September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

মেয়েরা, সাবধান হোন, আবেগের রাশ টেনে ধরুন

মেহেরুন নূর রহমান।। ইনবক্স চ্যাটিং আমার কেন যেন পোষায় না। চেনা মানুষের সাথেই ইনবক্স চ্যাটিং হয় না আর অপরিচিত কারো সাথে তো নৈব নৈব চ! ইনবক্সে নতুন বা অল্প চেনা কারো সাথে কথা বলে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারটার সাথে আমি যেতে পারি না কারণ যে মানুষকে আমি সামনা সামনি ঠিকমত দেখিনি বা  যার সম্পর্কে ভালোভাবে জানি না তার সাথে কীভাবে বন্ধুত্ব করি তা সে যত ভালো ভালো কথাই বলুক  না কেন? আর বেশি তেলতেলে মেসেজ দিলে তো আমার রীতিমত সন্দেহ হতে শুরু করে, ইন্টিমেট হওয়া তো দূর কি বাত। চারপাশে যা দেখছি তাতে ইনবক্স চ্যাটিংয়ের প্রতি আমার যে অনীহা তাকে আমি সত্যিই অ্যাপ্রিশিয়েট করি। যাই হোক এবার আসল কোথায় আসি।

বেশ কয়েকটা লেখা পড়লাম যেখানে ইনবক্সে নোংরামি করা তথাকথিত মুক্তমনা কয়েকজনের মুখোশ খুলে দেয়া হয়েছে। তাদের নোংরামির স্ক্রিনশট প্রকাশ করা হয়েছে। একজনকে তো দেখলাম প্রকাশ্যে মাফ চাইতে। তো এটা বেশ ভালো হয়েছে। যারা এসব করে তাদের নোংরামি প্রকাশ হওয়া উচিত। অবিবাহিত বিবাহিত সব ধরণের লোক এই কাজ করে থাকে। যারা এসব ভণ্ডামি/নোংরামি/ইতরামি করে তাদের নাম প্রকাশ হওয়া জরুরি। আমার এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নাই। যত বেশি এই ধরণের মুখোশ উন্মোচিত হবে ততো ভালো। আমার আজকের লেখা এইসব লোকদের নিয়ে নয় বরং যেসব মেয়েরা এসব নোংরা লোকেদের ফাঁদে পড়ে তাদের নিয়ে।

একটা লেখা পড়লাম আজ। যেখানে লেখক বর্ণনা করেছেন কীভাবে তিনি এরকম একজনের ফাঁদে পড়েছিলেন। লেখক এক সন্তানের মা এবং ডিভোর্সড সুতরাং অনুমান করতে পারি যে তিনি হয়তো খানিক একাকীত্বে ভুগছিলেন যখন ঘটনাটি ঘটেছিলো। লেখক বলেছেন যখন থেকে লোকটি তার সঙ্গে কথা শুরু করে তখন থেকেই লোকটির ইনটেনশন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু সাবধান হবার বদলে ওই লোকের কথার জাদুতে ভেসে গিয়েছিলেন তিনি।

এক পর্যায়ে লেখক বলেছেন যে লোকটির মত অনেক বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক করা লোকের সাথে উনি কী করে সম্পর্কে জড়ালেন ব্যাপারটা এখনো তার নিজের কাছেই বোধগম্য নয়। উনি বলেছেন আবেগের বশবর্তী হয়ে কাজটা করেছেন। আর আমার সমস্যা ঠিক এখানে। তারমানে লোকটি বিবাহিত ছিল লেখক তা জানতেন। লোকটি আরো অনেকের সাথে এরকম সম্পর্ক করেছে সেটাও লোকটা লেখককে নিজের থেকেই বলেছে। লোকটি মানসিক  প্রেমের চেয়ে শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিল সেটা লেখক শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। সুতরাং লোকটি তার ইনটেনশন এবং চরিত্র নিয়ে তেমন রাখঢাক করেনি বলা যায়।

লেখাটি পড়ে যে কোনো কারো বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে লোকটি অসচ্চরিত্র এবং লম্পট ছিলো। লেখক শিক্ষিত, বুদ্ধিমান হবার পরও আবেগের জোয়ারে ভেসে সম্পর্কটিতে জড়িয়েছিলেন। এক সময় লোকটি সম্পর্কটি শেষ করে ভালোমানুষ হয়ে বৌ-বাচ্চার কাছে ফিরে গেল। এই পর্যায়ে এসে লেখকের লোকটির উপর ভীষণ রাগ হলো এবং মনে হলো লোকটির মুখোশ খুলে দেয়া উচিত। অবশ্যই তা উচিত কিন্তু ব্যাপারটা আর একটু আগের করা উচিত ছিল না কি? যখন লোকটি লেখকের কাছে তার লাম্পট্যের গল্প করেছিল তখনই কি দরকার ছিল না তার মুখোশ খুলে দেবার? তা না করে লেখক লোকটির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন যেটা লোকটিকে তার মেয়েদের পটিয়ে নোংরামি করার কাজকে উৎসাহিত করেছে বলে মনে করি।

