু করেন। বাংলায় এ পোশাক ব্যবহারের কাল থেকে প্রায় সার্ধ-শত বছরের ব্যবধানে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক-মনোজগতে এ পোশাক কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তার নমুনা দেখা যেতে পারে।
আমাদের হাতে এ বিষয়ে কোনো সামাজিক গবেষণা নেই। উপন্যাস যেহেতু ‘প্রত্যক্ষ বাস্তবতা’র শিল্প বলে আমরা মানি সে জন্যে সামাজিক গবেষণার অভাবে আমরা ক্ষেত্র হিসেবে নিয়েছি এ সময়ের বাংলাদেশের চারটি উপন্যাসকে। উপন্যাসগুলো হল: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই, হাসনাত আবদুল হাইয়ের তিমি, হরিপদ দত্তের অন্ধকূপে জন্মোৎসব এবং মঞ্জু সরকারের টান।
চারটি উপন্যাসের রচয়িতা পুরুষ। পুরুষ লেখক হিসেবে লেখকদের মনোভাব, পুরুষচরিত্রগুলোর নারীর এ পোশাকের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া আর নারীর নিজের এ সম্পর্কিত ভাবনা এ নিবন্ধের বিষয়।
দুই.
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে খিজিরের স্ত্রী জুম্মনের মাকে রহমতউল্লা মহাজন নিজের মুঠোয় রাখে নানা কৌশলে। জুম্মনের বাপের কাছ থেকে ছাড়িয়ে এনে বিয়ে দেয় বেবিটেক্সি-চালক খিজিরের সাথে। এরপর তারই প্রতিষ্ঠিত বস্তিতে তাকে আশ্রয় দেয় ও নিজ বাড়িতে কাজ দেয় ঠিকা ঝিয়ের। যেমনটি সে রেখেছিল একসময় খিজিরের মাকেও। অর্থাৎ মহাজন খিজিরের মাকে যেভাবে ব্যবহার করতো, খিজিরের স্ত্রীকেও সেভাবে দেখে। তবে বয়সের কারণে এখন জুম্মনের মায়ের (খিজিরের স্ত্রী) সঙ্গে তার যৌনসম্পর্ক হয় প্রায় অক্ষম পুরুষের। চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাস থেকে আমরা ছোট একটা অংশ উদ্ধার করি।
“সিঁড়ির গোড়া পার হবার পর মহাজন ডাকলো, ‘যাস?’
তার কণ্ঠস্বর শুকনা ও কাঁপাকাঁপা। … গায়ের শালের নিচে থেকে কাগজের একটা প্যাকেট তার দিকে এগিয়ে ধরে, ‘ল।’ মহাজন তার একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে, হঠাৎ তার ঘাড়ে হাত রেখে বলে, ‘বহুত মেহনত হইছে, না?’ তার গলা এতো কাঁপছিলো যে, এই কথায় কোনো দরদ ফোটে না। ফের বলে, ‘ল। তরে দিলাম। সেতারার মায়ে জানলে হাউকাউ লাগাইয়া দিবো।’ ব্রেসিয়ারের প্যাকেট হাতে নিতে নিতেই জুম্মনের মা টের পায় জিনিসটা কি? সেতারা তাকে একবার একটা দিয়েছিলো; সেতারার ব্যবহৃত…. আজ মহাজন তাকে ঐ জিনিস দিলো একবারে নতুন। … … মহাজনের ভারি হাতের তলায় তার ঘাড়ের ভেঙে পড়ার দশা হয়। সেই ঘাড়ে মহাজন একটা চুমু খায়, তার বুকে হাত রেখে বলে, ‘সিনা তর ফাস্ট কেলাশ। এটা পিন্দলে দেখবি কেমুন লাগে!”
