November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নিজের প্রতি অন্যায় হতে দেয়াটাও পাপ…

প্রিয়া দাশ শান্তা।। চলুন, আজ একটা চির পরিচিত চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরি।

তিশা (ছদ্মনাম) এবং রাজীব (ছদ্মনাম) দম্পতির বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর। তিশা মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত এবং কর্মজীবী। রাজীব ব্যবসায়ী। প্রায় চার বছরের সম্পর্কের পর তারা বিয়ে করে পারিবারিকভাবে। শুরুতে অবশ্য তিশার পরিবার একদম রাজি ছিল না। তিশা তাদের অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজি করায়। বিয়ের পর দুই তিন মাস ভালো কাটলেও এর পর থেকে শুরু হল বিভিন্ন সমস্যা। তিশার শাশুড়ি কোন কারন ছাড়াই বাসার বুয়া বন্ধ করে দেয়। বাসায় সারাদিন কেউ একটা চামচও ধোয় না।সব কাজ বাড়ির বৌয়ের জন্য জমিয়ে রাখে। তিশাকে অফিস থেকে এসে সব করতে হয়।

৯টা থেকে ৬টা চাকরি করে বাসায় এসে দুপুরের থালাবাসন ধোয়া,ঘর মোছা,সবার কাপড় ধোয়া,রাতের রান্না করা সহ সব কাজ শেষ করে ঘুমাতে যায় রাত ১টার পর। পিএইচডি করার ইচ্ছে থাকলেও এসব সামলে আর কোন সময় ও শক্তি হয়ে ওঠেনা পড়ালেখার। এসব পরিশ্রমের পাশাপাশি বিনা কারনে শাশুড়ি ননাশের গালাগালি, বাবা মা কে নিয়ে অশ্রাব্য কথা শোনা ছিল দৈনন্দিন বিষয়।

বিষাক্ত পরিবেশ এবং নির্যাতন আর সহ্য করতে না পেরে তিশা একদিন রাজীবকে সব খুলে বলে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করে তার এতদিনের চেনা রাজীব অচেনা সুরে কথা বলে! তিশাকে বলে এসব সামলে পি এইচ ডি করতে পারলে করবে, না হলে দরকার নেই। সাফ জানিয়ে দেয়, এসব বিষয়ে কথা  ব’লে সে তার বাবা মাকে কষ্ট দিতে পারবে না।

তিশা ভেবে কূল পায় না যৌক্তিক বিষয়ে আলোচনা করলে কেন বাবা মা কে কষ্ট দেওয়া হবে! অবাক হয়ে ভাবে, তিশা যেদিন তার বাবা মা’র পছন্দের বিপরীতে বিয়ে করেছিল সেদিন রাজীবের মনে হয়নি তিশার বাবা মা’র মনে কষ্ট দেওয়া ঠিক না? প্রাণোচ্ছল তিশা ধীরে ধীরে শামুকের মত গুটিয়ে যায়, পড়াশোনা আর হয়না, স্বপ্নগুলো মরে যায়।

উপরের গল্পটি আমাদের সমাজের অতি পরিচিত চিত্র। আপাতদৃষ্টিতে এখানে শাশুড়িকে অন্যায়কারী মনে হলেও অন্যায় আসলে সবাই করেছে। একটা মেয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি আসে। তার উপর শিক্ষিত, মেধাবী হলে নিজের পরিবারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিও তার একটা দায়বদ্ধতা থাকে।পরিবারের সকল সদস্যের উচিত সেই দায়িত্ব পালনে বাড়ির বৌকে সহযোগিতা করা, স্বপ্ন পূরনের পথে বাধা না হয়ে শক্তি হওয়া, সাহস যোগানো। কেননা, প্রদীপ শুধু নিজেকে আলোকিত করেনা, চারপাশে সবকিছুই আলোকিত করে। যেসব শ্বশুর শাশুড়ি অযথা একটা বৌয়ের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তারা শুধু অন্যায়কারী না, পাপীও বটে। ছেলের বাবা মা হওয়ার অসভ্য ও বাজে অহংকারবোধ থেকে বৌয়ের বাবা মাসহ সবাইকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গালাগালি ও অসম্মান ক’রে সেই পাপের পাল্লা তারা আরো ভারি করে।

এবার আসি স্বামীর কথায়। স্ত্রীর সবচেয়ে কাছের ও ভরসার মানুষ তার স্বামী। স্বাভাবিকভাবেই, শ্বশুরবাড়িতে কোন অত্যাচারের শিকার হলে স্ত্রী তা স্বামীকে জানায় যেন স্বামী তার কষ্ট বুঝতে পেরে পরিবারের সবার সাথে আলোচনা করে, অন্যের অন্যায় আচরণ বন্ধ করে স্ত্রীর সম্মান ও শান্তি নিশ্চিত করে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবতা ভিন্ন। সারাজীবন সুখে দুঃখে পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করা স্বামীটি বিয়ের পর স্ত্রীর হাজারো অসুবিধা, কষ্ট, অসম্মান যেন দেখেও দেখেনা। তাদের ধারণা, ভরণপোষণ দিলেই স্বামীর দায়িত্ব পালন করা হয়ে যায়, স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করা কিংবা অত্যাচার থেকে বাঁচানোর কোন প্রয়োজন নেই। মনজুড়ে বেদনা নিয়ে একটু শান্তির জন্য যখন স্ত্রী স্বামীর কাছে যায়, তখন সান্তনার বদলে আরও কিছু কড়া কথা শুনিয়ে স্ত্রীর মনটা অনিশ্চয়তা ও অশান্তিতে ভরে দেয় স্বামী। স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তার প্রতি হওয়া অন্যায় ঠেকানোর চেষ্টা তো করাই হয়না, এমনকি এ সকল অমানবিক আচার-ব্যবহারকে তারা অন্যায় বলেও মনে করেনা! কোন কোন ক্ষেত্রে নিজে অসম্মান  ক’রে, গায়ে হাত তুলে নিজেই রক্ষক হতে ভক্ষক হওয়ার পাপ করে।

সর্বশেষে আসি বাড়ির বৌয়ের কথায়। বৌ হতে গিয়ে, স্ত্রী হতে গিয়ে এরা নিজেদেরই হারিয়ে ফেলে। সংসারে টিকে থাকতে এরা দিনের পর দিন অন্যায় সহ্য করে, নিজের মেধা,স্বপ্ন, আত্মসম্মান ও স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়। তাদের এই মেনে নেওয়াটাই পাপ। কেননা, আজকে তিশা মেনে নিয়ে যেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, তা কালকে মিতা, বিথী, শিরীন, ফারিয়াদের মানতে বাধ্য করবে, ছাড়তে বাধ্য করবে, হারিয়ে যেতে বাধ্য করবে। নিজের ক্ষতি করার পাশাপাশি এরা এভাবে সমাজের যে বিশাল ক্ষতি করে, তার জন্য তারা পাপী। নিজের শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রয়োগ না করে, কুসংস্কার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান না নিয়ে নিজের ও সমাজব্যবস্থার যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি তারা অজান্তে করে ফেলে, সেজন্যও তারা পাপী। তাই, অন্যায় করা যাবেনা, কারো প্রতি অন্যায় হচ্ছে দেখলে চোখ মুখ বুজে থাকা যাবেনা এবং নিজের প্রতি কোনভাবেই অন্যায় হতে দেওয়া যাবেনা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]