এই যে আপনি জেনে শুনে একজনকে এভাবে প্রশ্রয় দিলেন তার দায়ভার যে আপনাকে নিতে হবে ভাই! নানা মেয়েদের কাছে এভাবে প্রশ্রয় পেয়ে পেয়েই এইসব অসৎ লোকেরা বিন্দাস সবার সাথে  লাম্পট্য করার সাহস পায়। যতই একাকীত্বে থাকি না কেন, জেনে শুনে আমি কেন কোন নোংরা লম্পটের সাথে সম্পর্কে জড়াবো যখন শুরু থেকেই জানি তার অভিপ্রায়? কেন তার চতুর কথায় নিজের মন ভোলাবো? তারপর লোকটি দ্বারা যখন নিজে প্রতারিত হব তখন চিৎকার- চেঁচামেচি করতে থাকবো?

কেন আমাদের আত্মসংযম এতো কম হবে যে ভুলভাল জায়গায় পা ফেলবো?  আর কেনই বা আমাদের আত্মসম্মানবোধ এত কম হবে যে, যে কেউ চতুর বাক্যবানে আমাদের পটিয়ে ফেলতে পারবে? কেন আমরা এতো সহজেই আবেগের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে নিজেকেই ঠকাবো বা কষ্ট পাবো? মেয়েদের এই যে জেনে-শুনে-বুঝে আগুনে ঝাঁপ দেবার মানসিকতা, এটা খুব ক্ষতিকর।  অনলাইনের এসব ঘটনা থেকে না হয় সহজে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু অতি আবেগের বশবর্তী হয়ে মেয়েরা জীবনে অনেক বড় বড় অঘটন ঘটিয়ে ফেলে যেগুলোর মাশুল জীবন দিয়ে দিতে হয় ।

আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু বিয়ের আগেই তার প্রেমিকের নানা চারিত্রিক এবং মানসিক অসংগতি দেখতে পেয়েও সে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। পরবর্তীতে তাদের বিয়েও হয়েছিল এবং আমার বন্ধুটিকে কাটাতে হয়েছিল এক দীর্ঘ যন্ত্রনাময় দাম্পত্য।

আমার পরিচিত এক দম্পতির কথা জানি। দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে। স্বামীটির প্রথম স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। স্ত্রীটি প্রেমে পরে আগের স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। স্বামীটির প্রথম স্ত্রী যখন জীবিত, তখন সে অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে ঘুরে বেড়াতো, নানাজনের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াতো। ইন ফ্যাক্ট বর্তমান স্ত্রীর সাথে প্রেম, প্রথম স্ত্রী জীবিত এবং অসুস্থ থাকাকালীনই। অগোছালো, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং লাগামহীন চরিত্রের একজন মানুষের এসব কর্মকাণ্ড দেখেশুনেই বর্তমান স্ত্রী তার আগের স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছিলো একে বিয়ে করবে বলে। আমি অবাক হয়ে ভাবি মানুষ প্রেমে পড়লে কত বেকুব হয়।

যে লোক ৪০ বছর হয়ে যাবার পরও দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং ভয়ঙ্কর অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে অন্য বাসায় রাতভর আড্ডা দেয়, সেই লোকের চরিত্র পরিবর্তন হওয়ার আর কোন সম্ভাবনা আছে কি? যেটা অনুমান করতে পারি, এই দম্পতির দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। স্ত্রীটি প্রতিনিয়ত সকলের কাছে অভিযোগ করে তার স্বামীর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে, সংসারের খরচ না দেয়া নিয়ে, চারিত্রিক অসততা নিয়ে। বিয়ের আগে কি ভেবেছিলো স্ত্রীটি? তার প্রেমে পড়ে লোকটি শুধরে যাবে? তার প্রেমের শক্তিতে লোকটি প্রেমময় আঁচলধরা দায়িত্ববান স্বামী হয়ে যাবে? দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত স্ত্রী, যার মৃত্যু অনিবার্য, যে কেবল কয়েকদিনের মেহমান, তাকে সময় না দিয়ে কেউ যদি আপনার সাথে প্রেম করে সময় কাটাতে চায়, তাহলে তখনই তো তাকে অবিশ্বাস করা উচিত। এমন নিষ্ঠুর লোকের সাথে কেন সংসার পাতার কথা ভাববো তা সে যতই মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কথাই বলুক না কেন?