ইলিয়াসের ভাষায় আমরা অপরাধগ্রবণ মহাজনের স্বরটা চিনে নিতে পারি। বহুগামিতা বিষয়ে মধ্যযুগের বাংলা-সাহিত্যে হিন্দু-লেখকদের লেখা থেকে নানাবিধ উদাহরণ টেনে আনিসুজ্জামান দেখান যে নারী নিজের বহুগামিতার পক্ষে অধিকার আদায়ে পুরাণের ও শাস্ত্রের অনেক দৃষ্টান্ত টানছে। অপরদিকে সাধারণভাবে মুসলমানদের রচিত সাহিত্যে বহুগামিতা নিষিদ্ধ হলেও বাড়ির নারী গৃহকর্মী গমন নির্বিচারে সবাই শাস্ত্রীয় বলে দোহাই দিয়ে সমর্থন করছে। এ বিষয়টি স্মরণে নিলে গত ১৯৬৮-৬৯ এর দিকে পুরান ঢাকার এই মহাজনের গৃহকর্মীর সঙ্গে ভীতিকর লেনদেন আমাদের সে সময়কার সামাজিক বাস্তবতায় পরিবর্তনশীলতার ইঙ্গিত দেয়।
এখানে জুম্মনের মাকে দুজন দুটো অন্তর্বাস দেয়ার কথা আছে। মহাজনের মেয়ে সেতারা যে অন্তর্বাসটি দেয় তা পুরনো ও তারই ব্যবহৃত। কিন্তু মহাজন যেটি দেয় সেটি নতুন। একই জিনিস দেয় দুজনই। কিন্তু দুজনের দানের বস্তুটির গুণগত পার্থক্য ওদের লৈঙ্গিক পরিচয়কে নির্দিষ্ট করে দেয় যেন। মহাজনের এ দানের পেছনে লৈঙ্গিক যৌনতার দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। দুজনের উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো দ দু’রকম। রহমতউল্লার স্ত্রী জুম্মনের মায়ের কাজের উপর সন্তুষ্ট। কিন্তু সে মনে করে, ‘মাতারি’ ঘরমোছার সময় বুকের কাপড় ঠিক মতো রাখে না। সেতারাও নারী। সে যে অন্তর্বাসটি দান করে তার পেছনে তার মায়ের মতোই মনোভাব কাজ করে থাকতে পারে। সে একটি পুরনো অন্তর্বাস দিয়ে দেয় যাতে ‘মাতারি’ অন্তত তার বুক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে ঘরের পুরুষগুলোর দৃষ্টি থেকে। ইলিয়াসের পর্যবেক্ষণ শক্তির সামর্থ্য বোঝা যায় এই একটি ঘটনা দিয়ে।
রহমতউল্লা যে বলে, ‘সিনা তর ফাস্ট কেলাশ’ তাতে যৌনতার শারীরিক দিকটি প্রাধান্য পায়। ‘সিনার’ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নতুন একটা অন্তর্বাসই প্রয়োজন মনে করে সে। অন্তর্বাস পরিয়ে জুম্মনের মায়ের বুককে তার শ্রেণিগত অবস্থান থেকে রহমতুল্লা নিজের শ্রেণিতে তুলে আনতে চায়। এ ধারণাও অমূলক নয়। নারী যেখানে পোশাকটিকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করছে, পুরুষ সেখানে এটিকে একটা যৌনতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করছে। এখানে অর্থনৈতিক শ্রেণি একটি বড় বিষয়। এ পোশাকের প্রয়োজন জুম্মনের মা নিজে কতটুকু বোধ করে তা বোঝাই যায়। কিন্তু মহাজনের মেয়ে আর মহাজনের বৌয়ের কাছে এটা অপরিহার্য পোশাক। একই রকম শ্রেণিগত দৃষ্টিভঙ্গি অপরাপর উপন্যাসগুলোতেও পাওয়া যাবে।
তিন.
একই ধরনের ঘটনায় বিপরীত প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা যায়। সত্তরের দশকের পটভূমিতে রচিত হাসনাত আবদুল হাইয়ের তিমি উপন্যাসের গ্রামীণ নারী করিমন ভূস্বামী-জোতদার-চেয়ারম্যান নওয়াজেশ আলীর দ্বিতীয় পক্ষ। শুধু আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তির জোরে তার দ্বিতীয় পক্ষ ২৫/ ৩০ বছরের এ মেয়েটা, যে কি না নওয়াজেশ আলীর ছেলেমেয়েদের চেয়েও ছোট, এ বাড়ির দ্বিতীয় পক্ষ হতে বাধ্য হয়েছে। তার প্রতি নওয়াজেশের যে মনোভাব তাতে করিমনকে বাড়ির ‘বাঁদি’ কিংবা ‘চাকরানী’ থেকে পৃথক বলে মনে হয় না: “বড় বউটার মতো সবকিছু ঢিলে ঢালা হয়ে যায় নি… মেয়ে মানুষের শরীরের কাজতো একটাই।” শুধু এ একটি কারণে করিমন নওয়াজেশের দ্বিতীয় পক্ষ। “গা-টা ম্যাজ ম্যাজ করতাছে। টিইপা দিয়া যাও দেহি এট্টু।” দিনে দুপুরে নওয়াজেশের এ ধরনের ভাষার মূল অর্থ সকলেই বোঝে। কিন্তু বিপত্তি তখনই ঘটে যখন সে আবিষ্কার করে, ‘জামার ভেতরে শক্ত কাপড়ের বাঁধুনি স্তন দুটিকে আগলে রেখেছে।’ ক্ষিপ্ত নওয়াজেশ ‘শাদা ছোট জামাটিকে’ শরীর থেকে আলগা করতে করতে সমস্ত উদ্যম হারিয়ে জানতে চান ‘এটা কই পাইছো।’ করিমনের জবাব শুনে ‘ফেরিওয়ালা বেডির’ উপর তার রাগ ঝাড়ে: “হের হাড্ডি আমি ভাইঙা দিমু বেচনের আর জিনিস পায় না।” এখানে দেখা যাচ্ছে, বয়সের ভারে অসমর্থ, অধৈর্য নওয়াজেশ দায়ী করে বসে ‘শাদা ছোট জামাটিকে’। শারীরিক সম্পর্কে করিমনের অংশগ্রহণ শুধুমাত্র নওয়াজেশকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে। করিমনের কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। চিলেকোঠার সেপাইয়ে রহমতুল্লা মহাজন যেখানে জুম্মনের মায়ের ‘সিনা’র সৌন্দর্য দেখতে অন্তর্বাস উপহার দেয়, নওয়াজেশ সেখানে এটাকে প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করে। দুজনের শ্রেণিগত অবস্থান একই, যদিও একজন নাগরিক অন্যজন গ্রামীণ এবং দুজনই বয়স্ক। পোশাকটির ক্ষেত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি এক জায়গায় এসে মিলে গেছে। সেটি হচ্ছে দুজনই নিজেদের দৃষ্টিতে পোশাকটির প্রয়োজনীয়তা দেখেছে। নারীর নিজের এ পোশাকটির প্রয়োজন আছে কি না সেটি কেউই বিবেচনা করে নি।
চার.