আমার লেখার মূল বক্তব্য হলো, শুধু অন্যের দোষ না ধরে নিজের দায়বদ্ধতাটুকুও বুঝতে শিখুন। আমাদের চারপাশে কত ঘটনা ঘটছে, আমরা দেখছি পুরুষরা কি করে মেয়েদের নিয়ে নানা প্রতারণার খেলা খেলছে। সেটা ইনবক্সেও এবং বাইরেও। এত কিছু দেখার পরও যদি আমরা শিক্ষা না নেই এবং অতি সহজে কারো মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলে আগুনে ঝাঁপ দেই, তাহলে সে ভুলের, বোকামির দায়ভারও আমাদেরই নিতে হবে হবে।

শুরু থেকেই যদি আপনি কোন লোকের ইন্টেনশন খারাপ বোঝেন, তাহলে সে লোক যত বুদ্ধিমানই হোক, যত সুন্দর মনভোলানো কথাই বলুক না কেন তাকে সরাসরি ইগনোর করুন। বিবাহিত লোকেরা যখন নিজের বউয়ের বদনাম করে আপনার সিম্প্যাথি পাবার চেষ্টা করে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ব্লক করুন। ভালো মানুষ সেজে আপনার সাথে বন্ধুত্ব পাবার পর যে লোক আপনার নানা রকম ছবি পাবার জন্য ইনবক্সে আবদার করতে শুরু করে তার সঙ্গে কথা বন্ধ করুন।

আমাদের আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আত্মসচেতন হতে হবে। দয়া করে জেনেশুনে বিষ পান করবেন না। জেনে বুঝেও আবেগের তাড়নায় না বোঝার ভান করে আগুনে হাত দেবেন না। আমি জানি ইমোশনকে কন্ট্রোল করা সত্যিই কঠিন। কিন্তু এতটা আবেগী হয়েন না যে আপনার আবেগই  আপনার বিরাট ক্ষতির কারণ হয়। যখন আপনি আঁচ করতে পারবেন আপনার সাথে ইনবক্সে কথা বলা লোকটি ভাল মানুষ নয় তখনই সাবধান হোন। মানুষকে জাজ করা খুব কঠিন কিছু নয়।  একটু সচেতন হলেই আপনি তা পারবেন।

প্রেমের বেলাতেও সাবধান হওয়া দরকার। প্রেমিক এবং পরবর্তীতে স্বামী হওয়া প্রচুর লোকদের প্রতারণার ভয়ংকর সব ঘটনার খবর আমরা নানা সময় শুনতে পাই। যদি বুঝতে পারেন আপনার প্রেমিক ভালো মানুষ নন, তাহলে তাকে ত্যাগ করা দরকার। প্রেমের আবেগে চোখ বন্ধ করে রাখবেন না। প্রেমিক যদি অ্যাবিউসিভ হয়, চরিত্রহীন হয়, ডমিনেটিং হয়, নিষ্ঠুর হয় তখন কষ্ট করে হলেও সে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

আপনার প্রেমিকও যদি আপনার ন্যুড ছবি চায় তা দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কোন অবস্থাতেই আপনার প্রেমিককে আপনাদের ইন্টিমেট সম্পর্কের সময় ভিডিও করতে দেবেন না। যে সব প্রেমিকরা এসব করতে চায় তাদের অভিপ্রায় ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করুন। আবেগের তাড়নায় প্রেমিকদের এইসব ইতরামিতে সায় দেবেন না। জানি প্রেমের সম্পর্ক থেকে বের হওয়া অনেক কঠিন তারপরও চেষ্টা করতেই হবে। আজকের একটা ইমোশনাল ভুলের জন্য আপনাকে সারাজীবন পস্তাতে হবে। তাই যত কষ্টই হোক, ইতর শ্রেণির প্রেমিকের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসুন। দরকার হলে বন্ধুবান্ধব, মা বাবা, ভাই বোন কিংবা স্পেশালিস্টের সাহায্য নিন। আপনি নিজে যদি শক্ত না হন, সাবধানী না হন, সচেতন না হন তাহলে যন্ত্রণার আগুনে কিন্তু আপনিই পুড়বেন, জীবন ধ্বংস হবে আপনারই, অন্য কারো না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]