হরিপদ দত্তের অন্ধকূপে জন্মোৎসবে গ্রামীণ গৃহস্থালী কাজে অভ্যস্ত রুবিনার মা লক্ষ্য করে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে মেয়ে ‘আগের চেয়ে ফর্সা হয়েছে’ আবার ‘গতরটা ভরাট ভরাট’। এতে মা উদ্বিগ্নও হয়। মেয়ের নতুন পোশাকটির সঙ্গে গ্রামীণ মায়ের বিন্দুমাত্র পরিচয় নেই তাই বিস্মিত মায়ের প্রশ্ন: “বেলাউজের ভিতর আর একটা বেলাউজ ক্যান?” মেয়ের ‘শরম শরম’ জবাবে মা সন্তুষ্ট নয়। মেয়ের মতো করে মা এর মধ্যে লজ্জা উপলব্ধি করে না। বরং মায়ের প্রতিক্রিয়া হয় নেতিবাচক। এ ধরনের পোশাকের কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না মা। মেয়ের পোশাকের পরিবর্তনে মায়ের প্রতিক্রিয়া বেশ সতর্ক: “কাপড়ের ভিতরের কাপড় দ্যাহা গেলে ঐ কাপড় গতরে দিয়া কোন লাভ?” দারুণ গোঁসা’য় মা বলে, “খোদায় জানে ঢাকা টাউন তরে কোন দুনিয়ায় টাইন্যা নিতাছে।” পূর্বের দুটো দৃষ্টান্তে পুরুষের দৃষ্টিতে নারীর অন্তর্বাসের প্রয়োজনীয়তা দেখানো হয়েছে। রুবিনার মা একজন নারী। সে তিমি উপন্যাসের নওয়াজেশের মতো এ পোশাকটির সঙ্গে পরিচিত নয়। সে লক্ষ করে মেয়ে রুবিনা গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার পর থেকে আচার-আচরণে পরিবর্তন এসেছে। সে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে পোশাক-পরিচ্ছদেও। এ পরিবর্তন মাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। রুবিনার মা নতুন এ পোশাকটি পছন্দ করে নি। নওয়াজেশও পছন্দ করে নি। তবে দুজনের অপছন্দের কারণ এক নয়। রুবিনার মা পছন্দ করে নি মেয়ের অমঙ্গল আশঙ্কা থেকে। অবিবাহিত মেয়ের জন্য মায়ের এই উৎকণ্ঠা স্বাভাবিক। কিন্তু নওয়াজেশ পছন্দ করে নি সম্ভোগাকাঙ্ক্ষায় এ পোশাকটি প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে বলে। যদিও এর দায় পোশাকটির নয়, দায় নওয়াজেশের বয়সজনিত অক্ষমতার।
পাঁচ.
মঞ্জু সরকারের টানে ভাই মুংলু ও ভাইয়ের স্ত্রী টাকার লোভে গোপনে মর্জিনার ব্যাগ তল্লাশি করে কিছুই পায় না। ঢাকায় দীর্ঘদিন ‘বড় লোকের বাসায়’ কাজ করে মর্জিনা যে সব কাপড় ও প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে সেগুলো তার দরিদ্র ভাই ও ভাবীর কাছে বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই নয়। অদম্য কৌতূহল নিয়ে মুংলুর স্ত্রী দেখে সে সব কাপড় ও প্রসাধন সামগ্রী: “নানা রঙের শাড়ি পাঁচখানা, এক জোড়া স্লাওয়ার-কামিজ, পেটিকোট-ব্রেশিয়ার ইত্যাদি কাপড়-চোপড়ে ঠাঁসা ছিল ব্যাগের পেট। এছাড়াও স্নো-পাউডার, ঠোঁট ও নখ রাঙাবার জিনিস। নারকেল তেলের বদ্ধ টিনের কৌটাটি ঝাঁকিয়ে অসুধ ভাবল মুংলু। সেন্টের শিশির তরলকে মাথায় দেয়ার তেল ভেবে কয়েক ফোঁটা চুলে মেখে বউটি বলল, ইস কী বাসনা!” মর্জিনার ঢাকা থেকে নিয়ে আসা এসব প্রসাধন সামগ্রী গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলোর কাছে একেবারেই অপরিচিত।
এ সবের মধ্যে মুংলুর স্ত্রী ‘রুমালের মতো একটি কালো বস্ত্র’ নিয়ে ঘরে ঢুকলে মুংলু ‘জোড়া টুপির মতো জিনিসটা যে মর্জিনার’ তা বুঝতে পেরে ‘বোনের স্তন দেখে ফেলার অস্বস্তি ও লজ্জা নিয়ে’ সেটা রেখে আসতে বলে। কিন্তু মুংলুর স্ত্রীর কৌতূহল লক্ষ্য করার মতো: “ধুমসি ননদের চেয়ে সে যে বুড়ি নয়, সেটা স্বামীকে বোঝাবার আগ্রহে জিনিসটা পরার শখ তার প্রবল হলো। স্বামীর দিকে পিঠ ঠেকিয়ে, দাঁতে শাড়ির আচল কামড়ে ধরে সামান্য চেষ্টাতে বস্ত্রখণ্ড বুকের মধ্যে সেঁটে ফেলল সে। কিন্তু পেছনের হুক লাগাতে না পারায়, কয়েক পা পিছিয়ে স্বামীর কাছে পিঠ এগিয়ে দিল, দেন তো জুগলুর বাপ, ফিতা দুই খান বাধি দাও।” কিন্তু বোনের ব্যাগে ‘টাকা আবিষ্কার’ না হওয়ায় হতাশ “মুংলু বউয়ের পিঠে দিল একটা কিল এবং মুখে গাল, অকামের শখ ক্যানে তোর মাগী?”
এ দৃষ্টান্তটি উপরের তিনটি দৃষ্টান্ত থেকে পৃথক। এখানে একই বস্ত্র মংলু যেভাবে দেখে তার স্ত্রী সেভাবে দেখে না। বোনের অন্তর্বাস মংলুর মতো গ্রামীণ নিঃসম্বল দিনমজুরের কাছে বোনের স্তনের সমতুল্য। নারীর স্তন পুরুষের যৌন-উপকরণ মাত্র। এটা মংলুর অনুভূতিতে ক্রিয়াশীল কিন্তু বিষয়টা আপন বোন সম্পর্কিত বলে এর ট্যাবু (নিষেধাজ্ঞা) তাকে লজ্জিত করে। স্ত্রীর ক্ষেত্রে যেটা স্বাভাবিক যৌনতার, বোনের ক্ষেত্রে সেটা লজ্জার- এটা সে জানে। কিন্তু মংলুর স্ত্রী মনে করে এ ধরনের পোশাক পরলে নারী আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাই এ পোশাকটির প্রতি সে প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। মংলুর স্ত্রী আকর্ষণীয় হতে চায়, কিন্তু কার জন্যে, লেখক তা বলেন না। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি।
কথাসাহিত্যিকরা এ চারটি রচনায় যে সামাজিক মানুষকে তুলে ধরেন তাতে দারিদ্র্যের চেহারাটা পাওয়া যায়। নারীর একটা বিশেষ পোশাক প্রসঙ্গে এর যে একটা শ্রেণি চরিত্র আছে তা যেমন প্রকাশ পায় তেমনি এ পোশাকের লৈঙ্গিক পরিচয় পুরুষতন্ত্রের যৌনতায় শেষ হয়। নিম্নবর্গের নারীকে উচ্চবর্গের পুরুষগুলো পোশাকের মধ্য দিয়ে তাদের শ্রেণির উপযোগী করে তুলতে চায় ভোগের সামগ্রী হিসেবে। নারীর একটি প্রয়োজনের পোশাক পুরুষতন্ত্রের ছায়ায় বেড়ে উঠে যৌনতার প্রতীকে পরিণত হয়। একটি ‘খাসা’ অঙ্গের যৌনতা প্রকাশে, ভাইয়ের লজ্জায়, অপর নারীর আগ্রহে আর অক্ষম পুরুষের ক্রোধে পোশাকটি তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে পুরুষের যৌনতা উপভোগের অংশ হয়ে ওঠে। তার দৃষ্টান্ত এ চারটি উপন্যাসের চারটি বক্ষ-বন্ধনী বিষয়ক ঘটনায় প্রকাশিত। নারীর শরীর পোশাকের আবরণে পুরুষের জন্য একটি আবশ্যকীয় যৌনতার ধারণায় এর সমাপ্তি।